………মহুলের ডায়েরি….. ……… ইলা মজুমদার
………মহুলের ডায়েরি…..
……… ইলা মজুমদার
রাজধানী এক্সপ্রেস এ বাড়ি ফিরছি। সিটে বসেই নিজস্ব ফেসবুক প্রোফাইলে চোখ রাখলাম, যথারীতি ভেসে উঠলো নিজেরই লেখা কয়েকটি লাইন…………
“আমাকে কিছু কথা পাঠাও
ভাঙ্গুক এ নীরবতা,
একাকিত্বের চেয়ে যে বড়
নেই কোনও শূন্যতা।”
হঠাৎই উল্টোদিকে লোয়ার সিটে বসা এক ভদ্রমহিলা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কতদূর যাবেন? গন্তব্যস্থল জানালে উনি বললেন, আপনি আমার আগেই নেমে যাবেন। আমি ভুবনেশ্বর যাব। মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি একা যাচ্ছেন? উনি বিষন্ন কণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ, একাই যাচ্ছি আমার কেউ নেই। এক আত্মীয় বাড়ি গিয়েছিলাম, ফিরছি। তারপর আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,আপনিও বুঝি একা যাচ্ছেন? আপনার সঙ্গে কেউ নেই? বললাম, স্বামী মারা যাবার পর থেকেই একা যাতায়াত করাটা অভ্যেস হয়ে গেছে।
কম্পার্টমেন্টে বিপাশা আর আমি ছাড়া
দ্বিতীয় কেউ নেই। ফার্স্ট ক্লাস। দুটো আপার সিটই ফাঁকা। কথার ফাঁকেই দুজনের পরিচয় জানা এবং সেটা
আপনি থেকে তুমি সম্বোধনে পৌঁছে গেল খুব তাড়াতাড়ি।
বিপাশা বললো আমারও স্বামী নেই, বছর তিনেক হল চাঁদের দেশে পাড়ি দিয়েছে। ও আলোর যাত্রী আর আমি অন্ধকারের। আমি কলেজের প্রফেসর। ভুবনেশ্বরে আমার একটি বাড়ি আছে। একাই থাকি। এখন একাকীত্ব আর শুধুই শূন্যতা। ভাই বোন সবাই পাশে থাকে কিন্তু কেউ কাছে থাকে না। এটাই স্বাভাবিক।প্রত্যেকের নিজস্ব সংসার আছে। অনেক দায- দায়িত্ব।
আমি যেন নিজেকেই দেখতে পাচ্ছি। তবুও ধীরে ধীরে বললাম, নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখো। একাকিত্ব কাটানোর চেষ্টা করো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিপাশা বললো, একাকীত্ব কাটানোর খুব চেষ্টা করে চলছি, পারছিনা। অতীত ফিরে ফিরে আসে। সারারাত ঘুম আসে না, কত জোছনা ঝরা রাত দেখি কিন্তু আলো দেখি না। রাতে শরীর খারাপ হলে কাউকেই পাশে পাই না। এখন আর ডাকিও না।
মৃত্যুর বেশি আর কি আছে!
এ যেন দার্শনিক উক্তি, “জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুঃ।”
বিপাশা আপন মনে বলতে লাগলো, আমার স্বামী সবার উপকার করত, সবার বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তো। একজন আমার স্বামীর খুব কাছের বন্ধু ছিল আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসতো,আড্ডা দিত, কত গল্প গুজব করত।
এই কিছুদিন আগে হঠাৎ আমার প্রেসারের ওষুধ শেষ হয়ে যাওয়ায় তাঁকে এক প্যাকেট ওষুধ আনার জন্য মেসেজ করেছিলাম তিনি রিপ্লাই দেননি, ফোন করেছিলাম, ধরেননি। এতোটুকু ভদ্রতা বা সৌজন্য বোধ তাঁর মধ্যে দেখতে পাইনি। অথচ ওই বন্ধুর কথা মত আমার স্বামী দিনের পর দিন তাঁকে স্টেশনে ছাড়তে যেত আর সপ্তাহের শেষে রাত বারোটা বাজলেও তাকে আনতে যেতে হতো। অথচ স্টেশনে যানবাহনের অভাব ছিল না। মানুষ বড় স্বার্থপর, শুধু নিজেরটাই বোঝে।
বললাম, বিপদেই মানুষ চেনা যায। তুমি এখনো নিজের কথা ভাবতে পারো। কিছু মনে কোরো না, জীবনে একজন বন্ধুর খুব প্রয়োজন।
বিপাশা আপন মনে বলতে থাকে, …..
একাকিত্বের অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে বিয়ের কথাও ভেবেছিলাম। একজন ব্যক্তি আমার খুব ভালো বন্ধু। পাশের কলেজে চাকরি করেন। বিয়ে করেননি। দুজনে বিয়ের কথাও ভেবেছিলাম। ওনার বাড়িতে কারো আপত্তি ছিল না। বরং খুব আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।
বললাম বাহ্ ভালো তো, বিয়েটা করেই ফেলো। এখনো তোমাকে অনেকটা রাস্তা হাঁটতে হবে। পাশে থাকার একজন সঙ্গী পাবে। পরচর্চা পরনিন্দা চলতে থাকবে কিন্তু পাশে কেউ থাকবে না।
এবার বিপাশা বেশ বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, তারপর বলতে শুরু করলো উনি বলেছিলেন তোমার ভাই-বোনদের মতামত আমাকে জানাও। তাদের মতামতের খুব প্রয়োজন আছে, তুমি তো একা নও।
আমি সাগ্রহে বললাম, তারপর…….
বিপাশা আবারও বলতে শুরু করল… বোনকে বিষয়টা জানালে বোন বলল, “ওনার টাকা না থাকলে কি ওনাকে তুই বিয়ে করতে চাইতিস?”
আর কি, এক ফুঁয়ে প্রদীপ নিভে গেল। সবাই আত্মীয় কিন্তু কেউ আন্তরিক নয়।
বুঝলাম, শেষ লাইনেই উপন্যাসের উপসংহার। নিজের ইচ্ছেকে অসহায় ভাবে সৎকার করতে বাধ্য হয়েছে বিপাশা।
আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা বলো তো তোমার বোন কি কোন শিক্ষিত বেকারকে বিয়ে করেছিল? নিজের ক্ষেত্রে তেমন কোনো মহৎ উদ্দেশ্য তার মধ্যে ছিল ? পরবর্তীতে আছে কী ?
বিপাশা আমার দিকে একটু তাকালো,
তারপর ঠোঁটের কোণে একটু বাঁকা হেসে বলতে শুরু করলো, বোন সবার আগেই বিয়ে করেছিল। বোনের স্বামী খুব বড়লোক এবং ভালো চাকরি করতো।
সংক্ষেপে বোঝা গেল সবাই আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বার্থপর। অনুভব করলাম, একাকিত্বের যন্ত্রণায় ঢিবি হয়ে ফুলে গেছে নিজেরও কপাল। এ হৃদয়ে শুধু খোঁড়াখুঁড়ি হয়, বৃষ্টি নামে না। বছর বছর ক্যালেন্ডার পাল্টায় কিন্তু জীবন নয়।
বিপাশাকে শুয়ে পড়তে বলে নিজেও শুয়ে পড়লাম। রাত অনেক হয়ে গেছে। ট্রেন ছুটছে অন্ধকারের বুক চিরে। একটা সত্যিকারের পাখি ডাকা ভোর ‘তারও’ জীবনে কখনো আসবে না।
হার্ট স্ট্রিটের শ্মশান, সহস্র আলো ধক ধক।
চিতায় শুয়ে আছে এমন কত মন!