বিবাহবার্ষিকী
মৌসুমী
ভীষন যত্নে চুল বাঁধলো মালিনী।। বরাবরের মতো হালকা ফাউন্ডেশন, চোখে নীচে গাঢ় কাজল আর আইলাইনার । । ঠোঁটে মেরুন রঙের লিপস্টিক।যদিও শতরুপের ভীষন প্রিয় মালিনীর পাতলা ঠোঁট দুটো।।তাতে লিপস্টিক থাকুক আর না থাকুক।। কিন্তু মালিনীর সাজতে ভীষন ভালো লাগে,তাই পঞ্চাশের উপর বয়স হয়েও বুড়ি হয়ে থাকতে পচ্ছন্দ নয় মালিনীর।। কিছুক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো একা একাই মালিনী।।
শতরুপের একটা দুষ্টু স্বভাব আছে।। সারারাত নাক ডেকে ঘুমাবে আর ভোর হতেই মালিনী কে জড়িয়ে থাকবে।। অবশ্য শতরুপের স্পর্শ মালিনীর ভীষন প্রিয়।। জীবনের অনেক টা কঠিন, দুর্গম পরিস্থিতি গুলো পেরিয়ে এসে এখন দুজন একসাথে,এক বিছানায়।।তাই মুহুর্তগুলো কেউই নষ্ট করতে চায় না।।যদিও শতরুপ,মালিনীর থেকে বছর দশেক বড়, তবে ভালবাসার জন্য বয়স নয় মনের প্রয়োজন।।
“আজ সন্ধ্যায় তৈরি হয়ে থেকো মানি,একটু কাজ আছে সেরে তাড়াতাড়ি ফিরবো, দুজন আজ বাইরে ডিনার করবো” ভোরে মালিনীর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে কথাটা বলছিল শতরুপ ।। ভীষন অবাক হয়ে গেল মালিনী,কেন এই ঠান্ডায় কোথায় যাবে তুমি রাতে?একটু তেই তো ঠান্ডা লাগিয়ে বসো তুমি।।শতরুপ মালিনী কে আদর করতে করতে বলল,না মানি,আজ কিছু হবে না।। তুমি তৈরী হয়ে থেকোই না।।আলগা হেসে আহ্লাদী চোখে শতরুপের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে মালিনী বলল,বেশ, তৈরি হয়ে থাকবো,স্যার।।।
শতরুপ যখন একাই থাকতো নিজেই নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতো।। কিন্তু মালিনী ওর জীবনে আসার পর রুমাল টাও হাতে ধরিয়ে দিতে হয়।।যদিও মালিনীর কাছে ওই কাজগুলো কাজ নয়, সৌভাগ্য ,অনেক গুলো বছরের অপেক্ষার পর পাওয়া।। আগের জীবন টা তার পুরো অন্য রকম ছিল।।স্ত্রী হওয়ার যে এত সুখ অতীতের কেটে যাওয়া সময়ে মালিনী বুঝতে পারে নি কখনো।। শুধু অপমান আর তাচ্ছিল্য জুটেছিল তার কপালে।।
নাহ! সেই মুহুর্ত গুলো মনে করতো চায় না মালিনী।। নিজেকে ব্যস্ত রাখে সবসময় যাতে প্রাক্তন স্বামী শৈবালের সমস্ত আচরণ ভুলে থাকতে পারে।।সব কথায় দোষ দেওয়া, সকলের সামনে সব বিষয়ে অপমান, অল্পতেই গায়ে হাত তোলা,না না এগুলো আর মনে রাখতে চায় না মালিনী।।শতরুপ পচ্ছন্দ করে না।।তবু বর্তমানের আলোর মাঝে অতীতের কালো ছায়া কিছুতেই পেছন ছাড়ে না।।
স্বামী শৈবালের মৃত্যুর এক বছর পর যখন তার একমাত্র ছেলে মালিনী কে একা রেখে বিদেশ চলে যায় তখন শতরুপ তার সাথে যোগাযোগ করে।। শতরুপের সাথে মালিনীর আলাপ কত বছর আগে কিভাবে হয়,সে কথা থাক, তবে দশ বছর পর শতরুপ নিজেই মালিনীর সাথে যোগাযোগ করে সে কথাটা খুবই গুরুত্বপূর্ন।।
কফি শপের আলো আঁধারিতে শতরুপ মালিনীর হাতের উপর হাত রেখে বলেছিল,”চল মানি, একসাথে থাকি, এই শহর থেকে অনেক দূরে”।।মালিনী আশা করে নি শতরুপ তাকে এমন প্রস্তাব দিতে পারে, তাও যখন তার বয়স পঞ্চাশ।। এত কি ভাবছিস মানি, এক সাথে নতুন করে জীবন শুরু করতে বয়স নয় মনের দরকার হয়।।তোর জীবনের যতগুলো সময় নষ্ট হয়েছে,আর আমার জীবনের যতগুলো সময় নষ্ট হয়েছে,চল ভুলে গিয়ে একটু বাঁচি দুজনে।।
শতরুপের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়নি মালিনী সেদিন।। মনস্থির করে নিয়েছিল,হ্যা বাঁচবে,সে আবার নতুন করে শুরু করবে,একুশ বছর টা ফিরে আসবে না আর কিন্তু পঞ্চাশেই শতরুপের সাথে বাঁচবে সে।। শতরুপের কাছেই তো হাসতে পারতো, কাঁদতে পারতো,মান, অভিমান,জেদ সবটুকুই করতে পারতো তবে ফেরাবে কেন তাকে?।। তারপর এক ফোঁটা সিঁদুর শতরুপ নিজের নামে মালিনীর সিঁথি রাঙিয়ে দিয়েছিল,একটা সুন্দর ঘর আর তার অনেক ভালবাসা,আদরে মালিনীর পঞ্চাশ বছরেই একুশ টা বসন্ত ফিরিয়ে দিলো।।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো, মালিনী ফোন টা ধরতেই ওদিকে থেকে শতরুপের কন্ঠ”শুভ বিবাহবার্ষিকী মানি,ভুলে গেলি একবছর আগে ঠিক এই দিনেই তো দুজন একসাথে নতুন জীবন শুরু করেছিলাম।।তুই তৈরি তো! মালিনী ঠোঁটের কোণে আলতো হাসি হেসে বলল, তৈরি সোনা, তাড়াতাড়ি এসো!”
ফোনটা রেখে মালিনী হোহো করে হেসে উঠলো,শতরুপ মুখার্জি সারা পৃথিবীর প্রতিটা নারী পুরুষ কে তুমি, আপনি করলেও মালিনী কে ব্যক্তিগত ভাবে “তুই ” ডাকা স্বভাব টা যাবে না কখনো।।
আবেগঘন মুহুর্তের তুই ডাক টাই তো বড্ড কাছের,বড্ড আপন, শুধুই উপলব্ধি করতে হয়,যা বাহ্যিক জগত থেকে পুরো আলাদা।।ওই “তুই”ডাকে পঞ্চাশের বুড়িও একুশের কলেজ ক্যাম্পাসের যুবতী হয়ে যায়।।
পঞ্চাশের নারী মেনোপজের সময় এসেও হৃদয়ে প্রেমের ঝর্ণা ধারা আনতেই পারে।। তাতে ক্ষতি কার?