৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ

~ শান্তনু ঘোষ পর্ব-১১

দুটি কথা,
আনন্দের বিষয় যে, কিছুদিন বিরতির পরে, দিনাজপুর ডেইলি আবার স্বমহিমায় ফিরে এসেছে। শ্রীমতী গীতশ্রী সিনহা কে এর জন্য কৃতিত্ব জানাতে হয়। তাঁর অদম্য উৎসাহ ও পরিশ্রমেই তা সম্ভব হয়েছে।
সুধী পাঠকবৃন্দকে জানাই আমার অন্তরের কৃতজ্ঞতা। আপনাদের ভালোবাসা ও ভালোলাগাকে পাথেয় করেই “৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ” লেখাটি আবার ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে চলেছে। আপনারা আগের মতই উৎসাহ প্রদান করবেন।

আগে যা ঘটেছে:
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেখে আমরা চলে গেলাম পদ্মা নদীর পাড়ে । আমরা চা নিয়ে সামনে পড়ে থাকা খালি আরাম কেদারার উপর বসে সূর্যাস্তের মায়াবী সোনালী রং মাখা পদ্মার জল দেখছি। ধীরে ধীরে সূর্য ঢলে যায়। এবার উঠতে হবে। হাতে সময় নেই। এখন যাব রাজশাহীর একটি বড় সিল্ক ফ্যাক্টরি। তাই উঠে পড়লাম।

তারপর…
আমার বন্ধু আমাদের রাজশাহীর সপুরা সিল্ক মিলস-এ নিয়ে এসেছে। অনেকটা জায়গা জুড়ে এই সিল্ক মিল। বেশ প্রশস্ত গেট দিয়ে আমাদের গাড়ি ঢুকে এক বড় পারকিং লটে দাঁড়ালো।

নামতেই সামনে দেখছি খুব বড় এক তিনতলা বিল্ডিং। অনেকটা সল্টলেক সেক্টর ফাইভের ঝকঝকে অফিসগুলির মত দেখতে। আলোয় বেশ সুন্দর করে সাজানো। মাথার উপরে আধুনিক আলো দিয়ে লেখা SPOURA SILK MILLS LTD. এটা ওদের শপিং সেন্টার ও অফিস। এখানেই সিল্কের তৈরি যাবতীয় সামগ্রীর পসরা সাজানো আছে। সবই এই ফ্যাক্টরির তৈরি। তবে রাজশাহী তে এমন আরো কয়েকটি বড় বড় সিল্ক ফ্যাক্টরি আছে।

আমার দৌড় – ট্র্যাংগুলার পার্কের “আদি ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়, পুরোটাই শাড়ি” পর্যন্ত। এর বেশী কিছু দেখি নাই। তাই এহেন বিশাল সিল্ক-মিল-সপ দেখে বেশ পুলকিত।

এই শপিং সেন্টারের ডান দিকে আছে এদের সিল্ক তৈরির কারখানা। সেখানে রেশমগুটিপোকার চাষ থেকে শুরু করে রেশমের সুতো ও রেশমের কাপড় তৈরি পর্যন্ত সবই হচ্ছে। আমরা আগে ওখানেই যাচ্ছি।

একজন কর্মী এগিয়ে এলেন। নাম মহম্মদ ভাদু সেখ। বললেন, আসেন আসেন, এইদিকে। এই বলে আমাদের নিয়ে এলেন রেশম চাষের ঘরের দিকে।

আমরা ওনার সঙ্গে সঙ্গে একটি লম্বা ঘরে এসেছি। এখানে উনি এক এক করে দেখাচ্ছেন শুঁয়োপোকা থেকে কিভাবে ধাপে ধাপে রেশম সুতো তৈরি করা হচ্ছে।

একটা কাঠের বড় ট্রের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সবুজ তুঁতে পাতা। তার গায়ে গায়ে লেপ্টে আছে সাদা রঙের শুঁয়োপোকা। সাধারণ শুঁয়োপোকার থেকে আলাদা। এগুলোই হল ভবিষ্যতের সুন্দর কোমল রেশমের স্টার্টিং পয়েন্ট।

এই পোকাগুলো ২৮ দিন থাকে এই পাতার মধ্যে। পেটপুরে পাতা খায়। একসময় খওয়া বন্ধ করে দেয়। তারপর মুখের লালা দিয়ে ৪৮ ঘটার মধ্যে নিজের চারদিকে এক সুন্দর রেশমগুটি (কোকুন) তৈরি করে নিজেকে তার ভিতরে আবদ্ধ করে রাখে। পোকাবাবুর প্ল্যান হল যে ঐ কোকুনের মধ্যে থেকে সে প্রজাপতি হবে এবং বেরিয়ে এসে উড়বে।

কিন্তু উড়তে চাইলেই তো আর তাকে উড়তে দেওয়া যায় না। পোকার যাই প্ল্যান থাকুক না কেন। মানুষের প্ল্যান হল অন্য কিছু।

জীবনে যেমন দেখি, আমাদের যাই পরিকল্পনা থাকুক না কেন, অদৃশ্য কেউ হয়ত অন্য কোন প্ল্যান করে রেখেছে। তাই তো অনেকেরই জীবনে ওড়ার স্বপ্নের অকাল মৃত্যু হয় জীবনের কোন এক কোকুনের মধ্যে। আমরাও তো কারো হাতের পতঙ্গ।

এখানে মানুষ অনেক কঠিন। রেশমগুটি তৈরি হয়ে গেলে তাকে গরম জলে ফুটিয়ে ভিতরের প্রাণিটিকে হত্যা করা হয়। যাতে পোকাটি ঐ গুটি কেটে বেরিয়ে না আসে। কারণ গুটি একবার কেটে ফেললে সিল্কের টানা সুতো আর তৈরি করা সম্ভব হবে না। তাই নীরব নির্মম হত্যা। আহা কি মনোরম উপকারী নিষ্ঠুর কর্ম। একটা গুটি থেকে ৪০০-৫০০ মিটার লম্বা সিল্কের সুতো পাওয়া যায়।

কিন্তু এখানেই সুতো তৈরি শেষ নয় কিন্তু। একটা গুটির সুতো এত সরু আর পাতলা যে ওটা দিয়ে তেমন কিছুই হবে না। তাই এইরকম ৮-১০ টা গুটির সুতো একসাথে পাকিয়ে একটা ব্যবহারযোগ্য সিল্কের সুতো তৈরি করা হয়।

তবে মানুষ অতটাও নিষ্ঠুর নয়। কয়েকটা প্রজাপতি বাঁচিয়ে রাখা হয়। কারণ, পরে তাকে আবার কাজে লাগাতে হবে যাতে বংশ বিস্তার করতে পারে।

সেই প্রজাপতিগুলো দিয়ে ডিম পাড়ানো হয়। এক একটি প্রজাপতি ৪০০-৫০০ ডিম দিয়ে মৃত্যু বরণ করে। সেই ডিম ফুটিয়ে আবার আসবে শুঁয়োপোকা। এভাবেই চলবে রেশম উৎপাদন।

গুটি চাষের ঘর থেকে বেরিয়ে এবার ঢুকছি সিল্কের কাপড় তৈরি কারখানায়। এও এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা।

আমি বাংলায় তাঁত দেখেছি। কিন্তু এর আগে সিল্কের কাপড় তৈরি করা আমি দেখিনি। এখানে মেশিনে কাপড় তৈরি হচ্ছে। একরকম সেমি-অটোম্যাটিক ব্যবস্থা।

অনেকগুলো স্পুল থেকে সুতো এসে মেশিনের মধ্যে একত্র হচ্ছে । তাঁদের একসূত্রে বাঁধছে আড়াআড়ি আর একটি সুতো। একটি স্পিন্ডল সেই একটি সুতো বহন করে বাকি সুতোগুলিকে বন্ধনে আবদ্ধ করে। তৈরি হয় কাপড়।

আমাদের জীবনেও এমন স্পিন্ডল বড় প্রয়োজন। তা থাকলে বাঁধন সম্ভব হয়। দৃঢ় হয়। আগেরকার দিনে ঠাকুমা-দাদুরা এমনই ছিলেন। তাঁরা পুরো পরিবারটিকে এমনই স্পিন্ডল এর মত এমাথা-ওমাথা বেঁধে রাখতেন। তাঁরা যত চলে যাচ্ছেন, বাঙ্গালীর পরিবারের বাঁধন তত আলগা হয়ে যাচ্ছে।

এই কারখানাটা খুব বড় নয়। জনা পঁচিশ পুরুষ-মহিলা কাজ করছেন। বেশ খানিকক্ষণ এসব দেখে এবার যাচ্ছি এদের শোরুমে। সেখানে আছে সিল্কের নানা পসরা।

কারখানার থেকে শোরুম অনেক বড়। তিন তলা বিল্ডিং। আর বলাই বাহুল্য আলোয়, সাজ-সজ্জায় ঝলমলে। খুব সুন্দর করে, ভেবে সাজানো। এক-এক তলায় এক-এক ধরনের জিনিস। পুরুষদের ও মহিলাদের জিনিসের ভিন্ন ভিন্ন কাউন্টার। অনেক শাড়ি, বিভিন্ন দামের শাড়ি, বিভিন্ন ধরনের শাড়ি, চাদর, মহিলাদের জামা ও জামার কাপড়, স্কার্ফ, অন্যান্য জিনিস, পুরুষদের শার্ট, পাঞ্জাবী, ইত্যাদি ইত্যাদি। সব মিলিয়ে খালি হাতে ফিরতে ইচ্ছে করবে না। দাম মানানসই।

রাজশাহীতে সিল্কের উৎপাদন বহুদিন আগে থেকেই চালু আছে। প্রাকৃতিক কারণে এই অঞ্চলে সিল্ক-মথ চাষ ভালো হয়। যেমন আছে এপার বাংলায় মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদাবাদ সিল্ক যেমন নামকরা, তেমনই রাজশাহী সিল্ক। আর লক্ষণীয় যে ভৌগলিক অবস্থানে এপার বাংলার মুর্শিদাবাদের পাশেই অপার বাংলার রাজশাহী। ভাগ তো আমরা করেছি। প্রকৃতি তো একই আছে।

দেখা, কেনা সব হল। এবার ফেরার পালা। রাত হয়েছে। রাজশাহীর বন্ধুকে একরাশ ধন্যবাদ জানালাম। যদিও তা যথেষ্ট নয়। সারাদিন সে আমাদের জন্যই ব্যয় করেছে। খুব ভালো লাগলো আমাদের। তাকে বিদায় জানিয়ে আমরা আবার পাবনার পথ ধরলাম।

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *