– রবির আলোয় –   * গীতালি ঘোষ *

– রবির আলোয় –
                         * গীতালি ঘোষ *

মুক্তিকামী রবীন্দ্রনাথ যখন লেখেন ‘ হারে রেরে রেরে, আমায় ছেড়ে দে রে দে রে/ যেমন ছাড়া বনের পাখি মনের আনন্দে রে’ — তখন অনুষঙ্গগুলি মনের ভিতর ঘরে ঘা দেয়, চোখের সামনের পর্দাটা অনায়াসে সরিয়ে দেয়। জীবনের নিত‍্যদিনের ব‍্যস্ততায় ছুটি চায় মন, বন্ধ দুয়ার খুলে উন্মুক্ত আকাশে, অকাজে অপ্রয়োজনের আনন্দে ছুটে চলতেই চায়, ‘ঘন শ্রাবণধারা’র মত ‘ বাঁধনহারা হয়ে ‘ অট্টহাস‍্যে সকল বিঘ্ন’কে কাটিয়ে কোন অজানায় উড়তে চায়! মনে হয়  একথা তো আমারই মনের কথা, আমাদেরই রুদ্ধ প্রাণের আকুল কামনা! দূরের পথে পাড়ি দিয়ে ‘ গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথ’টি কেমন হাতছানি দেয়, ‘ ঘরের আগল যায়  ছুটে’, সেই অবসরে ‘ ছুটির বাঁশি’টিও নীল গগনে বেজে ওঠে… কবির মত উদার আকাশে মুক্তি খুঁজে নেওয়ার ইচ্ছে জেগে ওঠে। ‘ দিবারাত্রি’ মুক্তির আশায় উদ্বেল হয়  মন। মনের আনাচে কানাচে খোলা হাওয়া লাগে আর ‘ সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে’…… সুদূরের পিয়াসী মন চঞ্চল হয়ে  কার যেন ‘ পরশ পাবার প্রয়াসী ‘ হয়ে  ওঠে। কিন্তু হায়! ওড়ার ডানা যে নেই, ‘সে কথা যে যাই পাশরি’।

উপনিষদের মন্ত্রে দীক্ষিত কবি তাঁর জীবনে যে আলোর সন্ধান পেয়েছিলেন, সে আলোর উৎস কিন্তু আঁধারে।  ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত’ সেই আলোতে তিনি চিনেছিলেন নিজেকে আর সেই চেতনার আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বভুবনে। যে অপরূপ আলোর উদ্ভাস তাঁর জীবন ব‍্যেপে ছিল, যে ‘ আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে’ ‘সকল কলুষ তামস’কে অপগত করতে সমর্থ হয়েছিলেন ঋষিকবি, তাঁরই ছত্রছায়ায়  আমরাও পথ চলার দিশা পাই যেন। ‘রাতে রাতে আলোর শিখা জ্বেলে ‘ রেখে তিনি জ‍্যোৎস্না প্লাবিত আকাশে শুভ্র সুন্দরের অপরূপ রূপসাগরে স্নাত হয়েছিলেন… ঠিক তেমনি করেই কবির লক্ষ‍্যই হয়ে  উঠুক আমাদের পথের দিশারী। কর্মক্লান্ত জীবনে বহির্জগতের অনির্দেশ‍্য ভয়ঙ্কর সময়ে আলোকের ঝর্ণাধারায় যদি অবগাহন করতে পারি, সে হবে আমাদের  নবজীবনের সূচনা।

‘ হৃদয়ের বিজন আকাশে’ কবি কার ‘মহাসন আলোতে ‘ ঢেকে রেখেছিলেন— সে কী সেই সদানন্দ পরমপুরুষের? না কি অলক্ষ‍্যচারী কারোর নিভৃত পদক্ষেপ অনুভব করেছিলেন তাঁর জীবনে? কবির মত সমর্পিতপ্রাণ হয়ে  কোনো প্রেমের দেবতার পায়ে পূজা সঁপে দেওয়ার অবকাশ  আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে খুঁজে পাওয়া কী সম্ভব? তাই তো তাঁর নির্দেশিত জীবনের আলোকে কাণ্ডারী করে ‘হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে’র কোণে অপূর্ব চেতনার প্রদীপখানি জ্বালাতে চাই। আর সেই চেতনার সাথে সাথে প্রকৃতির অকৃপণ দানে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে বলতে চাই,  ‘ হারায় নি তা হারায় নি/ বৈতরণী পারায় নি’।।
****************

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *