“কিছু কথা অন্য সুখ ” রাকা ভট্টাচার্য্য
“কিছু কথা অন্য সুখ “
চতুর্থ
রাকা ভট্টাচার্য্য
“কেউ যখন কিছু বলেনা, তখন আমিই বলি;
কেউ বলেনা কেন তাও বুঝি।
তবু যোগ্যর জন্য নীরব প্রত্যাশা থাকলে দোষ কী!!”
কবি অসীম সাহা।
তাঁর কথা দিয়েই তাঁকে স্মরণ করি। আজ তো তিনি স্মরণের পথে অপেক্ষারত এক স্মরণীয় কবি।
বাংলাদেশের একুশে পদক প্রাপ্ত বিশিষ্ট গুণী কবি অসীম সাহা।বছর পাঁচ আগে তাঁর সাথে আমার পরিচয়। প্রথম আলাপে আমার সহজ সরল কথা তিনি বেশ উপভোগ করছিলেন বুঝেছিলাম। তিনিও বুঝেছিলেন আমি তাঁর সম্পর্কে কিছু না জেনেই কথা বলে যাচ্ছি। আমি তাঁকে বলেছিলাম তাঁকে আমার ছোটো বেলার এক দাদুর মত সুন্দর দেখতে যিনি নেতাজী ভক্ত ছিলেন আর আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। এই কথায় তিনি হো হো করে হাসেন, এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমি কার সঙ্গে কথা বলছি আমি ঠিক জানি কিনা। যেহেতু তাঁর প্রোফাইলে তাঁর সম্পর্কে কিছুই লেখা ছিল না। তাই আমি কিছুই বলতে পারলাম না। ঘাবড়ে গিয়ে আমি চুপ থাকলাম।
উনি জানালেন তাঁর ৭৪ বার জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্তির কথা ও বাংলাদেশ সরকার দ্বারা একুশে পদক প্রাপ্তির কথা। বললাম মাফ করবেন আমি এতক্ষণ এত সহজভাবে আপনার সাথে কথা বলে যাচ্ছিলাম। উনি হেসে বললেন তুমি তো সহজ মানুষ, তাই তুমি তো সহজ ভাবেই কথা বলবে। আমি ওনার এই উদার ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম। মনে মনে ভাবলাম গুণী মানুষরা কত সহজ সরল ও উদার হন।এভাবেই তাঁর সাথে আমার সাহিত্য জগতে পথ চলা শুরু।
মাঝে মাঝেই আমি তাঁর খবর নিতাম কেননা তিনি নার্ভের সমস্যায় ভীষণ অসুস্থ ছিলেন, তিনি আমাদের ভারতে প্রায়ই পীয়ারলেসে চিকিৎসা করাতে আসতেন। তিনিও আমার কাছে খবর নিতেন করোনার পর এখানকার স্বাভাবিক জীবন ও হাসপাতাল সম্পর্কে। কখনও বা আমার কোনো লেখা পড়ে ভালো লাগলে তিনি আমায় জানাতেন।একবার তিনি আমায় বলেছিলেন ‘রাকা তুমি তোমার কবিতায় সুন্দর “। তাঁর এই মন্তব্য আমার চোখে জল এনে দেয়। অনেকেই মন্তব্য করেন তুমি ও তোমার কবিতা দুজনেই সুন্দর। কিন্তু তিনি আলাদা সবার থেকে তাই তাঁর দেখা ও বলার ক্ষমতাও আলাদা।
আর একবার একটা অনুষ্ঠানে বরুণ চক্রবর্তী মহাশয়ের সাথে আমার ছবি দেখে উনি বললেন ” রাকা তোমাকে বরুণের সাথে দেখে খুব খুশী হলাম। তুমি এগিয়ে চলো “।
তাঁর এই ছোটো ছোটো ভরসা দেওয়া কথা আমার মত এক নগণ্য লেখিকার জন্য পরম আশির্ব্বাদ ছিল।
গত নভেম্বরে ২৩ এর, তাঁর সাথে আমার শেষ কথা হয়। তিনি জানান তিনি ভীষণ অসুস্থ, ভারতে আসতে পারেন। আমি তাঁর সাথে দেখা করা ও ছবি তোলার ইচ্ছা প্রকাশ করি তিনি অনুমতি দেন।তিনি এখানে এসে যেখানে থাকেন তার ঠিকানাও দিলেন।
আমি ভাবনা চিন্তা করে ফাল্গুনী স্যার ( Falguni Ghosh) কে বলি কোনোভাবে ওনাকে ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো যায় কিনা সেই সাথে তবে কিছু উপহার ও দেওয়া যায়। ফাল্গুনী স্যার আমার ইচ্ছার প্রশংসা করেন ও ব্যাবস্থা নিতে বলেন। কিন্তু তারপর আমি তাঁর সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি এমনকি তাঁর ওয়ালে তাঁর কোনো পোস্ট ও দেখতে পাই নি আর। আমি ভীষণই চিন্তায় ছিলাম। গত ১৮ ই জুন ২০২৪ বিকালে বাংলাদেশের নীলপদ্ম সাহিত্য পরিবার আমাকে একটি পোস্টে ট্যাগ করলে জানতে পারি তিনি উত্তরণের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে পাড়ি দিয়েছেন স্বর্গালোকে।
আমরা যারা লেখালিখির জগতে একসাথে পথ চলি আমরা নিজেদের অজান্তেই একে অপরের আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠি কীভাবে জানিনা। আর যখন বিশেষ বিশেষ কোনো লেখক বা লেখিকার স্নেহ ভালোবাসা পাই মনে হয় এ জন্মে ঈশ্বরের কাছে অনেকটাই ঋণী রয়ে গেলাম।
এমন এক বিদগ্ধ গুণী কবির চির বিদায়ে আমি গভীর শোকাহত। তাঁর আত্মার অসীম শান্তি কামনা করি।শেষ করি তাঁরই লেখা একটা কবিতা দিয়ে—-
‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী না’–
এই কথা লিখেছিল কোনো এক কবি;
কেন লিখেছিল?
সে কথা বোঝেনি কেউ, কেউ এসে তাঁর মুখে
দেয় নাই এক ফোঁটা জল,
মৃত্যুই অধিক তাঁকে টেনেছিল আরো বেশী মৃত্যুর ভেতরে,
মৃত্যুর ভেতরে কবি হয়েছিল প্রথম সফল।
(কবির সাফল্য—অসীম সাহা)
এইতো কবি মনের সচেতন সংবেদনশীল এক চিরকালীন মৃত্যুন্জয়ী অনুভূতির কথা।
যেখানেই থাকো তুমি ভালো থেকো, আবার ফিরে এসো কবি হয়ে, এই বাংলার বুকে, এই বাংলাদেশে, আমাদের পাশে।