# সীমান্ত # পর্ব – ১০ কলমে – অরণ্যানী
# সীমান্ত # পর্ব – ১০
কলমে – অরণ্যানী
কয়েকটি মেয়ে জমি থেকে ঝুড়িতে করে শাক তুলে নিয়ে ফিরছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ শাড়ি পরা, কেউ কেউ লম্বা ফ্রক পরা। মেঘ দাঁড়িয়ে ওদের দেখতে লাগলো। ওরা মেঘের কাছাকাছি চলে আসার পরও মেঘ ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। দু’একজন হেসে উঠলো। মেঘের খেয়াল হতে ওদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে এগিয়ে চললো। একটি শাড়ি পরা মেয়ে মেঘের সামনে এসে বললো – এখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছিলে গো? আমাদের?
মেঘ – না, আমি মাংস বিক্রি করতে এসেছি। কেউ কিনবে কিনা তাই।
মেয়েটি – তা বললেই হয়। চুপ করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছ কেন একভাবে?
অন্য মেয়েগুলি এসে বললো – এই ছাড়। ও জঙ্গলের মানুষ। এসব বোঝে না।
মেয়েটি – বোঝে না আবার, সব বোঝে। বলতে বলতে ওরা চলে গেল। মেঘ একটু সময় অপমানিত মুখে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। ওই পথ দিয়ে একজন মধ্য বয়স্ক লোক যাচ্ছিল। মেঘ তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল – মাংস কিনবে? ময়ূরের মাংস আছে। টাটকা, আজই মেরেছি।
লোকটি জিজ্ঞেস করলো –কী দরে দিচ্ছ? কতটা?
মেঘ – একটা ময়ূর। যা দাম হবে দেবে।
লোকটি অবাক হলো।
– তুমি কোথায় থাকো?
মেঘ জঙ্গলটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো – ওইদিকে।
– চলো আমার ঘরে। ঘর থেকে পয়সা এনে দিচ্ছি। মেঘ লোকটির সঙ্গে তার বাড়ির দিকে চললো। বাড়িতে এসে লোকটি ঘরে ঢুকে গেল। মেঘ উঠোনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পর লোকটির সঙ্গে পনেরো ষোলো বছরের ফ্রক পরা একটি মেয়ে বেরিয়ে এলো। মেঘ ময়ূরটা বের করে পিস করে কাটতে লাগলো। মেয়েটি একটি বাসনে মাংসগুলো নিল। মাংস কাটতে কাটতে মেঘ বার বার মেয়েটির দিকে দেখতে লাগলো। মেয়েটি অস্বস্তিতে চোখ সরিয়ে নিল।
মেয়েটি – বাবা, অনেকটাই মাংস হয়েছে। দু’বেলাই বেশ ভালো করে হয়ে যাবে।
বাবা – হ্যাঁ। মেঘকে বললো – চল্লিশ টাকা দিলে হবে?
মেঘ – হ্যাঁ হবে।
লোকটি মেঘের দিকে টাকা এগিয়ে দিল।
মেঘ – হাতটা ধোব। একটু জল।
মেয়েটি উঠোনে রাখা বালতি থেকে মগে করে জল নিয়ে মেঘকে দিল। মেঘ হাত আর ঝুলিটা ধুয়ে হাতের আঁচলা করে জল খেতে গেল।
মেয়েটি – এই জল নয়। খাবার জল আমি এনে দিচ্ছি। এটা পুকুর জল।
মেঘ – তাতে কী হয়েছে?
মেয়েটি – ওই জল কেউ খায় না।
বাবা – দুপুরবেলা জল দিচ্ছিস, ঘরে কোনো খাবার থাকলে দে।
মেঘ কিছুই বুঝল না। জল তো পরিষ্কারই ছিল। খাওয়া কেন গেল না! খাবার দেবে বলছে। মেঘ লোকটির কাছ থেকে টাকাটা নিল।
– দাওয়ায় বসো।
দাওয়ায় মাদুর পাতাই ছিল। লোকটি মেঘকে সেখানেই বসার ইঙ্গিত করলো। মেঘ মাদুরে বসে রইল। একটু পর মেয়েটি একটি পাত্রে করে ভিজানো চিড়ে গুড় নিয়ে এলো। আর সঙ্গে এক গ্লাস জল। মেঘের দিকে এগিয়ে দিল। মেঘ এ ধরণের খাবার আগে কোনদিন দেখেনি। তবে মনে হলো বেশ ভালোই বুঝি হবে। সাগ্রহে মেঘ মেয়েটির হাত থেকে খাবার নিল। মেয়েটি ওর পাশে জলের গ্লাসটা রেখে দিল। মেঘের খিদেও খুব পেয়েছিল। তৃষ্ণার কথা ভুলে ও প্রথমে খেতেই শুরু করল। মেয়েটি ও তার বাবা এবার অবাক হয়ে মেঘকে দেখতে থাকলো। খুব দ্রুত খাওয়া শেষ করে মেঘ জল পান করল। তারপর কিছু না বলেই শুধু মেয়েটির দিকে একবার তাকিয়ে দ্রুত পদে চলে গেল। ওরা মেঘের দিকে তাকিয়ে রইল।
বিকেলের রোদ তখনও পড়েনি। বেশ চড়া আছে। মেঘ এলো হাটে। নানারকম জিনিস বিক্রি হচ্ছে সেখানে। বেশ ভিড়ও আছে। গৃহস্থালির জিনিস, মাটির জিনিস হাঁড়ি কলসি, লোহার জিনিস, জামাকাপড়, সাজের জিনিস, খাবার দাবার ইত্যাদি কত কী! মেঘ এলো সাজের জিনিস যেখানে বিক্রি হচ্ছে সেখানে। মাটিতে একটা বড় মোটা চট বিছিয়ে তার উপর নানারকম সাজের জিনিস নিয়ে বসেছে এক মহিলা। চারপাশে অনেক মেয়েদের ভিড়। ফলে এতো মেয়েদের ভিড় ঠেলে মেঘ কিছুতেই সেখানে যেতে পারছে না। মেয়েগুলোর পেছন থেকে শুধু উঁকি দিয়ে ভীষণ উৎসাহী দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করছে কী কী আছে। যে মহিলাটি বিক্রি করছিল, তার নজর পড়ল মেঘের দিকে।
মহিলা – এই ভাই, এদিকে এসো, এদিকে। বলে নিজের পাশে ডাকল। তখন অন্য মেয়েগুলিরও চোখ পড়ল মেঘের দিকে। মেয়েগুলো কৌতুহলী চোখে চেয়ে রইল। কারণ এখানে শুধু মেয়েরাই আছে। মেঘ মহিলাটির পাশে এলো।
মহিলা – কী লাগবে তোমার?
মেঘ কাঁচের চুড়িগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো – ওই যে।
মহিলাটি নানান কাঁচের চুড়ি বের করে ওকে দেখাল। মেঘ বিহ্বল হয়ে গেল। কী কিনবে, কতগুলো কিনবে, বুঝতে পারল না। দেখল চুড়ি ছাড়াও বালা আছে, টিপ টিপ ফিতে – – –
এবার মহিলাটি কিছু বুঝে ওকে জিজ্ঞেস করল –কী কী কিনবে?
মেঘ – কিনব তো অনেক কিছুই।
মহিলা – তবু বলো কী কী চাই, আর কত টাকার জিনিস কিনবে? সেই বুঝে আমি দেবো।
মেঘ – কাঁচের চুড়ি, বালা, টিপ, ফিতে। চল্লিশ টাকা আছে। হবে?
মহিলা – হ্যাঁ হবে। আমি দিচ্ছি। মহিলাটি কিছু রঙিন কাঁচের চুড়ি, বালা, টিপ, ফিতে, একটা চুড়ির বাক্সে ভরে মেঘের দিকে এগিয়ে দিল। মেঘ চল্লিশ টাকা দিয়ে বাক্সটা হাতে নিয়ে হাট থেকে বেরিয়ে এলো। তখন বিকেলের রোদ পড়তে শুরু করেছে। কোনো দিকে না তাকিয়ে মেঘ খুব দ্রুত জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল।
মেঘের সীমান্ত পার হওয়া :-
হাট থেকে ফিরে মেঘ আবার তার চির পরিচিত জঙ্গলে প্রবেশ করল। তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। চারপাশে তাকিয়ে বোঝা যায় এখন এ জঙ্গল খুব নিরাপদ নয়। যথারীতি মেঘ গাছের উপর উঠে গেল। হাট থেকে কেনা সাজের বাক্সটা ঝুলি থেকে বের করে ভেতরের জিনিসগুলো দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। ফলে দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করে আবারও ঝুলির ভেতর সেটা ঢুকিয়ে রাখল। বাক্সের সাজের জিনিসগুলো কেনার সময় সে দু’চোখ ভরে অনেকক্ষণ ধরেই দেখে নিয়েছিল। তাই এমনিই তার মনে পড়তে লাগল কেনা চুড়ি, বালা, টিপ, ফিতে, এগুলোর কথা। চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই মেয়েটির চেহারা, যার বাবার কাছে সে ময়ূরের মাংস বিক্রি করেছিল। মনে পড়ল মেয়েটির দেওয়া চিরে গুড়ের স্বাদ। আবার মনে পড়ল সেই ক্ষেতের ধারে ঝগড়া করা মেয়েটির কথা, কখনো তাদের দলের ফুলির কথা।
দুপুরের পর থেকে আর কিছু খাওয়া হয়নি মেঘের। তবে খিদে বোধও হলো না। গাছের ডালে একটানা এতক্ষণ বসে থাকতে অস্বস্তি বোধ হতে থাকলো। বুঝতে পারল এভাবে গাছের ডালে রোজ রোজ সন্ধে থেকে সকাল পর্যন্ত কাটানো সম্ভব নয়। জঙ্গলে শিয়াল ও অন্য জন্তুর ডাক শোনা গেল। কিন্তু মেঘের কানে তা পৌঁছল কিনা কে জানে। গাছের নিচ দিয়ে কত জন্তু অন্ধকারে চলাচল করছে। মেঘ অন্যমনস্ক। তার চোখের সামনে ভাসছে বাঁশের মাচার উপর ছোট্ট একটি ঘর। যা তার এখন বিশেষ প্রয়োজন। আবারও মনে পড়ল হাট থেকে কেনা সাজের জিনিসগুলোর কথা। তারপর? সেই জঙ্গলের শেষ প্রান্ত, যেখানে শত শত সেনারা পাহারা দিচ্ছে দেশের সীমান্ত। ভাবতে ভাবতে চোখে ঘুম চলে এলো। গাছ থেকে ঘুমের মধ্যে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় বার বারই চমকে উঠতে থাকল। গাছের নিচ দিয়ে খসখস শব্দ করে কোনো বড় জন্তু চলে গেল। মেঘের চোখ থেকে ঘুম গেল উড়ে। সতর্ক হয়ে গাছের ডালে বসে রইল। প্রতীক্ষায় রইল ভোর হওয়ার জন্য।
অবশেষে একসময় রাত শেষ হয়ে ভোরের আলো ফুটল। মেঘ চোখ মেলে চেয়ে রইল জঙ্গলের দিকে। আলো আর একটু স্পষ্ট হতেই তীর-ধনুক হাতে কাঁধে ঝুলি নিয়ে চলা শুরু করল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দ্রুত হেঁটে চলল। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে সতর্ক চোখে চারপাশ দেখে নিতে থাকল। ভোরের আকাশ তখন লাল। চারিদিকে পাখির কলোরব। মেঘ যখন হেঁটে যাচ্ছিল, তখন ওর সামনে দিয়ে কখনো খরগোশ, কখনো সম্মর ছুটে পালিয়ে গেল। আজ আর সেগুলো মেঘের দৃষ্টিতে পড়ল না। ধীরে ধীরে রোদ উঠল। মেঘ তখনও চলতে থাকল। রোদ একসময় চড়া হলো। মেঘের চলা আরও দ্রুত হতে থাকল। একসময় সে নদীর তীরে এসে জল পান করল। তারপর আবারও চলা শুরু। একসময় এসে পৌঁছল জঙ্গলের শেষ সীমায়। তার সেই পরিচিত শালগাছটার নিচে বসে দেখতে লাগলো সেনাদের পাহারা দেওয়া। পায়ে হেঁটেও সেনারা পাহারা দিচ্ছে, আবার কিছুক্ষণ পর পর সেনাদের গাড়িও টহল দিচ্ছে। একটু পর উঠে দাঁড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করল সীমান্তের ওপার। গাছপালা আর জঙ্গল ছাড়া কিছুই দেখা গেল না। আবার বসে পড়ে ঝুলি থেকে বাক্সটা বের করে উৎসাহিত চোখে দেখতে থাকল কালকে হাট থেকে কেনা সাজের জিনিসগুলি। বাক্স বন্ধ করে আবারও ওগুলো ঝুলিতে ঢোকাল। একসময় বিকেল হলো। বিকেলের রোদও একসময় পড়ে এলো। মেঘ ওভাবেই গাছের নিচে বসে সীমান্তের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে। সন্ধের অন্ধকার নামল। অগত্যা তাকে আশ্রয়ের জন্য শালগাছটার উপর উঠে যেতে হল।
সীমান্তের উপর পড়তে থাকল সেনাদের সার্চ লাইট। ঝলমল করছে সেই আলো। অবাক চোখে গাছের উপর থেকে মেঘ লক্ষ্য করল। রাতের অন্ধকারেও আলো জ্বেলে ওরা পাহারা দিচ্ছে সীমান্ত! পাহারা যেন আরও সতর্ক হলো। ঘন ঘন সেনাদের গাড়ি যাওয়া আসা করতে লাগলো। এতো আলোর মধ্যে এদিকে জন্তু খুব একটা আসছে না বুঝে মেঘ গাছ থেকে নামল। কিন্তু হতাশ চোখে বসে সেনাদের পাহারা দেখতে লাগলো। চোখে তার ঘুম এলো না।
হঠাৎই একসময় গুলিগোলার আওয়াজে সীমান্ত কেঁপে উঠল। মেঘ কিছু বোঝার আগেই দেখল, সীমান্তের অনেক সেনাই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। শিকার করা জন্তুর মতোই তারা রক্তাক্ত। কেউবা ছটফট করছে যন্ত্রণায়। একটু পর আবার কারা এলো। গোলাগুলি চললো দু’দলে। মেঘ বুঝল গোলাগুলি ওর গায়েও এসে লাগতে পারে। তাই জঙ্গলের একটু ভেতরে এসে একটা গাছের উপর থেকে যুদ্ধ দেখতে লাগলো। একসময় মনে হলো, সীমান্তটা যেন কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এক লাফে গাছ থেকে নেমে একটু কাছে এগিয়ে গেল। দেখল সীমান্তে পাহারা নেই। আর কিছু না ভেবে ওপারের দিকে দিল এক ছুট। কিন্তু ওপারের জঙ্গলে ঢোকার মুখে আবারও গর্জে উঠল গুলির আওয়াজ। ও দেখল, ওর আশপাশে কী যেন এসে পড়ছে। বুঝল গুলি। কিছু ভাবার সময় নেই। আত্মরক্ষার জন্য প্রাণপণে এঁকে বেঁকে বেগে ছুটে গভীর জঙ্গলে ঢুকে গেল। আর কোথাও কাউকে দেখা গেল না। দূরে সীমান্তের দিক থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে এলো। মেঘ জঙ্গলের আরও ভেতরে চলে এলো। তারপর একটা বড় গাছের উঁচু ডালে যথারীতি আশ্রয় নিল।
একসময় জঙ্গল নিস্তব্ধ হলো। ধীরে ধীরে জন্তুদের চলাফেরা সাবলীল হলো। গাছের উপর বসে অদ্ভুত উত্তেজনায় মেঘের রাত কাটতে লাগলো।
(ক্রমশ)