অনুগল্প : দৃষ্টি ***** নীহার কান্তি মন্ডল
অনুগল্প : দৃষ্টি
নীহার কান্তি মন্ডল
:ডাক্তারবাবু, আমার এই বাচ্চার চোখদুটো ভালো করে দিন।
: আপনার বাচ্চা?
:হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, আমারই তো বাচ্চা। আমার স্কুলের ছাত্র। পড়াশুনায় বেশ ভালো। কিন্তু ইদানিং ঈমান ঠিকমতো দেখতে পারছে না, ব্লাকবোর্ডের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। ওরা খুব গরীব। চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই। তাই বলে চোখের সামনে তো ছেলেটাকে শেষ হয়ে যেতে দিতে পারি না। ওর মাকে রাজি করিয়ে ওকে আপনার কাছে নিয়ে এসছি। ওর মাও এসছে। আপনি কিছু চিন্তা করবেন না ডাক্তারবাবু, চিকিৎসা করাতে যত টাকাই লাগুক — আমিই দেবো। আপনি দয়া করে ঈমানের চোখদুটো পরীক্ষা করে দেখুন।
প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলেন ছোট্ট শহরের একটা স্কুলের দোর্দন্ডপ্রতাপ অঙ্কের দিদিমণি মিলি। মিলি দত্ত।
আই স্পেশালিস্ট ডক্টর স্যান্যাল এতোক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে মিলির কথা শুনছিলেন। মিলি তার অপরিচিতা নন। গত মাসেও তার কাছে চোখ পরীক্ষা করে চশমার পাওয়ার গ্লাস চেঞ্জ করে নিয়েছেন।
ছোট শহরের সবচেয়ে অভিজ্ঞ চোখের ডাক্তার তিনি। নিজস্ব চেম্বার, সাথে চশমার দোকানও তারই। ডাক্তারবাবু তার সাপোর্ট স্টাফদের সহযোগিতায় ঈমানের চোখদুটো পরীক্ষা করে অবাক হয়ে গেলেন — একটা চোখে কিছু দেখতেই পায় না। অন্য চোখের পাওয়ার মাইনাস বারো। হাই পাওয়ার লেন্সের চশমা নিতে হবে ইমিডিয়েট। তাতেও ঠিক হবার সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা নেই। ঠিক না হলে বড় শহরে নিয়ে গিয়ে অপারেশন করাতে হবে।
:চশমার খরচ দেশীয় লেন্সে করলে চার হাজার, আর বিদেশী ব্রান্ডের করলে আট হাজার খরচ পড়বে। কোনটা অর্ডার দেবেন বলুন?
:আপনি বিদেশী ব্রান্ডেড কোম্পানির লেন্সই দিন ডাক্তারবাবু। বুঝতেই পারছেন — বাচ্চা মানুষ।
:কিন্তু ম্যাডাম, গত মাসেই তো আপনি নিজের জন্য চশমা বানাতে এসে প্রোগ্রেসিভ লেন্সে খরচা বেশি বলে অর্ধেক দামের বাই-ফোকাল লেন্সের চশমা নিলেন?
মিলি দত্ত ম্লান হাসলেন : ডাক্তারবাবু , আমি বুড়ী মানুষ, আমার কথা বাদ দিন, আর ক’দিনই বা বাঁচবো বলুন। কিন্তু আমার ঈমানের পুরো জীবনটাই পড়ে রয়েছে।
হার মানলেন ডাক্তারবাবু: আপনি এই ছেলেটার জন্য যখন এতো কিছু করলেন, আমাকেও আপনার শরিক হতে দিন। ওর জন্য আমরা কোনো ফিস্ নিচ্ছি না। আর চশমাতেও কোনো লাভ লাভ রাখছি না। আপনি চশমা বাবদ সাত হাজার দিলেই হবে। আর চোখের জন্য এই ড্রপটার ব্যবস্থা করবেন।
চশমার অ্যাডভান্স বাবদ চার হাজার টাকা জমা করে ডাক্তারবাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওদেরকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন মিলি।
পার্সের অবশিষ্ট টাকা থেকে ওষুধ কিনে একটা অটো ডেকে ওদের তুলে দিলেন, সাথে অটোর ভাড়া টাও দিয়ে দিলেন।
ফেরার পথে তাকে পুরো রাস্তা পায়ে হেঁটে ফিরতে হবে, কারণ পার্স পুরোপুরি ফাঁকা। কিন্তু এক অনাবিল আনন্দে ভরপুর তার হৃদয়। তাই হাঁটতেও তার ক্লান্তি এলো না। হেঁটেই চলেছেন। সদর রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতেই মিলি দত্ত মিলিয়ে গেলেন তার বাড়ির গলি রাস্তার বাঁকে।