ঠানদিকে আগুনরূপা **** মালা চ্যাটার্জ্জি
ঠানদিকে
আগুনরূপা
মালা চ্যাটার্জ্জি
প্রিয় ঠানদি,
লক্ষ লক্ষ স্মৃতি নিয়ে জীবন চলেছে
ইহকালের দিকে দিকে। জীবনতরী চলেছে এক
পাতা থেকে অন্য পাতাতে। নিভৃতক্ষণ মাঝে মাঝে
যায় বিগতদিনকে ডেকে আনতে। ঠানদি, আজ
তুমি এসে দাঁড়িয়েছো জীবনতরীর ঘাটে।
পরলোকগত হয়েছো ঠানদিগো। নভেম্বর মাসের
প্রথম দিনে প্রতিবছর আমার চোখে শ্রাবণের বাষ্প
নেমে আসে।
আসলে নতুন বৌ হয়ে প্রথম যে দিন আমি
বাগবাজারের বনেদী মৈত্র পরিবারে আসি সেদিন
থেকেই তোমার সাথে আমার সখ্যতা। বধূ বরণের
পর আমার কাছটিতে এসে আনত মুখ আমার
তুলে ধরে বলেছিলে, ‘আরে, এ যে আগুনরূপা,
তবে আমিও আগুনখেকো তুই জানবি।’ তারপর,
হেসে বলেছিলে , আমাকে এ বাড়ির সবাই ঠানদি
বলে ডাকে, তুইও ডাকবি। ’ সেই শুরু, তারপর
মৈত্র বাড়ির ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে কত ঘুঘুডাকা
দুপুর আমরা খুনসুটি করে কাটিয়েছি। অপূর্ব মেঘ
দেখলে বাড়ির লাল মোরামের রাস্তা ধরে চলে গেছি
বাগানের শেষপ্রান্তে। মাঝে মাঝে অন্দরমহলের
বারান্দায় তাসের আড্ডাও বসাতে। হাসতে হাসতে
বলতে, ‘ মৈত্র বাড়ির বৌ তাস খেলতে জানবে না
তা কি হয়। ’
তোমাকে ঠানদি বলতে না চাইলে চোখ পাকিয়ে
বলতে ‘,তোর শাশুড়ী মা আমার এই নামকরণ
করেছে। ঠানদি না ডাকলে তাকে যে অসম্মান করা
হয় আগুনরূপা। ছোটবেলা থেকে ঠানদির মতো
পাকা পাকা কথা বলতাম বলে বৌঠানের এই
নামকরণ। ’ তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শূন্যে
তাকিয়ে থাকতে। বুঝতাম শাশুড়ী মায়ের জন্য
তোমার হৃদয়ের শূন্যতার কথা। তার মৃত্যুর পর
সংসারের হাল ধরার জন্যেই তো তুমি চিরকুমারী
থেকে গেলে।
জানো ঠানদি, আজও যখন কালেভদ্রে অনেক রাতে
সেতার নিয়ে বসি তখন তোমার কথা আমার খুব মনে হয়l একদিন অনেক রাতে ইমন কল্যাণ
বাজাচ্ছিলাম। আলাপ থেকে ক্রমে ক্রমে ঝালায়
পৌঁছে গিয়েছিলাম। অস্থির মেজরাফ তখন
আলোড়ণ তুলছে তন্ত্রীতে। বাড়ির প্রতিটি ঘরে,
প্রতিটি দরজায়,জানলায়, মেঝেতে, আসবাবে
অনুরণিত হচ্ছিল সেই ধ্বনি। হঠাৎ আমার ধ্যান
ভেঙেছিল আধভেজা দরজার ওপারে তোমার ছায়া দেখে। অন্ধকারে তোমাকে আমার ছায়ামানবী বলে
মনে হয়েছিল। তুমি সামনে এসে আমাকে বলেছিলে,
‘এতরাতে ইমনকল্যাণ কেন বাজাচ্ছিস আগুনরূপা।
ভোরবেলা বাজাবি। ’সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম
রাগরাগিণীর সম্বন্ধে ধারণাও তোমার আছে। শ্রদ্ধায়
মাথা নুয়ে এসেছিল।
এ চিঠি কোন এক শ্রাবণ সন্ধ্যায় আমি নৌকো করে
ভাসিয়ে দেবো। যদি পরলোকের ঘাটে গিয়ে পৌঁছায়
তুমি তুলে একবার পড়ো ঠানদি।
ইতি
তোমার আগুনরূপা
স্বত্ব সংরক্ষিত@ মালা চ্যাটার্জ্জি