কিছু কথা। পর্ব -১০ । অন্তিম পর্ব। ছন্দা চট্টোপাধ্যায়। *** (সুভাষের কথা)
ধারাবাহিক উপন্যাসিকা।
কিছু কথা।
পর্ব -১০ । অন্তিম পর্ব।
ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
(সুভাষের কথা)
অঝোর বৃষ্টিধারায় ধুয়ে যাচ্ছে পথঘাট। বিপুল উৎসাহে জলস্রোত ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে গঙ্গার বুকে। জলেতে মিশায়ে জল গঙ্গা যেন ভালোবাসার আবেগে ফুলে উঠে ভাসিয়ে দিচ্ছে দু কুল।
দীপকে দাহ করে ফিরছি আমি আর কেকা। কেকার দিকে তাকাতে পারছি না আমি। কেকা আর দীপ যেন রবি ঠাকুরের হাসি আর তাতা। পাঁচ বছর বয়স থেকেই ছোট ভাইটিকে বুকে নিয়ে যেন অতি ছোট দিদিটি জননীর প্রতিনিধি। শ্মশানভূমিতে কিছুক্ষণ বসলেই নাকি বৈরাগ্য আসে!? আহ্, বৈরাগ্যের স্বরূপ দেখলাম তো নিজের চোখে।কি ভাবে চুল্লিতে ঢোকানোর পরেই ইলাদি আর মনোজদা আঙুল উঁচিয়ে ঘোষণা করে গেলো-‘সৌম্যদা,আমরা আমাদের বোনের এই বৈধব্য সহ্য করতে পারছিনা। শ্রীর আবার বিয়ে দেবো আমরা। বারাসাতের ঐ বাড়িতেই শ্রীর আবার ফুলশয্যা হবে। আর হ্যাঁ, আমার বোনকে এখান থেকেই আমাদের বাড়ি দিয়ে আসবেন।’- সিদ্ধান্ত অবশ্যই ভালো। কিন্তু শ্মশানভূমিতে? ঐটাই কী সঠিক জায়গা ছিল!নন্দা বৌদিও ইলার কাঁধে হাত রাখলো। আমার ঘেন্না করছিল। ছিঃ ছিঃ, এরা মানুষ? রাগে রি রি করছিলো আমার শরীর। হয়তো কিছু বলেই বসতাম, সামলে নিলাম কৌশিকের জন্য। কি অদ্ভুত বোবা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে ছিল চুল্লির দিকে। চুল্লির দরজা খুলে গেল। কৌশিক ডোমের সাহায্যে দীপের নাভি গঙ্গা মাটিতে দিয়ে সৌম্যদার হাত ধরে ভাসিয়ে দিলো জলে।ভেসে গেল একমুঠো পোড়া ছাইএর সাথে দীপের স্মৃতি। ভেসে গেল,ভেঙে গেলো ভাই-বোনেদের ভালোবাসা, আবেগ, অভিমান। কান্নায় ভেঙে পড়ে কেকা বলে -‘কোথায় চলে গেলি রে ভাই?’-
আকাশটা মেঘে ছেয়ে গেল।টিপ টিপ করে ঝরছিল বৃষ্টিটা।এখন আরো জোরে ঝেঁপে এলো, মহাপ্রলয়ের মতো। কৌশিক বললো -‘কেকা এবেলাটা অন্তত আমার বাড়ি বসবি চল্। বৃষ্টি থামলে যাস।’- না, কেকা বারাসাতের কোনো বাড়িতে পা রাখবে না। জোরে জোরে মাথা নেড়ে আপত্তি করলো কেকা। আমার হাত ধরে এগিয়ে চললো বাসস্ট্যান্ডের দিকে। আমি বুঝতে পারছিলাম অপলক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে এককালের নকসালকর্মী, রাঙাদির প্রাক্তন প্রেমিক শুধু নয়, সাচ্চা সমাজদরদী, আমাদের কমরেড কৌশিক। এমন করে ভালোবাসতে কজন পারে? এতো নিঃস্বার্থ মানুষ আমি কখনও দেখিনি।
এখন অনেকটা রাত হয়েছে। আমাদের বনগাঁয় এখন নিশুতি রাত বলা চলে। আমার বৃদ্ধা মা একমুঠো ভাতেভাত কেকার মুখে জোর করে গুঁজে দিয়ে গেছেন। ভাইহারা নিঃসন্তান কেকা গুঙিয়ে ওঠে -‘আমার ভাইকে ফিরিয়ে দাও ঠাকুর!’- আমি সযতনে জড়িয়ে ধরি আমার অবুঝ বৌটাকে। ডানাভাঙা পাখির মতো থরথরিয়ে কাঁপে খুকু। বাইরে কদম ফুলের উগ্র মধুর সুবাসকে সাথে করে কি এক সুখের উল্লাসে বৃত্তাকারে উড়তে থাকে শ্রাবণী হাওয়া।
আলিঙ্গনাবদ্ধ দম্পতি শুনতে পাই যেন -‘ আমি আসছি মিত্তিদিদি। তোর গর্ভকক্ষটা আমার জন্য উন্মুক্ত রাখ। সুভাষদা, প্লিজ হেল্প মি! ‘- স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে জড়িয়ে ধরি বড়ো যত্নে, বড়ো আশ্লেষে! শরীরে ফোটে শিহরিত কদম ফুল। একঝাঁক জোনাকি জ্বালায় ফুলশয্যার প্রদীপ। বাগান থেকে ভেসে আসছে সিক্ত যুঁথি, মল্লিকা, কামিনীর সুভাষ।রভসে গোঙাই আমরা ‘- ফিরে আয় দীপ!’-আকুল সে পবিত্র আহ্বান মিশে যায় কদমের গন্ধমাখা শাওন-বাতাসে। ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীর দুটি পরম আশায়, বিশ্বাসে মিলিমিশে যায়– দীপ আসছে ! দীপ আসছে।
(সমাপ্ত।)