** পুরোটাই ব্যাক্তিগত ** #নীলবৃষ্টি
** পুরোটাই ব্যাক্তিগত **
#নীলবৃষ্টি
আমার সামনে যে মহিলাটি বসে আছেন তিনি বেশ সুদর্শনা অন্তত এই কিছুক্ষণ আগে অবধি আমি তাইই ভেবেই আমার এই ট্রেন সফরটিতে তাকে বেশ প্রাধান্য দিয়েই চলছিলাম , আমি একটি বড় সরকারি পদে চাকরি করি এতো অল্প বয়সেই এই পদে আসীন হয়েছি বলে নিজের মনে মনে বেশ একটা প্রচ্ছন্ন অহংকার বোধ আছে , মা ,বাবা থেকে আরম্ভ করে সকল আত্মীয়স্বজন , বন্ধু বান্ধব যখন তাদের অপদার্থ ছেলে মেয়ের সাথে আমার পদ মর্যাদা , সাফল্য নিয়ে আলোচনা করে তখন আমি মনে মনে এক সুপ্ত তৃপ্তি লাভ করি সে আমার যত কাছের লোকই হোক না কেন সে , তার ব্যার্থতা তার অর্কমণ্যতা আমাকে অনেক উঁচুতে তুলে দেয় , আমি সেই উঁচু জায়গাটি থেকে সেই ব্যার্থ মানুষ টকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি তার লজ্জা , তার সংকোচ , তার বেদনা আমাকে বেশ আনন্দ দেয় অবশ্য মুখে আমি সেসব দেখাইনা , এমন ভাব করি যেনো তার দুঃখে আমিও খুবই ব্যাথিত!! যাইহোক আজ অফিসের কাজে হুট করেই দিল্লী যেতে হচ্ছে ফ্লাইট এর টিকিট না পেয়ে অগত্যা ট্রেন ভ্রমণ !! আমার সামনে যে মেয়েটি (মেয়েটি বলবোনা) মহিলা বলাই ভালো বয়স আমার থেকে বড় বই ছোটো হবেনা তবু অতন্ত্য রুচিশীলা এবং সুন্দরী তিনি যাতে তার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারাযায়না !! সত্যি বলতে কি আমার বেশ ভালো লাগছিলো মহিলাকে, উনি পেশায় ডাক্তার , উনিও কোনো কাজে বাইরে যাচ্ছেন! কথাবার্তায় সুরুচির ভাব , যেটুকু কথা বলেছি তাতে মনে হয়েছে উনি বিবাহিতা নন হলে একবার অনন্ত বলতেন তাই ওনাকে নিয়ে মনে মনে অনেকদুরই প্রসারিত করছিলাম নিজের চিন্তাভাবনা !! ঠিক করলাম একটু পরে নিজেই যেচে জিজ্ঞেস করবো উনি বিবাহিত কিনা !! আমার রুচি ও চিন্তাভাবনা র সাথে ওনার রুচি ও চিন্তাভাবনার অদ্ভুত রকম মিল রয়েছে !! যার ফলে আমি মানসিক ভাবে অতন্ত্য আশাবাদী হয়ে উঠছি ক্রমশ ওনার প্রতি , আমি সাধারণ কথাবার্তা থেকে ক্রমশ গভীর কথা বার্তায় প্রবেশ করছি তাতেও উনি বেশ উপভোগ করছেন এবং সপ্রতিভ ভাবে উত্তর দিচ্ছেন প্রতিটা কথার !! যার ফলে আমার মন ওনার প্রতি ভীষণ ভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে !! এইভাবে অনেকটা সময় কেটে যাবার পর রাত হয়ে এলো , এতোক্ষণ বাক্যালাপে জানতে পেরেছি ওনার নাম সুচরিতা মুখার্জি ,আমরা কুলীন কায়স্থ হলেও উনি জাতে আমাদের থেকে উঁচুতে , বাড়ি কলকাতার ভবানীপুর এলাকায় , অফিস সংক্রান্ত ও কিছু ব্যাক্তিগত কাজে উনি দিল্লী যাচ্ছেন। বাড়িতে মা ,বাবা ও এক বোন আছে… মন টা বেশ খুশী লাগছে যে উনি তাহলে বিবাহিতা নন , ভদ্রমহিলা শোয়ার তোড়জোড় করছেন আমিও হেল্প করছি ওনাকে যথাসাধ্য হঠাৎ ট্রেন টি আচমকা ব্রেক কসে দাঁড়িয়ে পড়লো !! ঘটনাটি এতো দ্রুত ভাবে ঘটে গেলো অনেকের জিনিষপত্র সমেত তারাও মাটিতে পড়ে গেছেন !! শোনা গেলো লাইনে নাকি গরু বা কোনো গবাদি পশু এসে গিয়েছিলো !! তবে ট্রেন টি কম স্পিডে ছিলো বলে এ যাত্রা রক্ষা পেয়েছে নইলে কাটা পড়তো !! এদিকে ভদ্রমহিলা টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেছেন !! আমি তাকে তোলার জন্য ব্যাস্ত হতেই চোখে পড়লো ভদ্রমহিলার ডান পা টি ষ্টিলের রড বসানো জুতো সমেত হাঁটুর নিচ থেকে !! ভদ্রমহিলা অপ্রস্তুত !! উঠে বসে তিনি পেছন ফিরে পাটি ঠিক করে লাগাতে লাগলেন !!আমার মাথা ঘুরছে ছি ছি কি ভাবছিলাম আর কি বেড়োলো !! অদ্ভুত এক রাগ হচ্ছিলো মনে মনে !! সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম ওনার থেকে , খুব অল্প কথা ছাড়া আর কিছুই বলছিলাম না ! ভদ্রমহিলা বেশ অবাক হচ্ছিলেন বুঝতে পারছিলাম কিন্তু কিজানি ওনার প্রতি আমার আর কোনো মোহ ছিলোনা !! উনিও আস্তে আস্তে চুপ করে গেলেন !! আধো ঘুম আধো জাগা অবস্থায় সারা রাত এক বিষন্নতা কাটিয়ে সকালে ট্রেন গন্তব্যেস্থলে পৌঁছে গেলো !! ভদ্রমহিলা কে বিদায় টুকুও না জানিয়ে নেমে গেলাম ট্রেন থেকে !! মনে মনে নিজেকে ধন্যবাদ দিলাম নইলে এই ল্যাঙড়া খোঁড়া নিয়ে জীবন কাটাতে হতো !! উফ !! সত্যি ভগবান রক্ষা করেছেন!!
এই ঘটনার প্রায় পনেরো বছর পর আজো আমি দিল্লী যাচ্ছি নিজের পরিবার কে নিয়ে , আমার একমাত্র সন্তান আমার প্রান আমার মেয়ে সে লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত!! আমার শেষ ভরসা ডাক্তার চৌবে , শুনেছি উনি ভগবান , বহু র্যগীকে উনি বাঁচিয়েছেন মৃত্যুর হাত থেকে!! এই পনেরো বছরে আমি অনেক কিছু হারিয়েছি !! বিয়ে হয়েছে খুব সাধারণ পরিবারেই আমি উচ্চ পদে ছিলাম বলে বিশাল কিছু প্রাপ্তি ঘটেনি আমার !! একটি মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম সে আমার সাথে প্রেম প্রেম খেলে আট লাখ টাকার চুনা লাগিয়ে ভেগে পড়েছে সেই ভয়ে আর ওসবে যায়নি , বাবা, মা এই মেয়েকে পছন্দ করে ঘরে এনেছে , আমার বৌ শিক্ষিত ওই পর্যন্তই সেই শিক্ষা সে কোথাও না লাগিয়ে বাড়ির রান্নাঘরে লাগিয়েছে, সারাদিন রান্নাবান্না করেই সে খুশী থাকে , তার বাড়ির লোক তার রান্নার প্রশংসা করলেই সে অস্কার পাওয়ার মতো আবভাব করে , তার নিজের পরিবার কে খুশী দেখতেই সে ভালোবাসে এর বেশী কিছুতেই তার চাহিদা নেই !! তার সাথে আর যাইহোক প্রেম করা যায়না তাই করিও না স্বামীর মতোই থাকি এরপর আমাদের মেয়ে হয় ।মেয়েকে নিয়েই আমার দিন কাটে !! পুতুলের মতো একটা মেয়ে!! তারজন্যেই আমার সবকিছু ,তার জন্য সব ভালো ভালো করতে গিয়ে আমি অফিসেই প্রায় বন্দি করে ফেলেছি নিজেকে , যাতে মেয়ের কোনো অসুবিধে না হয় !! বাড়ি ফিরেই মেয়েকে নিয়েই কাটাই ,উইকএণ্ডে বেড়াতে যাই তাকে নিয়ে এরমই এক উইকএণ্ডে বেড়াতে গিয়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি !! স্ট্রোক হয় আমার , বহু খরচপাতি করে বেঁচে ফিরে আসি , ডান পা টি অসার হয়ে যায় মাঝে মধ্যেই না না ব্যায়াম ও থেরাপি করে এখন ভালো আছি তবে অফিস আমাকে আর সেই দায়িত্বশীল পদে রাখেনি !!ভলেন্টারি রিটারমেন্ট নিয়ে নিয়েছি এখন ঘরে বসে অল্প স্বল্প কনসালটেন্সি করেই দিন কাটে ,বাবা , মা গত হয়েছে!! এরমধ্যে মেয়ের এই অবস্থা!! মেয়েকে নিয়ে পৌঁছলাম যথারীতি যথাসময়ে!! চিকিৎসা আরম্ভ হলো , ডাক্তার চৌবে বললেন , মিঃ ঘোষ আমি যা করার করবো তবে আমি আর একজন ডাক্তার কে এখানে ডাকবো যদি কেউ পারে উনিই পারবেন নইলে আর কিছু করার নেই!! আমি সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ বলে দিলাম !! দরকার পড়লে বাড়ি বিক্রি করে দেবো আমি , আমার যা সম্পত্তি আছে সব সব বিক্রি করে দেবো কিন্তু আমার মেয়ে যেনো!! মাত্র বারো বছর বয়স তার !!কিন্তু ভাগ্যবিধাতা সুপ্রসন্ন নন বুঝলাম ডাক্তার চৌবে জানালেন যাকে তিনি রেফার করেছেন এখন তার আসা একটু অসুবিধে আছে তিনি একটু ব্যাস্ত আছেন অন্য জায়গায় দু মাস পর উনি ফ্রি হবেন!! আমি হাতজোড় করে কাকুতিমিনতি করলাম !! ডাক্তার চৌবে বললেন এক কাজ করুন আপনি নিজে একবার গিয়ে তার সাথে দেখা করুন দেখুন যদি কাজ হয় , আমি পাগলের মতো ছুটলাম সেই ডাক্তারের বাড়িতে , বেশ পস এড়িয়াতে ওনার বাড়ি , ভদ্রলোক এলেন কিছুক্ষণ পর , আমার সমস্ত কথা শুনেও উনি কিছু রিয়াক্ট করলেন না!! হঠাৎ চা নিয়ে যিনি এলেন তিনি সেই ই পনেরো বছর আগের আমার ট্রেনের সঙ্গী সেই মহিলা!! মানে সুচরিতা মুখার্জি !! আমি লজ্জায় অনুতাপে কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না শুধু হাতজোড় করেছিলাম দু চোখ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিলো এক হেরে যাওয়া পিতার কান্নার জল !! ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে তারপর তার হাজব্যাণ্ড কে ডেকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে কিছু বললেন , এরপর ভদ্রলোক এসে আমার হাত ধরে বললেন ,” ছি ছি আগে বলবেন তো আপনি আমার মিসেসের ফ্রেন্ড হোন !! আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আপনার মেয়ে ভালো হয়ে যাবে , আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি যান!!” কি বলবো ভেবে না পেয়ে আস্তে আস্তে বাড়ির বাইরের দিকে পা বাড়ালাম ঠিক সেই সময় কেউ ডাকলো পেছন থেকে,” শুনুন দাঁড়ান একটু!” পেছন ফিরে দেখি সেই ভদ্রমহিলা !! লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলাম উনি সামনে এসে বললেন ,” এই নিন ধরুন সেদিন ট্রেনে আমি পড়ে গিয়েছিলাম আর আপনার এই জিনিষ টিও পড়ে গিয়েছিলো অবশ্য এটি আমি আপনি নেমে যাবার পরই পাই সেই থেকে গচ্ছিত ছিলো আমার কাছে!! এড্রেস ছিলোনা তাই পাঠাতে পারিনি , দেখলাম আমার পার্স টি সত্যি সেদিন ট্রেন থেকে নেমে পাইনি ওটি ভেবেছিলাম ইনিই সরিয়েছেন!! ছি ছি কি ছোটো মন ছিলো আমার !! আর আজ মেয়ের জীবন ভিক্ষা চাইতে এসেছি এরই দরজায়!! ভদ্রমহিলা বললেন ,” জানেন আমি সেদিন দিল্লী আসছিলাম আমারই বরের কাছে কলকাতায় প্র্যাকটিস করার ফলে তখন বাবা মার কাছেই থাকতাম আর উনি দিল্লীতে !! আমাদের কোনো সন্তান হয়নি দত্তক নিয়েছিলাম এক পুত্র সন্তান কে সেও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে লিউকোমিয়ায় !! সেই খবর পেয়েই দিল্লীতে ফিরছিলাম , বুকের ভেতর ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছিলাম বার বার কিন্তু আপনার কথা, আপনার ব্যাবহার আমাকে প্রাণশক্তি যোগাচ্ছিলো বারংবার!! নিজে ছোটোবেলায় এক দূর্ঘটনায় পা সমেৎ বাবা মাকে হারাই !! কাকার কাছে মানুষ হয়েছি, কাকা বলতেন নিজের সুখ ছাড়া কিছু বিলোবেনা কারণ দুঃখ তোমার ব্যাক্তিগত তাই সন্তান হারানোর শোকও শেয়ার করিনি আপনাকে!! আমি জানি সন্তান হারানো কি ভয়ানক তা ই সেই থেকে আমরা স্বামী স্ত্রী এক যোগে কাজ করে যাচ্ছি যাতে আর কেউ কখনো সন্তান কে না হারায়!!” আমার ক্ষমা চাওয়ারো মুখ নেই তবু তাকে হাতজোড় করে প্রণাম করে হাঁটা দিলাম বাইরের পথে এরম কত ব্যাক্তিগত ই না আছে সবার কাছে অথচ সেগুলো না জেনেই আমরা মিথ্যে অহং বোধে মানুষ কে বিচার করে চলি !! নিজেকে এক অদ্ভুত অহংকারে মুড়ে রাখি !! ঈশ্বর আজ তাই যোগ্য শাস্তিই দিয়েছে আমার মতো লোককে !! বিকেলের রোদ পড়ে আসছে আমি আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছি বাস ধরবো বলে নিজের গন্তব্য এ ধীর গতিতে …
স্বত্ব সংরক্ষিত