ধারাবাহিক উপন্যাসিকা। কিছু কথা। পর্ব-৯
ধারাবাহিক উপন্যাসিকা।
কিছু কথা।
পর্ব-৯ ।
তাপস,রঘু, ভীমু , পার্থদের কথা।
তাপস শুধু কেঁদেই যাচ্ছে -‘কেন এভাবে চলে গেলি দীপ? আমাদের আট নম্বরের ক্লাবঘরটা যে ফাঁকা হয়ে গেল! কতো দুষ্টু বুদ্ধি ছিল তোর মাথায়! মনে পড়ছে, একবার রঘুর সঙ্গে তোর ঝগড়া, থম্বো রঘু। আমাদের দুজন রঘু। লম্বা চওড়া থামের মতো চেহারা। আমরা বলতাম থম্বো রঘু। রোগা পাতলা ছোটখাটো রঘুর নাম দিলি তুই লেচি রঘু। তা থম্বোর সঙ্গে তোর ঝগড়ায় মাথাগরম থম্বো তোকে জাস্ট দুহাতে মাথার ওপর তুলে ধাঁই করে মাটিতে আছড়ে ফেলে দিয়েছিল। বলেছিলো -‘চ্যালেঞ্জ নিবিনা শালা।’- তুই শান্ত ভাবে ভক্তিভরে থম্বোর পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে,জিভে আঙুল ঠেকিয়ে চাটার ভান করে বলেছিলি -‘এই মূহুর্তে চ্যালেঞ্জ নিচ্ছি না রে গুরু । তুই গায়ের জোরে জিতে গেলি, আমি বুদ্ধির জোরে তোকে একদিন হারাবোই। ‘- থম্বো হাসতে হাসতে বলেছিলো, -‘পেন্নাম করলি, আয় বুকে আয়’- বলে সবলে জাপটে ধরেছিল। তোতলা লেচি তুতলে তুতলে বলেছিল -‘ থথথমবো, দীঈঈপ লোওওহার ভীঈম নয়। ম ম মরে যাআবে তো!’- আমরা হৈ হৈ করে হেসে উঠেছিলাম। এমন আমাদের রোজ হতো। রোজ ঝগড়া, রোজ হাতাহাতি, রোজ ভাব। কেউ কাউকে না দেখে থাকতে পারতাম না। সকলেরই চাকরি, ব্যবসা, সংসার আছে। তবু রাত আটটার সময় ক্লাবে এসে তাস ক্যারাম পেটানো চাই। থম্বো রঘু বললো -‘ মনে আছে তাপস, ব্যাটা বজ্জাতটা কি ভাবে আমাকে নাকাল করেছিল?’- পার্থ বললো মনে নেই আবার ! তোর গোদা টিভিটার পেছনে কি সব গ্যাঁড়াকল করে তোর সঙ্গেই রিকশা করে স্টেশনের পাশে মেকানিককে সারাতে দিয়ে এলো। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছিলো। পরের দিন ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের খেলা। রঘুদের বিরাট হল ঘরেই টিভি। সব বন্ধুরা ওখানেই টিভি দেখি। মেকানিক বলেছিল -‘কাল দুপুরে নিয়ে যাবেন।’- পরেরদিন আকাশ ফুটো করে বৃষ্টি নামলো। গোঁয়ার থম্বো রঘু বৃষ্টি মাথায় করে টিভি আনতে গেল। যথারীতি রিকশা পেলোনা । মেকানিক বললো -‘টিভির পেছনে একটা পার্ট নড়ে গিয়েছিল। মনে হয় কেউ ইচ্ছে করে রগড় করেছে। ‘- পার্থ বললো -‘ভাগ্যিস রঘুর গায়ে খুব জোর। মেকানিককে বলে মোটা ত্রিপল দিয়ে টিভিটা জড়িয়ে মাথায় করে বাড়ির দিকে রওনা হলো। পথেই দীপুর বাড়ি। রাস্তায় হাঁটুজল। দীপু বেরিয়ে এসে রঘুর দুই গালে দুই চড় বসিয়ে বললো -‘ ছয়মাস আগে চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করেছিলাম, মনে আছে তো!’- রঘুর মাথায় দামড়া টিভি। দুহাত জোড়া।যাকে বলে বেঁধে মার খাওয়া।বললো -‘ টিভি দেখতে আসবি তো? নাকি ঘরে বৌএর আঁচলের তলায় বসে ম্যাচ দেখবি?’- দীপু বললো মারবি তো! তবু যাবো।’- লেচি বলে উঠলো -‘কি আশ্চর্য কাণ্ড হয়েছিল বল্ ? দীপু ঢুকতেই থম্বো দীপের পায়ের ধুলো মাথায় নিয়ে জিভে আঙুল ঠেকিয়ে চাটার ভান করে বললো -‘আশীব্বাদ দাও গুরু!’- দীপ গান গেয়ে উঠেছিল -‘পাঙ্গা নিবিনা শালা’- ‘- এখন ব্যাটাচ্ছেলে কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে দ্যাখ। ‘- বন্ধুরা দীপের মৃতদেহের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়লো। -‘ ওঠ্ না রে দীপ! ওঠ্ বলছি। ইয়ার্কি ভাল্লাগে না।’-
পার্থর কথা।
আজ আমরা বন্ধুরা মিলে দীপের প্রাণহীন দেহটাকে নিয়ে এলাম। সৌম্যদা, বৌদি ,শ্রীলা গাড়িতে আসছে। এখনই এসে পড়বে। রাঙাদি, মিষ্টিদিরাও আসবে। আমরা দীপকে ওর ঘরে ফুল দিয়ে সাজিয়ে ওরই খাটে শুইয়ে রেখেছি। ওর গৌরবর্ণ শরীরটা খাটের ওপর ফুলের মালা পড়ে রাজকীয় ভঙ্গিমায় শুয়ে আছে। যেন ফুলশয্যায় নতুন বর। নতুন করে ফুলশয্যায় তো! পরাণের সাথে মরণ খেলার ফুলশয্যা!!ঠোঁটের কোণে একফালি চাঁদের মতো মায়াবী হাসি। যেন বলছে -‘ কেমন ফাঁকি দিলাম।’- কী করে ফাঁকি দিলিরে দীপ? আমরা সব বন্ধুরা রক্ত দিলাম। তবু তুই চলে গেলি? বেইমান কোথাকার!
বাইরে স্বর্গরথ এসে দাঁড়ালো। সৌম্যদা, বৌদি, শ্রীলা, ইলাদি রাঙাদি, মনোজদা সবাই এসে ঘরে ঢুকলো। কিন্তু মিষ্টিদি সুভাষদা কই? শ্রীলা ঝাঁপিয়ে পড়লো দীপের বুকের ওপর।সদ্য স্বামীহারা স্ত্রীর বাহুবন্ধন থেকে তার স্বামীর নশ্বর দেহ ছিনিয়ে নেওয়া যে কি অমানবিক কাজ তা আমরা উপলব্ধি করেছিলাম। এমন সময়ে এসে পৌঁছালো খুকুদি ও সুভাষদা। সেই সময়েই ঘটলো এক নিষ্ঠুর ঘটনা। ঘরের দরজায় খুকুদিকে আটকালো বৌদি, সৌম্যদার বৌ। -‘এ ঘরে তুই ঢুকতে চাস কোন্ আক্কেলে? ভাই মরতে না মরতে বাপের বাড়ির দখল নিতে এসেছিস? ছিঃ, লজ্জা করেনা?’- খুকুদির আকুল আবেদন-‘ একবার আমাকে ভাইয়ের কাছে যেতে দাও বৌদি!’- আমি ভাইকে দেখেই চলে যাবো।’- এই প্রথম ভালোমানুষ সুভাষদাকে গর্জে উঠতে দেখলাম।-‘ কাকে ছিঃ করছেন? ছিঃ, ধিক্কার আপনাদের জন্য। চলে এসো কেকা। আমরা শ্মশানঘাটে গিয়ে ভাইকে দেখবো।’- আমরা বন্ধুরা দীপকে ধরাধরি করে বাইরের স্বর্গরথে তুললাম। চিরদিনের বন্ধু আমরা দীপের শ্মশানবন্ধুও হলাম। বৌদি আর ইলাদি ছুটে গিয়ে দীপের ঘরের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিলো। বাড়ির কোলাপসিবল গেট বন্ধ করে লাগিয়ে দিলো বড় বড় তালা। দুজনেই একটা করে চাবি ভাগ করে নিলো। আরও আশ্চর্য হলাম রাঙাদি কাকলিকে দেখে । অতনুদা হুকুমের সুরে বললো -‘ বাড়ি চলো কাকলি। সৌম্যদা, আমি গাড়ি নিয়ে ধানবাদ থেকে এসেছি। গাড়িতেই ফিরে যাচ্ছি। কিছু মনে করবেন না।’- রাঙাদি মুখটা নামিয়ে নিলো। মোমের পুতুলের মত মুখ। এই মুহূর্তে আমি অনুভব করলাম রাঙাদিও সুখী হয়নি। হঠাৎ চোখে পড়লো কৌশিকদা । পাড়ার লোকের ভিড় থেকে একটু দূরে গাছের নিচে আবছায়াতে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রাঙাদির দিকে।
কি
ক্রমশঃ:-