আত্মজা —- ধারাবাহিক উপন্যাস অধ্যায় -১০

আত্মজা
—————
ধারাবাহিক উপন্যাস
অধ্যায় -১০
দুপুর তিনটের পর স্কুলে ফিজিক্যাল এডুকেশনের ক্লাসগুলো থাকে।সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়তেই স্কুলের মাঠে ছায়া এসে পড়ে। মেয়েদের ক্লাসে ব্যায়াম করতে বলে চেয়ার টেনে বসে দেখে স্বাধীনতা। মেয়েদের ভুল হলে ধরিয়ে দেয় সে।
তার শরীরে সাত মাসের মাতৃত্বের লক্ষণ এখন সুস্পষ্ট। শরীর ভারী হয়ে উঠেছে।বুকে পিঠে চাপ লাগে। একটু কাজ করলেই হাঁফ ধরে যায়।
কৃষ্ণনগরের শ্বশুরবাড়ি থেকে বিয়ের পর প্রথম কয়েক মাস যাতায়াত করেছিল স্বাধীনতা আর অলোক দুজনেই।
ভোর ভোর ঘুম থেকে উঠে সকলের জন্য গ্যাস জ্বালিয়ে রান্না বসিয়ে দিত স্বাধীনতা।চায়নাদি অনেকদিন ধরে অলোকদের বাড়িতে থাকে।একেবারে নিজের মতো হয়ে গেছে।  স্বাধীনতারা দুজনেই যখন কৃষ্ণনগরের বাড়ি থেকে যাতায়াত করত,চায়নাদি তখন রাতের বেলা তরকারি কেটে,মশলা বেঁটে রেখে দিত। সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানার কাপড় ছেড়ে রান্না বসাত স্বাধীনতা।
শাশুড়িমা স্বাধীনতাকে বলতেন,তোমাদের মতো তোমরা খেয়ে চলে যাও মা ।পরে আমার রান্না আমি করে নেব।
—–তাই আবার হয়? স্বাধীনতা আপত্তি জানাতো।
—–সাত সকালে নিরামিষ-আমিষ এতো হাঙ্গামা করতে হবে না মা। পরে আমি ভাতে ভাত করে খেয়ে নেব ঠিক।
স্বাধীনতা বলতো, মা আমরা ভালমন্দ খাব আর আপনি আলুসেদ্ধ-ভাত খাবেন? কি করে ভাবলেন , এটা আমরা মেনে নেব?
—-তোমার সঙ্গে তর্কে পারব না বাপু।যা মনে হয় কর । হার মানতেন বিমলাদেবী। তবে মনে মনে খুশী হতেন  তিনি।তার বউমা বড় ঘরের মেয়ে।তার  মনও বড়। এই তো রায়গিন্নীর একমাত্র ছেলে বউএর প্ররোচনায় আলাদা সংসার পেতেছে।সেখানে মায়ের কোন স্থান নেই।
স্বাধীনতার শাশুড়িমা বিধবা হবার পর থেকে বড় শুচিতা মেনে চলেন। এসব নিয়মকানুন তিনিও তাঁর শাশুড়িমার কাছ থেকে শিখেছিলেন। দুপুরে একবার ভাত খান,তাও নিরামিষ। রাত্রে ভাতের ছোঁয়া খাবার নিষিদ্ধ।সামান্য এক ছটাক দুধ আর দু’খানা রুটি ,এটাই তার রাতের খাবার।মাসে দুইটি একাদশী পড়ে। একাদশীর দিনে সারাদিন ফলাহার করে থাকেন। রাত্রে স্বাধীনতা জোরজবরদস্তি করে খান চারেক লুচি আর আলুর তরকারি রেঁধে দেয় শ্বাশুড়িমার জন্য। অলোকের মা বিমলাদেবী কিছুতেই স্বাধীনতার সঙ্গে পেরে ওঠেন না।
মেয়েটা বড় মায়াবী।মনে হয় কতকালের চেনা।
স্কুল থেকে ফিরে আসলে চায়না  কাপে মেপে মেপে চায়ের জল বসায়,মুড়ি মাখে সকলের জন্য।
স্বাধীনতা হাতমুখ ধুয়ে বিমলাদেবীর ঘরে ঢোকে।
—— মা কি করছ?
—— এই মালা জপছি।বিমলাদেবীর হাতে তুলসী কাঠের মালা। কৃষ্ণ নামের সাথে সাথে তুলসী কাঠের পুঁতিগুলোকে আঙ্গুল দিয়ে আরেক পাশে সরাতে থাকেন তিনি। মালার সুমেরুর দিকে এক প্রস্থ হ’লে সাক্ষী মালায় হিসেব রাখেন। স্বাধীনতাকে বড্ড স্নেহ করেন বিমলাদেবী। মেয়েটি সংসারের  সব দিকে খেয়াল রাখে।

বাচ্চাটা পেটে আসার পর থেকে স্বাধীনতার যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে।এখন স্কুলের কাছেই একটা বাসা ভাড়া নেওয়া হয়েছে।সেখানেই অলোক আর স্বাধীনতার অস্থায়ী সংসার ।সংসার চালাতে যেটুকু জিনিস প্রয়োজন,শুধু সেটুকু নিয়েই ভাড়াবাড়িতে আসা।শনিবার স্কুল থেকে বেরিয়ে কৃষ্ণনগরের ট্রেন ধরে অলোক।সেখানে দুই বোন,মা থাকে।রাত্রে বাড়ি পৌঁছে অলোক হাত-পা ধুতে ধুতে মাকে বলে,চায়নাদিকে এক কাপ চা বসাতে বলতো মা।
মা বলেন,আর কিছু খাবি না?
—- না, স্কুলে টিফিন খেয়েছি।স্বাধীনতা করে দিয়েছে।
—–বউমার শরীর কেমন আছে?
—- হাত-পা ফুলছে। প্রেসারটা হাই।ডাক্তারবাবু খেয়াল রাখতে বলেছেন।
—- মেয়েটা ভরা পোয়াতি।তোকে আর এখানে আসতে হবে না বাবা ।তুই এখানে চলে এলে একা একা থাকবে মেয়েটা।কোন সময় কি হয়।
বত্রিশ বছর বয়সে প্রথম মা হওয়াটা খুব বিপজ্জনক। অলোক জানে সে কথা। যতক্ষণ না বাচ্চা হচ্ছে,ততক্ষণ নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না। বিয়ের সম্বন্ধ হওয়ার সময় স্বাধীনতার বয়স নিয়ে বেশ খুঁতখুঁতে ছিল অলোক । তবে চাকুরিরতা মেয়ের ওজনই আলাদা। নিমরাজি হয়েও সে বিয়েতে মত দিয়েছিল শুধু স্বাধীনতা চাকরি করে বলে।প্রতি মাসে মাসে কতগুলো টাকা ঘরে আসবে! সেটাই দেখেছিল সে।
সেদিন ডাক্তার মানস সরকারের কাছে স্বাধীনতাকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল অলোক। ডাক্তারবাবু বেডে শুইয়ে স্বাধীনতাকে পরীক্ষানিরীক্ষা করছিলেন ।
-‐–কেমন দেখছেন ডাক্তারবাবু?বাচ্চা ভালো আছে?
—- এখন তো ঠিক আছে।তবে যতক্ষণ না বাচ্চা হচ্ছে ততক্ষণ মাকে খুব সাবধানে রাখতে হবে।
বারান্দায় বসে অন্যমনস্কভাবে সিগারেটে টান দিতে দিতে সাতপাঁচ ভাবনা অলোকের মনে হানা দিচ্ছিল। গরীবের ঘরে বাচ্চা যেচে আসে আর এই বড়লোকের বেটি বাচ্চা হতে গিয়ে কতগুলো টাকা খসাবে কে জানে!
খাওয়াদাওয়ার পর হেঁশেল সামলে আঁচলে কপাল ও ঘাড়ের ঘাম মুছতে মুছতে স্বাধীনতা ঘরে এল।সে দেখল অলোকের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।সামনের অ্যাশ ট্রেতে উপচে পড়ছে সিগারেটের টুকরো ও ছাই। হয়তো মানুষটা দুশ্চিন্তায় আছে।
অলোকের গায়ে হাত দিয়ে ডাকে সে,এইই কি এত ভাবছ?
অলোক সচকিত হয়।স্বাধীনতা যেন তার মনের খবর টের না পায়।মুখে বলে,তোমার কথাই ভাবছি।
——- কি ভাবছ,আমায় বলবে না?
—— না না,তেমন কিছু না।
—– আমার খুব মন খারাপ করছে গো। যদি আর না বাঁচি!
অলোক মনে মনে বলে, কারা যেন বলে ভাগ্যমানের বউ মরে। আমি কি এত ভাগ্যবান! তাহলে একটা অল্পবয়সী দেখে …….  কিন্তু মুখে বলে,আহা এসব আলতু ফালতু ভেবে মন খারাপ করছো কেন বলতো?দেখতে দেখতে দিন কেটে যাবে। সুস্থ হয়ে তুমি বাড়ি ফিরে আসবে।
—- তুমি না বললেও আমি বুঝতে পারছি?
—-কি?
—–বল না ডাক্তারবাবু কিছু বলেছেন?রিপোর্ট খারাপ ?
স্বাধীনতার প্যানপ্যানানি অলোকের অসহ্য লাগে। একবার মনে হয় সব বলে দেয় স্বাধীনতাকে যে তার
প্লাজন্টা নেমে এসেছে নীচের দিকে। সব শেষ রিপোর্টটা দেখে ডাক্তারবাবু বলেছেন যে বাচ্চা হতে বেশ রিস্ক আছে তার। কিন্তু অলোক চুপ করে থাকে। ডাক্তারবাবুর কথা মনে পড়ে যায় । তিনি বলেছেন,পেসেন্টকে একথা একদম না  জানাতে এখন বললে ডাক্তারবাবু জানবেনই, নিজেকেই একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হবে। তার থেকে চেপে যাওয়াই মঙ্গলের।

ডাক্তারবাবুর কথামত স্বাধীনতা স্কুলে ছুটির আবেদন করেছে। স্বাধীনতার স্কুলের কাছে যে বাসাটা ভাড়া নিয়েছে তারা সেটা আপাতত ছেড়ে দিতে হচ্ছে। এই মাসটা বাসাটা রাখছে তারা ।তারপর একটু একটু করে জিনিস সরিয়ে নেবে ।  যতদিন বাচ্চা না হচ্ছে ততদিন স্বাধীনতা বহরমপুরে বাপের বাড়িতেই থাকবে। এতদিন ধরে কি শ্বশুরবাড়িতে থাকা যায়!তাই নিজের স্কুলের কাছেই একটা ঘর ভাড়া করবে অলোক।
রাত্রে চুপচাপ শুয়েছিল স্বাধীনতা। অলোক বলল,  তা হলে…কাল থেকে দুজন দুদিকে । স্বাধীনতা হাসে।
—- হাসছ কেন? অলোক ভ্রু কুঁচকে বলে।
—-হাসব না ! কাল থেকে তোমার পিছনে লাগবার লোক থাকবে না।
—-তা তো ঠিক।এটা তো মাথায় আসেনি।
—–কেউ বক বক করবে না।নিজের মতো চলবে।
—-‐ একদম ঠিক বলেছ!

অলোক মনে মনে বলে,স্বাধীনতা, তুমি আমাকে কতটুকু চেনো! আই অ্যাম দা প্লেবয় অফ ইউনিভার্সিটি!

স্বাধীনতার বুকটা ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। তবুও অলোকের সামনে সে শক্ত হয়ে থাকে।বুঝতে দেয় না তাঁর অন্তরের অন্তর্দাহ।
এবার অলোকের বুকে মাথা রাখে সে। নিজেই অলোকের মুখে,চোখে চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দেয়।
অলোক ভাবে, এবার ক’দিন নিজের মতো থাকা যাবে।

স্বাধীনতার শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো না।ডাক্তারের নিষেধে এখন নড়াচড়া সে করেই না। অলোক কোন কোন রবিবার বাড়ি না গিয়ে বহরমপুরে স্বাধীনতার কাছে আসে। তার শরীরে বড় অস্বস্তি, –উঠতে,বসতে,খেতে,ঘুমোতে—সবেতেই খুব কষ্ট।স্বাধীনতার কিছুই ভালো লাগে না।সে শুধু ভাবে বাচ্চাটা হয়ে গেলে সে আবার আগের মতো চলাফেরা করতে পারবে। শাশুড়িমার জন্য খুব মন খারাপ করে স্বাধীনতার।টিঙ্কু আর মুন্নির কথা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়।

স্বাধীনতা ভেবেই রেখেছে,বাচ্চা হয়ে গেলে সে আবার কৃষ্ণনগরের শ্বশুরবাড়ি থেকে যাতায়াত করবে। বাচ্চা শাশুড়িমার কাছে থাকবে।চায়নাদি তো আছেই। এছাড়া টিঙ্কু আর মুন্নি বাচ্চাকে নিয়ে খেলা করবে,চুপ করিয়ে রাখবে। স্বাধীনতার মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। ( চলবে)
 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *