আত্মজা **** কলমে সুদেষ্ণা সিনহা *** অধ্যায় -৬

আত্মজা
————–
ধারাবাহিক উপন্যাস
অধ্যায় -৬
সুদেষ্ণা সিনহা

ভারতবর্ষ আর দু’দিন পরেই স্বাধীন হচ্ছে। তবে দেশটা ভেঙে দুই টুকরো হয়ে যাচ্ছে।লোকেদের মনে একদিকে স্বাধীনতা লাভের  আনন্দ,অন্যদিকে দেশের এক অংশ পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার বেদনা। তবে স্বাধীনতা  দিবস কিভাবে পালন করবে সে নিয়ে চারিদিকে তোড়জোড় চলছে।একটা রব উঠেছে,মুর্শিদাবাদ জেলা পূর্ব পাকিস্তানে পড়েছে। জেলার লোকেদের মনে উচ্ছ্বাস নেই।
লোকের মুখে মুখে একটা রব উঠেছে,
পাক পাক পাকিস্তান
মুর্শিদাবাদ আর নেই হিন্দুস্তান।

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট জেলার সদর শহর বহরমপুরের ব্যারাক স্কয়ার ময়দানে পাকিস্তানের হয়ে স্বাধীনতা পতাকা তুললেন জেলাশাসক আই আর খান। মঞ্চে উপস্থিত মুসলিম লীগ নেতা কাজেম আলি মির্জা, কংগ্রেস নেতা শ্যামাপ্রসাদ ভট্টাচার্য,বাম নেতা সনৎ রাহা আর নিতাই গুপ্ত।
স্কুলে স্কুলে,সরকারি অফিসে,আদালতে বাড়ির ছাদে ছাদে উড়ছে পাকিস্তানের সবুজ পতাকা,মাঝে চাঁদ আর তারা। জেলা জুড়ে চাপা উত্তেজনা চলছে।
১৪ই আগস্ট রাতে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল ,মুর্শিদাবাদ জেলা আর ভারতের মধ্যে থাকছে না। পরের দিন মুর্শিদাবাদে উড়বে পাকিস্তানের পতাকা। সুতরাং পাকিস্তানের পতাকা পাওয়া যাচ্ছে দোকানে দোকানে।
পরের দিন জেলা জুড়ে মিছিল আর মিটিং।
স্লোগান ওঠে:
পাক পাক পাকিস্তান
মুর্শিদাবাদ আর নেই হিন্দুস্তান।

কিছু মানুষ সম্প্রীতি আর ভ্রাতৃত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন।তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন জেলার পরিস্থিতি যেন কখনো উত্তেজনাপ্রবণ না হয়ে ওঠে।
দিল্লিতেও তখন রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তোড়জোড় চলছে যাতে মুর্শিদাবাদও ভারতের অন্তর্গত হোক।চলছে মরণ পণ প্রচেষ্টাও।
রাজনৈতিক নেতারা যুক্তি দিলেন,গঙ্গা নদীর পাড় ধরে ভৌগোলিক সীমারেখা কমিটি দুটি দেশের সীমারেখা নিয়ে পুনর্বিবেচনা করুক।
কেউ কেউ বলল,না হলে কলকাতা বন্দরের অবস্থা আশঙ্কাজনক হবে।
তিন দিনের টান টান উত্তেজনা।দাঙ্গা-হাঙ্গামার কথা ভেবে বাড়ির বাইরে পা বাড়াচ্ছে না কেউ।
তিন দিন পর ভারতের সরকারি খাতায় মুর্শিদাবাদের নাম উঠল। কলকাতা বন্দরের কথা বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত সীমারেখা সংশোধন করে মুর্শিদাবাদকে ভারত ইউনিয়ানেই রাখা হল। পরিবর্তে খুলনা জেলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হল।
তবুও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না কেউ কেউ। পরের দিন ১৮ই আগস্ট চারিদিক শুনশান। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
সেদিন  বহরমপুরে ব্যারাক স্কয়ার ময়দানে আবার পতাকা তুললেন জেলাশাসক আই আর খান।এবার স্বাধীন ভারতবর্ষের পতাকা—তিন রঙের পতাকা,শীর্ষে গেরুয়া,ত্যাগের প্রতীক,মাঝে সাদা,শান্তি ও সত্যের প্রতীক আর নীচে সবুজ,উর্বরতা,বৃদ্ধি আর পবিত্রতার প্রতীক ।পতাকার মাঝখানে অশোক চক্র।
নবাব সিরাজের শেষ বংশধর ছোটে নবাব লালবাগে  ‘হিন্দু-মুসলিম কনফারেন্স’ সভার আয়োজন করলেন। দলে দলে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ এসে উপস্থিত হল সেই সভায়।
ছোটে নবাব বললেন,আমরা মুর্শিদাবাদবাসীরা এক কঠোর সময়ের মধ্যে চলেছি।আমাদের পূর্বপুরুষরা সর্বধর্ম সম্বন্বয়ে বিশ্বাস করে ,ভ্রাতৃত্ববোধে বিশ্বাস করে এতকাল একত্রে হিন্দু ও মুসলমান একত্রে বাস করে এসেছেন।আমরাও আজ সেই স্থিতাবস্থা বজায় রাখব।

শ্যামাকান্তের মনে চিন্তার শেষ নেই।সব ঘরে ঘরে স্বাধীনতার উৎসব পালন হচ্ছে। আজ তিনি কিছুটা অন্যমনস্ক,কিছুটা চিন্তিত।
সরমার গতকাল থেকে শরীর ভালো নেই। রাতে বিছানায় চুপচাপ শুয়েছিল সে। ঘুম আসছিল না তার।
শ্যামাকান্ত বললেন,কি হল?শরীর ভালো লাগছে না?
বালিশটা নিয়ে বাঁ দিকে কাত হয়ে শুয়েছিল সরমা।
ঘাড় নেড়ে বলল,কি অসুবিধা হচ্ছে?
—– শরীরে অসুবিধা কি একটা যে বলব….।
চেয়ে চেয়ে দেখছিলেন শ্যামাকান্ত।সরমার শ্যামাঙ্গী ছিপছিপে শরীর জুড়ে মাতৃত্বের আলগা শ্রী। চেহারাটা খুব ভারি হয়ে গেছে ইদানীং।খুব ভালো লাগছিল দেখতে,  কনে কনে মুখ।
——- কি কষ্ট হচ্ছে?  সরমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন শ্যামাকান্ত ।
—– পিঠে খুব ব্যথা।
–‐—শশী হওয়ার সময় এসব কষ্ট হতো?
——তখন এতটা বুঝতে পারিনি।

শ্যামাকান্তদের প্রথম সন্তান শশীকান্তের বয়স এখন তিন। বউমা পোয়াতি হওয়ার পর থেকে ঠাকুমা,বিধুরাণীর কাছেই শশী রাত্রে থাকে।শশী বাচ্চা ছেলে, খুব দুরন্ত।তার শোওয়াও খুব খারাপ।রাত্রে শোওয়ার সময় সরমার পেটে যদি লাথি মারে!
শশী রাত্রে ঠাকুমাকে বলে ,মা তই?মা দাবোওও…।
বিধুরাণী শশীকে বুকের কাছে টেনে পাশ ফেরান।
—– ওই দেখো,বাইরে কিন্তু হোদল কুৎকুৎ কুৎকুৎ বেরিয়ে গেছে।এই যা তো। যা।চলে যা।ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে।ছেলে নেই।

শশী তখন জন্মায়নি কৃষ্ণকান্ত হঠাৎই চলে গেলেন তার চার বছর আগে।চিকিৎসার সময়টুকুও পাওয়া গেল না।সবাই বলল সন্ন্যাস রোগ।
তিনি জানেন জীবন বড় বিচিত্র। গলির বাঁকের রাস্তা যেমন দেখা যায় না,তেমনি জীবনের বাঁকের ঘটনাও তেমন অজানা,অচেনা।
কৃষ্ণকান্ত মারা যাবার পর ধীরে ধীরে জীবন সম্বন্ধে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন বিধুরাণী।
বহরমপুরে সম্পত্তি দেখভালের জন্য শ্যামাকান্ত কাস্টমস অফিসের চাকরি ছেড়ে বাড়িতে থিতু হয়েছে।
শশীর জন্মের পর শিশুর কলতানে ভরে উঠেছে বাড়ি।বিধুরাণী বাঁচার সম্বল পেয়েছেন।

বাড়ির দাই মাকে আগেই বলা ছিল। গতকাল রাত থেকে বউমার পিঠে ব্যথা।আজ সকাল থেকে বার বার পায়খানা যাচ্ছে।এসবই তো প্রসবের লক্ষণ।
বাগ্দি পাড়ায় গিয়ে এখনই খবর দিতে হবে দাই মাকে।
কাজের মাসিকে দিয়ে দাই এর বাড়ি খবর পাঠালেন বিধুরাণী।
—– যা এক্ষুনি খবর দে দাইকে।বউমার আজ শরীর ভালো নেই।হয়তো আজই বাচ্চা হবে।

বিধুরাণী দেখলেন কাজের মাসি ডেকে এনেছে মায়া দাইকে।কালো মোটা গড়নে পেঁচিয়ে জনতা শাড়ি পড়ে ডাক দিল সে,কই কর্তা মা পোয়াতি কই?
বাচ্চার নাড়ি কাটার জন্য মায়া দাই এর হাতে কঞ্চির ধারালো টুকরো।

বাড়ির বাইরের দিকে একটা আতুর ঘর আছে। শশী হবার আগে মায়ের নির্দেশে সেই ঘর তৈরি করেছিল শ্যামাকান্ত। দশ ফুট বাই আট ফুটের ছোট ঘর,পাশে বাথরুম,পায়খানা,স্নানঘর।
একুশ দিন আঁতুরের পরে গঙ্গা স্নান করে আনন্দ অশৌচ থেকে শুদ্ধ হতে হয়।বাড়ির ঠাকুরমশাই ডেকে ষষ্ঠী পুজোর ব্যবস্থা করে তবে মা-ছেলেকে ঘরে তোলানো যাবে।
শশীর জন্মের সময় বিধুরাণী বলেছিলেন,একটা চৌকি পেতে দিবি।তার উপর এই কয়দিন শোবে বউমা।
রাত্রে বউমার পাশে সেবার বিধুরাণী ছিলেন।

এবার ঘরে আরেকটা বাচ্চা।তাকে সামলাতে হবে।সব ভেবেচিন্তে বিধুরাণী বউমার পাশে থাকার জন্য একটা সর্বক্ষণের মেয়ে ঠিক করেছেন।
সকাল থেকে সরমার শরীর ভালো নেই।বার বার পেচ্ছাপ পাচ্ছে,পায়খানা পাচ্ছে।শিরদাঁড়া জুড়ে টনটনে ব্যথা জানান দিচ্ছে প্রসবে দেরী নেই। নাভি জুড়ে তীব্র ব্যথা।
দাই মা সরমার পা ফাঁক করে দেখে বলল,এই তো জল ভেঙে গেছে কর্তা মা। তোমার নাতিপুতি হবার সময় হয়ে গেছে।শিগ্গীর এক গামলা গরম জল দিও আমাকে।
যন্ত্রনায় ছটফট করছে সরমা। নাভি থেকে তলপেটের দিকে ব্যথাটা ক্রমশঃ নামছে নীচের দিকে। নিজেকে সামলাতে পারল না সরমা। দাঁতে দাঁত চেপেও তীব্র কষ্টকে ভিতরে আটকে রাখতে পারল না ।
—– আঃ,আঃ।বাবা গো…মা গো।
—–বউ চাপ দাও নীচের দিকে।কুথ পার।হ্যাঁ…আরেকটু আরেকটু…

একরাশ রক্তজালিকাসহ বেরিয়ে এল একটা তুলতুলে পুতুল।কোঁকড়া চুল,বোঁজা চোখ….
—- ও কর্তা মা।তোমার নাতনি হয়েছে গো।শাঁখ বাজাও।তোমার ঘরে লক্ষ্মী এল যে!
দাই মা পিঠে আলতো ঠোকা দিতেই কেঁদে উঠল শিশু। কোঁয়া কোঁয়া ….চারিদিক মুখরিত।

গরম জলে বাচ্চাকে পরিস্কার করে মায়ের কাছে তুলে দিয়েছে দাই মা। কি অদ্ভুত নিয়ম।পেটে থাকতে বাচ্চা মায়ের নাড়িতে খাবার খাবে,পুষ্টি পাবে।আর যেই পৃথিবীর আলো দেখবে সে,সেই মায়ের নাড়ি থেকে ছিন্ন করে দিতে হবে তাকে।
সরমার বুকের হলুদ দুধে বাচ্চার মুখ লাগিয়ে দেয় দাই মা।চক চক করে বাচ্চাটা দুধ খাচ্ছে।
দাই মা আদর করে বলে,ওলে বাবালে কত খিদু পেয়েছে তোর?সারা দিন খাসনি বুঝি?

শ্যামাকান্তের কাছে খবর গেল ,সরমার মেয়ে হয়েছে।মেয়ে-মা দুজনেই ভালো আছে।
আজ ১৮ই আগস্ট।মুর্শিদাবাদ জেলা আজ আবার নতুন করে স্বাধীন হলো।কেউ চাইছিল না মুর্শিদাবাদ পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হোক।কত উদ্বেগ,কত অশান্তি!শেষে মুর্শিদাবাদ সেই ভারতেই থাকল।তার মেয়ে পয়মন্ত।দেরীতে হলেও স্বাধীনতার আসল সুখ বয়ে এনেছে সে সবার জন্যে….তার নাম হবে স্বাধীনতা…স্বাধীনতা ভট্টাচার্য্য।

1 thought on “আত্মজা **** কলমে সুদেষ্ণা সিনহা *** অধ্যায় -৬

  1. খুব ভালো লাগল সুদেষ্ণার লেখাটি পড়ে!
    – সত্যব্রত গুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *