খুকু ️️ কলমে – অরণ্যানী
প্রিয় বন্ধু আল্পনা,
কত দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেল, তবুও তোর কথা আজও ভুলতে পারি না। তোর শেষ চিঠির কোনো উত্তর আমার দেওয়া হয়নি। জানিস তো, সেই ছোটবেলার মতো অভিমানী স্বভাবটা আমার আজও রয়ে গেছে। যদিও এই অভিমানের মূল্য কেউ দেয় না। তুই আমাকে যতটা চিনতিস, এভাবে আর কেউ কোনদিনই আমাকে চিনতে পারলো না। নিজের কোনো আপনজনও নয়।
তোর কথাগুলো আমি অবিশ্বাস করি না। জানি, তুই আমাকে খুব ভালোই বাসতিস। আমিই আসলে বন্ধুত্ব আর প্রেমের সম্পর্কের পার্থক্যটা তখন বুঝতাম না। তাই অকারণ তোর উপর অভিমান হতো। তোর চিঠি থেকে তো সব পরিষ্কার বোঝা যায় যে তুই ভালোই জানতিস আমি তোকে কতটা ভালোবাসি। সবকিছু জানার পরও আমি কেন যে এমন অভিমান করে রইলাম তখন, সে কথা আজও ভাবি। একবারও তোকে জিজ্ঞেস করিনি, কেন তোর সঙ্গে পার্থর বিয়ে হতে পারে না। আসলে তুই কী সমস্যায় পড়েছিস, যার জন্য আমার সাহায্যের প্রয়োজন তোর আছে, তাও জানতে চাইনি। আমি বন্ধু হিসাবে তবে কেমন ছিলাম? আজও কি আসলে তাই রয়ে গেছি? জীবনে এতবড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও আমার চরিত্রের কেন কোনো পরিবর্তন হলো না কে জানে। দু’জনেই হয়তো ইগো সমস্যায় ভুগছিলাম। যার জন্য আমি না পারলাম কিছু জিজ্ঞেস করতে, আর তুইও না পারলি কিছু বলতে। অনেক দিন পর্যন্ত অভিযোগ ছিল, তুই যদি কাউকে ভালোই বাসবি, তবে কেন এভাবে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যাবি শুধুমাত্র বদনামের ভয়ে? আমার বাবা, মা, দিদি, সবাই কতদিন পর্যন্ত কেঁদেছিল তোর জন্য। তোর মার তো মাথাটাই ধীরে ধীরে খারাপ হয়ে গেল।
আমি শ্বশুর বাড়ি থেকে আসলেই তোর মা আমাকে দেখতে আসত। কিন্তু তখন আমার ভীষণ রোমান্টিক লাইফ কাটছে। তোকেও সাময়িক ভাবে ভুলে গেছি। তাই তোর মার প্রতিও হয়তো সঠিক আচরণ করা হয়নি। তোর মা একদিন কাঁদতে কাঁদতে জানতে চাইলো, যে তুই আমার স্বপ্নে কখনও এসেছিস কিনা। তুই তো সত্যিই দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমার স্বপ্নে আসিসনি। তাই স্বপ্নেও তুই নেই শুনে তোর মা খুব কাঁদলো। তখন আমার রাগ হলো তোর উপর। এভাবে কি যেতে হয়?
তোকে নিয়ে কিছু লেখার অনুরোধ এসেছিল তোরই সেই কাজের বাড়ির আর এক বন্ধুর বোনের কাছ থেকে ফেসবুকে। শুরু করলাম একদিন তোর আর আমার কথা লেখা। কত মানুষ যে পড়েছে সে সময় ফেসবুকে কী বলবো তোকে। তোর মৃত্যুর ঘটনাটা অনেকে আত্মহত্যা বললেও অনেকে তা বিশ্বাস করত না। আমি আমার মেয়েদের কাছেও তোর কথা বলেছি। তোর মৃত্যুটা আসলে রহস্যময়ই থেকে গিয়েছিল। ফেসবুকে লিখতে লিখতে এক সময় তোর কাজের বাড়ির ওই বন্ধুটিই কমেন্টে সব বলে দিলো। তোর দাদাই নাকি তোকে মারতে মারতে মেরেই ফেলেছিল। পরে তোর কাহিনী আমি বই আকারে প্রকাশও করেছি। কত অজানা মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে তোর কথা, তোর ব্যথা। সত্যিই, তুই তো আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে ছিলি না। বরং অন্যায়ের প্রতিকার না করাটা তোকে একদমই মানায় না। তুই যদি সব বলে দিতিস, তবে আমরা যে করেই হোক তোকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু মাত্র ষোলো বছর বয়সে ওই মেয়েটিও থানায় গিয়ে জানাতে পারেনি। তাই আজও তোর প্রসঙ্গ এলে অপরাধ বোধে ভুগি আমরা। তোর দাদা যখন একটা অপরাধ চক্রের সঙ্গেই জড়িত, তখন সেটা জানিয়ে দেওয়াই তোর উচিত ছিল।
আজ আর কেন মিছিমিছি তোকে এসব বলা? এ তো আসলে গভীর রাতে নিজের সঙ্গেই একা একা কথা বলা। আজ তোর কথা চলে যাচ্ছে একটি ওয়েব ম্যাগাজিনে। কীভাবে যে তোকে অমর করে রেখে যাব ভেবে পাই না। সম্প্রতি একটা কবিতাও পোস্ট করেছি ফেসবুকে তোকে নিয়ে। যাক, আর বেশি কিছু লিখে লেখাটা বড় করেই বা কী লাভ। আশা করি আবার জন্ম নিয়ে তুই ভালোই আছিস। সেছাড়া আর কীই বা ভাববো বল। না জানি কতটা কষ্ট পেতে হয়েছে মৃত্যুর সময়, সেকথা ভাবলে তো আজও শিউরে উঠতে হয়। আবারও তাই চাই, যেখানেই থাকিস যেন ভালো থাকিস। আমাদের সকলের মা, মা কালীর আশীর্বাদ নিশ্চই তোর উপর থাকবে।
ইতি – তোর অভাগী বন্ধু খুকু।
কলমে – অরণ্যানী