#রবীন্দ্র সাহিত্যে নারী **** মমতা শঙ্কর সিনহা(পালধী)

#রবীন্দ্র সাহিত্যে নারী
✍️মমতা শঙ্কর সিনহা(পালধী)
রবীন্দ্র লেখনীতে বারংবার বিভিন্ন নারী চরিত্র বিভিন্ন রূপে নানা আঙ্গিকে প্রকাশিত হয়েছে।তাঁর সৃষ্টিকর্মের শৈল্পিক নৈপুন্যতায় জন্ম নিয়েছে অসংখ্য মানস নারী চরিত্র। যারা আজ যেনো বাস্তবের নারী চরিত্রের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়েগেছে।রবীন্দ্র সাহিত্যের নারী চরিত্রগুলি যেমন রোমান্টিকতায় পরিপূর্ণ তেমনি অন্যদিকে নারী চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে অনেক নিগূঢ় তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে।”মানসী” কবিতায় নারীত্বের, নারী চরিত্রের সুন্দর সৌন্দর্য মন্ডিত অসাধারণ ব্যাখা করেছেন কবি গুরু।যা পাঠ করে আমাদের অন্তরে অপূর্ব এক ভাবাবেশের সৃষ্টি হয়।আবার “চোখের বালির” বিনোদিনীর অন্তরে আশালতার প্রতি সমাজের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ফলে সৃষ্ট প্রতিহিংসাপরায়ণতার আগুন প্রজ্জ্বলিত হয়েছে।যাতে দগ্ধ হয়েছে আশালতা ও মহেন্দ্রের সংসার জীবন।
বিশ্ব কবির হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি হয়েছে অবিস্মরনীয় কিছু নারী চরিত্র। শেষের কবিতা, নৌকা ডুবি, চোখের বালি,দেনাপাওনা, হৈমন্তী,স্ত্রীপত্র।
“শেষের কবিতা” প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কাব্যধর্মী উপন্যাস। এই
উপন্যাসে প্রধান নারী চরিত্র লাবণ্যের চরিত্র চিত্রনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিংশ শতকের বঙ্গীয় সমাজে নব্যশিক্ষিত উচ্চ সম্প্রদায়ের জীবনকথা অতি বাস্তব সত্য রূপ নিয়ে ফুটে উঠেছে।শিলং পাহাড়ের মত দৃঢ়চেতা লাবণ্য ভালোবেসেছিল বিলেত ফেরত উচ্চ শিক্ষিত অমিতকে।কিন্তু হঠাৎই একদিন অমিতের জীবনে তার পূর্ব প্রেম কেতকী হাজির হয় ঠিক অমিত ও লাবণ্যর বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রাক মূহুর্তকালে।কেতকীর অনামিকায় সুসজ্জিত অমিতের দেওয়া ভালোবাসার প্রতিকী-উজ্জ্বল হীরের আঙটি দৃঢ়চেতা লাবণ্যর চরিত্রক বৈশিষ্ট্য আর উদার মানসিকতার দৃষ্টিভঙ্গি অমিতের ছলনার প্রেম বৈবাহিক সম্পর্ককে পরিত্যাগ করে।রবীন্দ্র কাব্য উপন্যাস “শেষের কবিতায়” লাবণ্য এমন এক অনন্য নারী চরিত্র যে দীঘির জলের মত, যাকে বাঁধা যায় না কিন্তু তাতে উচ্ছল ভাবে সাঁতার কাটা যায়।
আবারও ফিরে আসি কবি গুরুর সেই বিখ্যাত উপন্যাস “চোখের বালির” দৃশ্যপটে।এখানে সমাজ,যুগান্তরের রূপান্তর,পিতৃ-মাতৃহীন, স্বামী-সন্তান ,সহায়সম্বলহীন নারী যে চেতনে অবচেতনে বারংবার তার “বালি” অর্থাত মহেন্দ্রের সহজ-সরল স্ত্রী আশালতাকে হিংসা করেছে।
আমাদের জীবনের চলার পথ থেকে শুরু করে সাহিত্য, নাটক, নোবেল, উপন্যাস সবেতেই এক এক সময় এক একটি ট্রাজিক চরিত্রের আবির্ভাব ঘটেছে।তেমনি এক ট্রাজিক চরিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বিখ্যাত উপন্যাস “চোখের বালির” বিনোদিনী।
উপন্যাসের ট্রাজিক নায়িকা বিনোদিনীর হিংসার আগুনে জ্বলে শেষ হয়ে গিয়েছিলো মহেন্দ্রের নিরীহ নিষ্পাপ স্ত্রী আশালতার জীবন। আশা তার মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলো তার সই “বালি” অর্থাত বিনোদিনীকে।
কিন্ত সরলমনের আশালতার সাথে বিনোদ এহেন হিংসাত্মক আচারন করলো কেনো?আশার নিষ্পাপ, সহজ-সরল হৃদয় তার সইয়ের মনের গূঢ় মনস্তত্বকে বুঝে উঠতে পারেনি।এই মনস্তত্বকেই কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস “চোখের বালি”।
হ্যাঁ হিংসা সকলের মনেই আছে,সকল হিংসার ধরন এক নয়।মানুষের চরিত্রের পার্থক্যে হিংসাও নান ধরনের হয় ।এক একপ্রকার হিংসার জন্ম এক একরকমের পরিবেশ পরিস্থিতি হয়।কখনো প্রবল হতাশা,কখনো ক্ষোভ, দুঃখ, শোক কিংবা জীবনের বিষাদময় কোনো অধ্যায়ারে থেকে সৃষ্ট হয়।জীবনে কিছু জিনিস পেতে করতে হয় প্রচুর কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যাবসয়। কিন্তু কিছু মানুষ জীবনে অতি সহজেই সব কিছুই পেতে চায়।অপরের সুখ,শান্তি নিজের করে পেতে হয়ে ওঠে প্রতিহিংসাপরায়ণ।
নিয়তিই মানুষের হার,জিত, সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে।অনাথ ব্যক্তি বাবা-মার ভালোবাসা পাওয়া আহ্লাদি মানুষকে দেখে হিংসা করে,অকাল বৈধব্য যন্ত্রনাকাতর নিঃসঙ্গতার নারী স্বামী সোহাগিনী স্ত্রীকে হিংসা করে।সন্তানের থেকে অবহেলা পাওয়া বাবা-মা অন্যের বাধ্য সন্তানকে দেখে অসহায় বোধ করে সেই সন্তানকে অনেকক্ষেত্রে হিংসাও করেন।
সে যাই হোক বিনোদিনীর ক্ষেত্রেও এইরকম অসহায় অবস্থার শিকার হয়েই কিন্তু আশালতার উপর তার হিংসার উদ্রেক হয়েছে।যে হিংসা সবদিক থেকেই আশাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলো।বিনোদিনী তার মায়ের সইয়ের ছেলে মহেন্দ্রের সহজ-সরল, অশিক্ষিত ,ঘরোয়া স্ত্রী আশালতার সুখী বৈবাহিক জীবন মেনে নিতে পারেনি।বিনোদ যেনো তার মনের অজান্তেই বারংবার আশাকে ঈর্ষা করেছে।
এইরকম হিংসার শিকার আমরা কেউ কি কখনও হই না?
নিজের অজান্তেই অনেক সময় এইরকম হিংসার প্রতিফলন ঘটে আমাদের অনেকেরই জীবনে।কখন আমরা আমাদের জীবনের অনেক অনেক অপূর্ণ আশার বেদনায়,প্রিয়জনকে হারানোর কান্নায় জীবনের খালি জায়গাটা পূরণ করার অছিলায় রাগে,ক্ষোভে, দুঃখে,কান্নায় হতাশাচ্ছন্ন হয়ে কোনো কোনো মানুষের প্রতি হয়ে উঠি চরম হিংসাত্মক।
তাই আমরা অকালবৈধব্য যন্ত্রনা কাতর, ভাগ্যহীনা,পিতৃ-মাতৃহীন,অসহায়,সর্বহারা বিনোদিনীকে ঘৃণার চোখে দেখতে পারিনা ।
হ্যাঁ বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে দেখলে আমরা হয়তো তার হৃদয়ের ব্যথা কিছুটা হলেও উপসম করতে সক্ষম হতাম।কিন্তু তৎকালীন সমাজবন্ধনের নাগপাশে আবদ্ধ সমাজ তার সেই চরম হতাশাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে—তার হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করেছে।বিনোদিনীর অন্তরের সুপ্ত হিংসাকে মারাত্মক প্রতিহিংসায় পরিণত করেছে।যার জন্য বারংবার চেষ্টা করেও বিফল হয়ে বিনোদিনী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পুরুষের—প্রথমে মহেন্দ্রো ও পরে মহেন্দ্রের ভাতৃসম বন্ধু বিহারীর প্রেমে পড়েছে।
“চোখের বালি”উপন্যাসে বিহারী বিনোদিনীকে বলেছিলো–“বিনোদ আমি তোমাকে ঘৃণা করি,কিন্তু তার থেকে বড় সত্য—আমি তোমায় ভালোবাসি।”
এই কথার অর্থ কি জানেন–এর অর্থ বউঠান অর্থাত মহেন্দ্রের স্ত্রী আশালতার প্রতি বিহারীর গূঢ়শ্রদ্ধা ও বউঠানের ভালোবাসার মর্যাদাহীনতা—যা আশার “বালি” তার সাথে করেছিল–মহেন্দ্রোকে আশালতার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চেয়ে ।বিহারীর কথায় তাই এই ঘৃণার উল্লেখ ঘটেছে।কিন্তু বিনোদিনীকে ঘৃণা করা সত্ত্বেও তৎকালীন সমাজ তার মত বুদ্ধমতি, শিক্ষিতা, সুন্দরী অসহায় নারীর অকাল বৈধব্য যন্ত্রনা সমাজের অবহেলার কথা–সকল দিক থেকে বিচার বিবেচনা করে বিহারী তাকে ভালোবেসেছিল।
আমারও উপন্যাসটি পড়ে বিনোদিনীর চরিত্রটি পড়ে তাকে বিহারীর মত ভালোবাসি ও তার ট্রাজিক চরিত্রের প্রতিটি মুহূর্তকে উপলব্ধির চেষ্টা করি।
তাই যখনই মনে কোনো হিংসার উদ্রেক হবে জোড় হাতে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব,নিজের চোখ বন্ধ করে বলব—“প্রভু দাও মোরে আরো চেতনা”।
নৌকাডুবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর একটি অবিস্মরনীয় উপন্যাস। তাঁর লেখা তেরোটি উপন্যাসের চতুর্থ উপন্যাস এটি।এখানে রোমান্টিকতার সাথে সামাজিক বন্ধনের মিশেলে কবি এক অপার চরিত্র চিত্রায়িত করেছেন।এই উপন্যাসের উপজীব্য ছিলো ভাগ্যের সাথে নিয়তির নিঠুর খেলা।মনের কুটিলতা, জটিল মনস্তত্ব,হিংসা-বিদ্বেষ এর জায়গায় ফুটে উঠেছে দুই মানব-মানবীর আদিম ও সূক্ষ্ম অনুভূতি।উপন্যাসে রমেশ দুর্বল ছিলো হেমামালিনীর প্রতি আর সেখানে বাঁধ সাধে নিয়তি।
অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের নারী চরিত্র শুধু কোমলতা,স্নেহ,প্রেমের মূর্তি নয়।সে নারী বীরঙ্গনাও। চিত্রঙ্গদা চরিত্র তার প্রমাণ।সে রাজনন্দনী হয়েও বীর যোদ্ধা অতচ সে বলছে সে একজন সমান্যা নারী।কবির সৃষ্ট চিত্রাঙ্গদা এক অনন্য নারী চরিত্র। রাবেন্দ্রীক নারী চরিত্রেরা পুরুষের ছায়ামাত্র নয়।বরং সে সকল চরিত্ররা তৎকালীন যুগ অপেক্ষা যথেষ্ট অগ্রসর নব-নবীন নতুনত্বের তরে তাদের চরিত্র বৈশিষ্ট্যে।হয়তো ঠাকুর বাড়ির অনেক নারীর মধ্যে এই সকল বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে ছিলেন বলেই তাঁর সাহিত্যে নারী চরিত্রগুলি এত স্বতন্ত্রবৈশিষ্ঠ্য মন্ডিত।ব্যক্তি জীবনেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পেয়েছেন অনেক নারী সান্নিধ্য। কাদম্বরী,জ্ঞানদানন্দনী,স্বর্ণকুমারী,সরোলা ঘোষাল,ইন্দিরা দেবী,স্ত্রী মৃনালিনীদেবী,কন্যা মাধুরীলতা,রেণুকা,মীরাদেবীর মত প্রতিভাময়ী, সাধারণ অতচ অসামান্য সকল নারী চরিত্রগুলি আপন ব্যক্তি সত্ত্বতায় ভিন্ন ভিন্ন নামে স্থান পেয়েছে।
কাদম্বরীদেবীর নিঃসঙ্গ জীবন, কবির নিঃসন্তান কন্যা মাধুরীর অকাল মৃত্যুর সব যেন কবিকে বিস্মিত ভাবে নাড়া দিয়েগেছে প্রতি মূহুর্তে।আর তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কবির লেখনীর মধ্য দিয়ে।
বিশ্ব কবির কন্যাদের দাম্পত্য জীবন খুব একটা সুখকর ছিলো না।সেই অসুখী দাম্পত্যের প্রতিফলন ও কাদম্বরীদেবীর আত্মহত্যা জন্য যে প্রবল অভিমান তার প্রকাশ ঘটেছে কবির সৃষ্টির ভুবনে বিরাজিত নারী চরিত্র চিত্রায়নে।বৈচিত্র্যের দিক থেকে রাবেন্দ্রীক নারী চরিত্র অসামান্যা।
এবার আসি দেনাপাওনার সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের পিতা রামসুন্দরের আদরের মেয়ে নিরুপমার কথায়। জমিদার রায়বাহাদুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পুত্রের সাথে নিজের সাধ্যাতীত পণ দিয়ে একমাত্র সুন্দরী কন্যা নিরুপমার বিয়ে দিতে রাজি হন রামসুন্দর।শাশুড়ির কাছে নিরুপমার রূপ অপেক্ষা পণের অর্থই বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলি কবির কন্যা মাধুরীলতার স্বামী শরৎবাবু ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ।বেশ মোটা অঙ্কের যৌতুক দিয়ে কন্যা মাধুরীর বিবাহ দেন কবি।স্বামীর ভালোবাসা পেলেও নিঃসন্তান মাধুরীলতা শ্বশুরালয়ে শাশুড়িরঠাকুরানীর কাছে নিগৃহীতা ছিলেন।তিনি অতি অল্প বয়সেই যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে শ্বশুরালয়ের অবহেলায় অকালেই মারা যান।কবির সাথেও মাধুরীলতার শ্বশুরবাড়িতে যথেষ্ট শীতল ব্যবহার করা হত।তাঁকে বাইরের ঘরে দীর্ঘক্ষণ কন্যার সাথে দেখা করার অনুমতির জন্য অপেক্ষারত থাকতে হতো। তারপর তিনি দেখা করার অনুমতি পেতেন আদরের কন্যা মাধুরীলতার সাথে।এই ঘটনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কবির লেখা দেনাপাওনা গল্পের মধ্য দিয়ে।
হৈমন্তী চরিত্রটি নিরুপমার থেকে একটু অন্যরকম। সে যথেষ্ট ব্যক্তিত্বের অধিকারী।সে ছোটবেলায় মাতৃহীনা হয়ে পিতার ছত্রছায়ায় বড় আদরে মানুষ হয়েছে।এই হৈমন্তী চরিত্রের মধ্যেও মাধুরীলতার চরিত্র ফুটে ওঠে।সুন্দরী হৈমন্তী তার বাবার পরম স্নেহ ভালোবাসায় পাহাড়ের কোলে মুক্ত পরিবেশে মানুষ হয়েছে।তার বাবা গৌরসুন্দর যেনো কবিরই প্রতিচ্ছবি।এখানে বাবা-কন্যার স্নেহ ও বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাঝে কবি ও কবিকন্যার সুমধুর সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়।
গৌরসুন্দর বাবু বিবাহের পণে টাকা না দিতে পারায় স্বামী অপু হৈমন্তীকে ভালোবাসারেও শ্বশুরালয়ে অবহেলার শিকার হয় তরুণী হৈমন্তী।গৌরসুন্দর বাবু সম্পর্কে অপুর বাবা-মার ধারনা ছিলো হৈমন্তীর বাবা ধনী ও বড়চাকুরে।কিন্তু সে যে মিছে ভাবনা, যার জন্য পাত্রপক্ষের কন্যার পিতার কাছে পণের টাকার চাহিদা ছিলো অনেক।
সে যে মিছে ভাবনা। হৈমন্তীর বাবা যে তাদের আশানুরূপ বড়লোক নন।এ বিষয় রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিলো।এর কারণ কবি গুরু জমিদার হলেও ঠাকুর বাড়ির সকল সম্পত্তি দিয়ে কবি তার প্রাণের প্রতিষ্ঠান শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন।আর তাঁর জন্য সামান্য অর্থই রেখে ছিলেন কবি। কবির মানস কন্যা হৈমন্তীর মত তাঁর নিজ কন্যা মাধুরীলতাও বড় হয়ে উঠেছিল শিলাইদহের সুন্দর মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে স্বাধীনভাবে।
নিরুপমার থেকে হৈমন্তী দৃঢ় স্বভাবের।সে সবকিছু হেসে উড়িয়ে দিলেও অপমানের কন্টক শয্যায় শায়িত থাকার ফলে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে।এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে এই প্রবল আত্মবিশ্বাসী নারী।
হৈমন্তীর জীবদ্দশায় সে প্রত্যাহিক নিপীড়নের থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।যা সম্ভব হয়েছিলো স্ত্রীপত্রের মৃনালের দ্বারা।স্ত্রীপত্রের মৃনাল বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সম্পদ।সে ছিলো অজপাড়াগাঁ থেকে আসা একটি সাধারণ মেয়ে—যার বাড়ি পূর্ববঙ্গের গ্রামে ।সে বাঙাল হওয়ায় তার রান্না করা বাঙাল খাবার নিয়ে তাকে শ্বশুরালয়ে অনেক কথা শুনতে হতো।এখানে কবি পত্নী মৃনালিনীর চরিত্র চিত্রায়িত হয়েছে কবির লেখনীতে।ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলে কবি পত্নী বাংলাদেশের মেয়ে বলে প্রায়ই তাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে।

জমিদার বাড়ির মেজবৌ মৃণাল ছিলো অপূর্ব সুন্দরী।সেটা তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ভুলে গেলেও এটা তারা ভুলতে পারেনি যে মৃনাল বুদ্ধমতী। মৃণাল ছিলো সহজ স্বাভাবিক বুদ্ধির অধিকারী।তাই সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই তাকে শ্বশুরবাড়িতে প্রতি পদে হেয়েও করার চেষ্টা চলতো।সে তার প্রতিবাদ স্বত্তাকে বজায় রেখে নিরাশ্রয় মেয়ে বিন্দুকে আশ্রয় দেয়।মৃণালের শ্বশুরালয়ের লোকেরা বিন্দুকে এক পাগলের সাথে বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়ায়।বিন্দু সেখান থেকে পালিয়ে এলে বাড়ির লোকের সাথে রীতি মত যুদ্ধ করে মৃণাল তাকে আশ্রয় দেয়।শেষপর্যন্ত অপমানিত,লাঞ্ছিত বিন্দু আত্মহত্যা করে ।নারীর অবস্থান যে কতটা দুর্হ এ সংসারে তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে মৃণাল। এক সময় সাংসারিক বন্দীদশা থেকে মুক্তির পথ বেছে নেয় মৃণাল পুরীর তীর্থক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।তৎকালীন বাঙালি ঘরের এক গৃহবধূর এহেন সাহসী পদক্ষেপ সত্যিই চমকপ্রদ ছিলো ।মৃণাল আত্মহত্যা করে নয় স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে চেয়েছে তীর্থক্ষেত্রের উদ্দেশ্য রওনা হয়ে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রক্ষ্ম।তিনি কোনদিনই বাল্যবিবাহ ও পৌত্তলিকতায় বিশ্বাস করতেন না।তাই জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে মূর্তি পূজার প্রচলন ছিলো না ।কবি জন্ম, মৃত,ঋতু,প্রকৃতি, সমাজ-মনন-চেতন নিয়ে কবিতা,গান, গীতিনাট্য সবকিছু রচনা করলেও বিজয়া নিয়ে তেমন কোন কবিতা,গান রচনা করেন নি।বিশ্বকবির চোখে নারীর যে রূপ ,বেদনা,অসহায়তা,যন্ত্রনা ধরা পড়েছে তা কবির কলমের দ্বারা বহুবার প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন ভাবে।
সালটা ১৯১০,এক শীতের দিনে রক্ষণশীল সমাজের যাবতীয় রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে রবি ঠাকুর বিধবা প্রতিমা দেবীর সাথে পুত্র রথীন্দ্রনাথের বিবাহ দিয়ে হৃদয়হীণ সমাজের অনুশাসন ভাঙার বার্তা দিলেন ৷১৯ শতকের নারীদের গৃহবন্দি জীবনের শিকল কেটে মহিলাদের মুক্ত আকাশ চিনিয়েছিলেন যে সব নারী, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই প্রথম সারিতে নাম থাকবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর,গুরুদেবের উদার মনষ্কতার ফলস্বরূপ।

কবির জীবনে অনেক আঘাত এসেছে বহুবার।অকালেই তাঁর জীবনণ থেকে চলে গিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় বৌঠান কাদম্বরীদেবী তারপর প্রিয়তমা পত্নী মৃণালিনীদেবী। সৌদামিনীর ফুটফুটে নাতনিকে দেখে মনে ধরেছিল কবিপত্নীর।তিনি সেইসময় নিজের ঘনিষ্ঠদের কাছে বলেছিলেন আমার ছোড়দিদি নাতনিকে সে আমায় দেবে,এই সুন্দর মেয়েটি হবে আমার পুত্রবধূ৷ অবশ্য রবীন্দ্রনাথ কিশোর পুত্রের সেইসময় বিয়ে দেবেন না জানিয়ে দিলেন।ফলে মাত্র এগারো বছরের প্রতিমার বিবাহ হল কুমুদিনীর ছোট নাতি নীলানাথের সাথে৷ গঙ্গায় সাঁতার কাটতে গিয়ে জলে ডুবে মারা গেলেন তাঁর স্বামী নীলানাথ৷শ্বশুরবাড়ি থেকে অপয়ার অপবাদ নিয়ে সেদিন বাপেরবাড়ি ফিরতে হয়েছিলো ছোট্ট প্রতিমাকে।
১১বছরের ছোট্ট প্রতিমা মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে সধবা থেকে বিধবা হয়ে দেখলো রক্ষণশীল সমাজের কঠোর ব্যাভিচারীঅনুশাসন ৷ সেদিনের সমাজ মাত্র ১১বছরের নাবালিকাকে বাধ্য করেছিল বিধবার কঠোর জীবনযাপন করতে।এরপর দেখতে দেখতে বেশ কয়েকবছর পার হয়ে গেলো।ওদিকে রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ বিদেশ থেকে কৃষিবিদ্যায় বড় ডিগ্রি অর্জন করে স্বদেশে ফিরে এলেন।তখন তিনি বিবাহযোগ্য সুপুরুষ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্ত্রীর ইচ্ছেকে বাস্তবায়িত করার জন্য সহধর্মিণী মৃণালিনী দেবীর ইচ্ছানুসারে প্রতিমাকে পুত্রবধূ করার প্রস্তাব দেন৷
রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে বাল্য বিধবা কিশোরী প্রতিমার জন্য তখন অনেকখানি স্নেহের পরশে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।কবি যেনো সেদিন অন্তর দিয়ে মানসচোখে দেখেছেন বিবেকহীন সমাজের চোরাস্রোতে জীবন্ত প্রতিমার বিসর্জনের দুর্বিষহ যন্ত্রনা।তাই তো
প্রতিমাকে নিজের পুত্রবধূ করার প্রস্তাব দিলেন প্রতিমার পিতৃগৃহে৷
একসময় সুসম্পন্ন হলো সেই বিধবা বিবাহ। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ প্রতিমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে আনন্দে উচ্ছল হয়ে চিঠি লিখলেন বন্ধু নগেন্দ্রকে’ ভাই নগেন,তোমাকে অনেকদিন লিখতে পারিনি কেন বোধহয় বুঝতে পারছ-বিয়ের গোলমালে ব্যস্ত ছিলুম৷আজ কী পরিপূর্ণ আনন্দ নিয়ে তোমায় লিখতে বসেছি৷প্রতিমা এখন আমার —সে আমার ঘরে এসেছে—সে কী চমৎকার মেয়ে তোমাকে কী করে লিখি৷আমি যদি তার গুণের বর্ননা করতে যাই তো সব কথা বিশ্বাস করবে না বা আমাকে Lunatic ভাববে’৷
রবীন্দ্রনাথ কোন এক সময় পুত্রবধূ সম্পর্কে লিখেছেন ‘বৌমা চলে গেলে দিনগুলি শ্রীহীন হয়ে পড়ে,ভালো লাগে না,তিনি থাকলেও দেখাশোনা বিশেষ হয় না,তবু তাঁর প্রভাব তা থাকে হাওয়ায়’৷ পুত্রবধূ হয়ে আসার পর প্রতিমা যখন যেখানে থেকেছেন,সে জোড়াসাঁকো হোক বা শিলাইদহ অথবা শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখাপড়ার জন্য সর্বদা উপযুক্ত ব্যবস্থা করেছেন৷বিয়ের অল্প কিছুদিন পরে যখন শান্তিনিকেতনে এসে থাকেন তখন তার ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়৷আবার তিনি যখন জোড়াসাঁকোয় এসে বসবাস শুরু করেছেন তখন তিনি বিশ্বকবির বাড়ির পারিবারিক গৃহবিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেছেন৷ রবীন্দ্রনাথের পরিবারের ইতিহাসে প্রতিমাদেবী এক বহুমুখী প্রতিভার নারী, রবীন্দ্রনাথের স্নেহে,অনুপ্রেরণায় যার বহুমুখী প্রতিভার বিকাশ হয়েছিল,তিনি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন সে’যুগের অনেক নারীর অনুপ্রেরণা৷ কবির জীবনের অনেকটা সময় প্রতিমা দেবী নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর সেবা করেছেন,সেই ভার তিনি নিয়েছিলেন স্বেচ্ছায় নিজের সংসার এবং শান্তিনিকেতনের আশ্রম দেখাশোনার ভার নিজের হাতে নিয়ে হয়ে প্রতিমা দেবী হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সের স্নেহময়ী অভিভাবিকা৷

ঠাকুর বাড়ির বধূ হয়ে আসার পর প্রতিমা দেবীর বহুমূখী প্রতিভার প্রকাশ হতে সময় লাগেনি৷ রবীন্দ্রনাথ তার ছদ্মনাম ঠিক করে দিয়েছিলেন।কল্পিতাদেবী ছদ্মনামে প্রবাসী পত্রিকাতে অনেক কবিতা লিখেছেন৷
কবির সাথে প্রতিমা দেবীর সম্পর্কে ছিল স্নেহমিশ্রিত সম্মানের অনবদ্য রসায়ন৷ ‘দ্বারিক’ তখন ছাত্রী আবাস৷ এক দিন অদ্ভুত খেয়াল চাপলো প্রতিমাদেবী, সুধীরাদেবীদের মাথায়৷যখন ‘দ্বারিকে’মেয়েরা ঘুমাচ্ছে, হঠাৎ সেখানে ‘ডাকাত’ পড়ল। ডাকাতের দল মেয়েদের অলঙ্কার নিয়ে টানাটানি করল। মেয়েদের চিৎকারে ছুটে এসেছেন আশপাশের সবাই। কিন্তু আশ্চর্য! শিক্ষক সন্তোষচন্দ্র মজুমদার সবাইকে বলতে লাগলেন, ‘কিছু না কিছু না, কিচ্ছু হয়নি।’কে শোনে তাঁর কথা!অবশেষে সন্তোষচন্দ্র কালি-মাখা কমলাদেবীকে এনে দেখালেন, সবই নকল ডাকাত। এর কিছু দিন পরে ভুবনডাঙায় জগদানন্দ রায়ের বাড়িতে আসল ডাকাত পড়েছিল৷ রবীন্দ্রনাথ পরের দিন প্রতিমাদেবীকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, – ‘বৌমা, তোমাদের দল নয় তো’! পুত্রবধূর সঙ্গে রবি ঠাকুরের এই রসিকতায় প্রমাণ হয় কেমন ছিল তাদের স্নেহ-সম্মানের সম্পর্কের কেমিস্ট্রি।

১৯১২-তে রবীন্দ্রনাথ যখন ইংল্যান্ড ও আমেরিকা যান,পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীও তাঁর বিদেশ যাত্রায় সঙ্গী হয়েছিলেন।বৃহত্তর পৃথিবী এইভাবে উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল প্রতিমা ঠাকুরের কাছে৷ শান্তিনিকেতনে ফিরে এসে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বহু নাটক অভিনয় করিয়েছেন। কেবলমাত্র মেয়েদের অভিনয়-উপযোগী নাটক লেখার অনুরোধ জানান কবিকে, এবং এইভাবে রচিত হয়েছিল ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’৷অভিনয় শেখানোর পাশাপাশি অভিনেতাদের সাজগোজ আর মঞ্চসজ্জার দায়িত্ব সামলাতেন৷ রবীন্দ্রনাথের জীবনের অন্তিম বছরের চমৎকার বিবরণ লিপিবদ্ধ প্রতিমা ঠাকুরের লেখা ‘নির্বাণ’গ্ৰন্থে।অবনীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের কথা আছে ‘স্মৃতিচিত্র’ বইয়ের পাতায়৷’নৃত্য’ বইয়ে প্রতিমা ঠাকুর লিখেছেন শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারার বিষয়৷ ‘চিত্রলেখা’ প্রতিমা দেবী রচিত কবিতা এবং কথিকার অনবদ্য সংকলন।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর নৃত্যনাট্যগুলোতে নৃত্যের সুচারু ব্যবহার, নৃত্য প্রয়োগের সম্ভাবনার কথা সম্ভবত ভাবেনই নি! প্রতিমা দেবীর কৃতিত্ব হল তিনিই প্রথম রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য সমূহের নিবিড় নৃত্যমুদ্রা উদ্ভাবন করে পরিবেশন করেছেন।আজ আমরা রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখে তার নান্দনিককতায় আপ্লুত হই, তার পেছনে অবশ্যই প্রতিমা ঠাকুরের রবীন্দ্রনৃত্যের প্রায়োগিক ভাবনা৷
কবিগুরুর চিন্তা চেতনার সৃষ্টিসুধা নারীর অধিকার,পাওয়ার না-পাওয়ার লড়াই, অধিকারবোধ,দৃঢ়চেতা দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কবির লেখনীর গুণের ও তাঁর প্রিয় পুত্রবধু প্রতিমাদেবীর নৃত্যশিল্পকলার মধ্য দিয়ে।
এইভাবেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত সকল নারী চরিত্রগুলি চেতনে,মননে,তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে জীবন্তভাবে বাস্তবতার অঙ্গনে বৈচিত্র্যময় ও বাঙময় হয়ে উঠেছে।
#highlightseveryonefollowers #allfolowers #highlight #everyone #AllFriends #copyright

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *