# সীমান্ত # পর্ব – ৪ কলমে – অরণ্যানী
# সীমান্ত # পর্ব – ৪
কলমে – অরণ্যানী
পাখিদের কলরবে ওদের ফিসফাস কথার আওয়াজ বিজয়ের কানে গেল না। সে ওভাবেই বসে দূরে ওপারের জঙ্গলের দিকে চেয়ে আছে। ঘাটের একদম কাছে এগিয়ে এলো ওরা। তবুও বিজয় দেখতে পেল না।
মিনু — বিজয়দা।
বিজয় চমকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। ততক্ষণে ওরা ঘাটে এসে গেছে। বিজয় কবিতার হাতটা ধরে বসতে বললো। ভীষণ অস্বস্তিতে কবিতা মাটির দিকে চেয়ে রইল। মিনুও বুঝতে পারছে না ও কী করবে।
বিজয় – বসো।
মিনু — কে? আমি না কবিতা?
বিজয় একটু লাজুক হেসে বলল — দু’জনেই।
মিনু – তোমরা কথা বলো। আমি ঘাটে নেমে একটু চোখেমুখে জল দিই। যা তাড়াতাড়ি হেঁটে এসেছি – – – ঘেমে গেছি একদম।
মিনু ঘাটের সিঁড়ির কাছে গেল। দেখল, ঘাটের ভাঙাচোরা জলে ডোবা সিঁড়ির উপর থেকে একটা বড় মাছ ওকে দেখে দূরে সরে গেল। একটু দূরে গিয়ে জলের মধ্যে লাফও দিল। ছপাং করে একটা শব্দ হল। নদীর স্থির জল কেঁপে উঠল। মিনু জলে নেমে মুখ হাত ধুতে থাকল।
কবিতা ও বিজয় পাশাপাশি সবে বসেছে। কবিতার চোখ লজ্জায় মাটির দিকে। সূর্যাস্তের লাল রোদ মুখে এসে পড়েছে। বিজয় কবিতার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে। বিজয়ই প্রথম কিছু বলবে বলে ঠিক করছে।
মিনু — বিজয়দা, এই ঘাটে কত মাছ। তুমি এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিলে। যদি ছিপ নিয়ে আসতে তবে বড় মাছ উঠে যেত।
বিজয় মিনুর কথা শুনে ফিক্ করে হেসে ফেলল। কবিতারও ঠোঁটে মুচকি হাসি এলো। মিনু দেখল, নদীতে একটু দূরে দুটো বুনো হাঁস একসাথে সাঁতার দিচ্ছে। ও ঘুরে একবার কবিতাদের দিকে তাকাল।
বিজয় – কী, কিছু বলো।
কবিতা – কী বলবো?
বিজয় – আমি চিঠিতে যা জানালাম তার উত্তরে। লিখতে তো জানো। তবু চিঠির উত্তর তো দিলে না। তবে মুখেই কিছু বলো।
কবিতা মাটির দিকে তাকিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল মাটিতে ঘোষতে ঘোষতে খুব আস্তে করে বললো – আমি বলবো না। আমার লজ্জা করে।
মিনু নদীর জলে লাল মেঘের ছায়ার দিকে তাকাল। হাত দিয়ে লাল জলটাকে নাড়া দিল। একটু হাওয়া এসে ঘাটের ধারের গাছগুলিকে দুলিয়ে দিয়ে গেল। সেই হাওয়ায় ঝরে পড়ল কিছু শুকনো ও পাকা পাতা। ঘাটের ধারের বকুল গাছটা থেকে কিছু ফুল ঝরে পড়ল। মিনু চোখ বন্ধ করে হাওয়ার শীতলতাকে অনুভব করল। তারপর চোখ খুলে ঝরা ফুলগুলোর দিকে চাইল। আবার চোখ পড়ল কবিতাদের দিকে।
বিজয় – তবে হ্যাঁ বা না বলো।
কবিতা নিচু গলায় হ্যাঁ জানালো।
ওরা কথা বলছে দেখে মিনু চোখ সরিয়ে নিল। মিনু তাকাল বকুল গাছটার দিকে। যার উপর ঝাঁক ঝাঁক পাখি বসে কিচির মিচির করছে। হঠাৎই চোখ পড়ল একটি পাখির বাসায় দুটি পাখি ঢুকছে।
বিজয় একটু সরে এসে কবিতার একটা হাত ধরে নিল। কবিতার দেহ অসার হয়ে এলো।
বিজয় – তুমি লজ্জা কেন পাচ্ছ? তোমার হাত ঘামছে। ভয় করছে?
বিজয় দুটো হাত দিয়ে কবিতার ডান হাতটা ধরে রাখল। কবিতা কোনো কথাই বলতে পারল না। মুখচোখ অভিভূত হয়ে গেল। মনে মনে ইচ্ছে করল, বিজয় ওকে দু’হাতে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরুক।
ওপারের জঙ্গলে আঁধার নামল। শিয়ালের ডাক শোনা গেল। এপারের ঘাটে গোধূলি লগ্ন। শেষ সূর্যাস্তের হালকা লালচে আলোটুকু তখনও রয়েছে। মিনুর চোখ আবারও কবিতাদের দিকে গেল। মিনু দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। কেমন যেন বিহ্বল দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে রইল। একটু পরেই বিজয়ের খেয়াল হলো মিনুও আছে। বিজয় ধীরে ধীরে কবিতার হাতটাকে নিজের দু’হাত থেকে মুক্ত করে দিল।
কবিতা – সন্ধে হয়ে গেল। আবার পড়তে যাওয়া আছে।
বিজয় – ও, ঠিক আছে, এসো। কাল আসবে?
কবিতা – হ্যাঁ।
মিনুর দিকে চেয়ে বলল – চল্।
মিনুর ঘোর তখনও কাটেনি। মিনু চুপচাপ কবিতার দিকে এগিয়ে এলো। বিজয় তখনও ঘাটেই বসে।
কবিতা – তুমি বাড়ি যাবে না?
বিজয় – পরে যাব।
কবিতা – একটু পরেই তো সব মাতালরা এখানে আসবে।
বিজয় – তখন চলে যাব।
কবিতা ও মিনু দু’জনেই একটা ঘোরের মধ্যে দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে চললো। অল্প আঁধার নেমে গেছে ততক্ষণে।
মাস্টারদার বাড়ি :- একটা ছোট উঠোন। উঠোন থেকে উঠে একটা বারান্দা। বারান্দা পার হয়ে বাইরের ঘর বেশ বড়। অন্তত তিনটে ঘরের সমান।সেই বাইরের ঘরেরই একধারে উনুন, বাসন কোসন, ইত্যাদি রান্না খাওয়ার সরঞ্জাম। আর এক কোণে রাখা আছে নানা ধরনের বন্দুক, পিস্তল, ছোঁড়া ইত্যাদি অস্ত্র। আর এক কোণে গুটোনো অবস্থায় বড় বড় হাতে বোনা তাল পাতার চ্যাটাই। আর কাঠের তাকে রাখা আছে নানা শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক, খাতা, পেন, ও কিছু গল্পের বই। বাইরের ঘর পার হয়ে ভেতরে একটি ছোট ঘর। চৌকিতে বিছানা পাতা। একটা ছোট আলনায় জামাকাপড়। দেওয়ালের তাকে নানান নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস।
মাস্টারদার বাড়িতে পড়তে এসেছে পতু, পদ্মা, জবা, শ্যামলী, কবিতা ও মিনু। তাল পাতার চ্যাটাই বিছিয়ে ওরা বই খাতা নিয়ে গোল হয়ে বসে পড়ে। মাঝখানে মাস্টারদা। ওরা কেউ স্কুলে পড়ে না। মাস্টারদার কাছেই লিখতে পড়তে শিখেছে। মাস্টারদাই ওদের প্রশ্নপত্র তৈরি করে, পরীক্ষা নেয়, নম্বর দেয়। এইভাবে পরীক্ষায় পাশ করে করে ওরা তৃতীয় শ্রেণীতে এখন পড়ে। পদ্মা আর শ্যামলীর বয়স বাকিদের থেকে একটু কম। ওদের মধ্যে জবা সবচেয়ে চটপটে, চটুল প্রকৃতির এবং সদা হাস্যময়ী। গায়ের রঙ একটু কালো। কিন্তু চোখে মুখে ও চেহারায় একটা চটক আছে। সেটা স্বাস্থ্যের দীপ্তির কারণেও বটে। দেখলেই বোঝা যায় সবল প্রকৃতির মেয়ে।
মাস্টারদার বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। বেশ লম্বা, স্বাস্থ্যবান ও পুরুষালী ব্যক্তি। সঠিক সৈনিকের চেহারা। যুদ্ধের সময় সৈনিক হিসাবে সেনাদলে যোগ দেন। তাদের গ্রাম মাদুরা আক্রান্ত হলে গ্রামের মানুষদের নিয়ে গণসেনা গঠন করে গ্রাম বাঁচানোর সংগ্রামে সেনাপতিত্ব করেন। যোদ্ধা হিসাবে মাস্টারদার নাম আশপাশের অনেক মানুষের কাছেই পরিচিত। তিনি গ্রামের ছেলে মেয়েদের অস্ত্রশিক্ষা দেন, লেখাপড়াও শেখান যারা স্কুলে পড়ে না তাদের। গ্রামের এবং আশপাশের গ্রামের অনেকেই তাকে মানিগণ্যি করে। অবিবাহিত যুবক। একাই থাকেন। বাবা, মা বা কোনো আত্মীয়ও তার নেই। কোন এক যুদ্ধের সময় গ্রামে গণসেনা গঠনের জন্য তার উদয় হয়। তারপর থেকে তিনি বাড়ি করে এ গাঁয়েই থেকে গেছেন।
সন্ধ্যাবেলা মাস্টারদার বাড়িতে পড়াশোনা চলছে।
জবা – মাস্টারদা, আগে কী পড়ব? অঙ্ক করব?
মাস্টারদা – হ্যাঁ, তাই কর।
সকলের মধ্যে একটা ফিসফাস গুঞ্জন শুরু হলো।
পতু – আগেই অঙ্কটা বের করতে হলো? এখন সবে সন্ধে। কতগুলো অঙ্ক করতে হবে কে জানে। ওর আদিখ্যেতা।
কবিতা – মিনু, আমি যদি ভুলে যাই? আমাকে দেখাবি তো?
মিনু – ঠিক আছে। তুই তো পাশেই বসেছিস। পাশ থেকে দেখে নিবি।
পতু উঠে গিয়ে মিনুর আর এক পাশে বসতে গেল। ওই পাশে পদ্মা বসেছিল।
পতু – এই সর্। আমি ওর পাশে বসব।
পদ্মা – না, যে যেখানে আগে বসেছে, সেখানেই বসবে।
পতু – আমরা বন্ধু।
পদ্মা – আহা, বুঝি না যেন। অঙ্ক দেখবে বলে এখন বন্ধু।
পতু – হিংসা করছিস কেন?
মাস্টারদা – কী হলো? তোরা উঠে উঠে এদিক ওদিক করছিস কেন?
জবা – অঙ্ক দেখবে বলে।
পতু – চুপ কর। ভুল যেন তুই করিস না। কতই যেন পড়াশুনোয় ভালো।
জবা – আমি কি বলেছি আমি ভালো?
মাস্টারদা – প্রতিমা, নিজের জায়গায় গিয়ে বস। আর ঝগড়া করবি না। সবাই একটু ছেড়ে ছেড়ে বসতো। অনেক জায়গা আছে।
এভাবে মাস্টারদার শাসনে ওদের লেখাপড়া চলতে লাগল।
এক সময় মাস্টারদা কবিতাকে জিজ্ঞেস করলেন – হ্যারে কবিতা, তুই দু’দিন আসিসনি কেন? কোথায় গিয়েছিলি?
কবিতা – মামার বাড়ি।
মাস্টারদা – বলেছি না, এখন একদম কামাই করবি না। আর দু’দিন বাদে আমি পরীক্ষা নেব। দু’দিন অস্ত্রশিক্ষাও প্র্যাকটিস করিসনি। আমি এবার অস্ত্রশিক্ষারও পরীক্ষা নেব। অস্ত্রশিক্ষার সময় একদম কেউ কামাই করবি না। অস্ত্রশিক্ষা না নিয়ে এখন কেউ মামার বাড়ি, মাসির বাড়ি, দিদির বাড়ি কোথাও যাবি না। এরপরও যে কামাই করবে তাকে আমি কান ধরে এক ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখব, আর একশো বার ওঠবোস করাবো। মৃন্ময়ী, তুই তো বাড়িতেই ছিলি। অস্ত্রশিক্ষা নিতে আসিসনি কেন?
মিনু একবার মাস্টারদার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল।
মাস্টারদা — কিরে, কিছু বলছিস না যে? তুই তো এমনিতেই অর্ধেক দিন অস্ত্রশিক্ষা নিস না। জানি পড়াশুনোটা ভালো পারিস। কিন্তু যে কোনো দিন যুদ্ধ লাগতে পারে। তখন কী করবি? অন্তত নিজেকে বাঁচাতে তো শিখতে হবে।
মিনু চুপচাপ গম্ভীর মুখে বসে। চোখ ছলছল। চোখের সামনে ভেসে উঠল দু’হাতে তুলে নেওয়া আদরের লুল্লু, যাকে পড়তে আসার আগে দুধ বিস্কুট খাইয়ে এসেছে সেই ছবি।
মাস্টারদার কথা শুনে অন্যরাও নড়েচড়ে বসল।
পতু – আমার কী ভয় লাগছে। সত্যিকারে যুদ্ধ কি আমাদেরও করতে হবে? নাকি দাদারা করলেই হবে?
কবিতা – শেখাচ্ছে তো সবাইকেই। দাদারা সামনে থেকে করলে আমাদের তো পেছন থেকে হলেও করতে পারতে হবে।
জবা হাসতে হাসতে বলল – ওরা দেখো, যুদ্ধের কথা শুনে এখন থেকেই কী করছে। আচ্ছা মাস্টারদা, আমি কতটা যুদ্ধ করতে পারব মনে হয়?
মাস্টারদা – বেশ সময় দিয়ে ভালো করে শিখলে তো মনে হয় তোর হবে।
জবা সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল – কী হবে গো?
মাস্টারদা – ভালো করে শিখতে পারলে গণসেনায় যোগ দিবি?
জবা – মেয়েছেলেরা সেনা হয়?
মাস্টারদা – কেন হবে না? হয় তো অনেকে।
জবা – না, মানে আমাদের মতো মেয়েরা।
মাস্টারদা – হ্যাঁ। তারাও তো মেয়েই নাকি? সেছাড়া গণসেনায় তো থাকবে তোদেরই কারো বাবা, কাকা, দাদারা। তারা যখন প্রাণপণে গ্রাম বাঁচানোর লড়াই করবে তখন অস্ত্রশিক্ষায় ভালো হলে তাদের সঙ্গে থাকবি না?
জবা – হ্যাঁ, তুমি যদি নাও তাহলে থাকব।
ওদিকে পতু, পদ্মা, শ্যামলী, কবিতারা জবাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করল।
পদ্মা – ওই দেখ্, শুরু হয়ে গেল ঢলানো।
সকলে হাসল। তবে ওরা ফিসফাস করেই কথা বলছিল, আর নিঃশব্দেই হাসছিল।
পতু – ওর জামাটা দেখেছিস? ইচ্ছা করে সামনে ঝুঁকেছে, আর সব দেখা যাচ্ছে।
(ক্রমশ)