৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ ~ শান্তনু ঘোষ
৬০ টাকায় বাংলাদেশ – আমার অন্য পথ
~ শান্তনু ঘোষ
পর্ব-১০
আগে যা ঘটেছে:
নাটোরের রাজবাড়ি দেখে রাজশাহী যাবার পথে একটু উঁকি দিলাম পুঠীয়ার রাজবাড়িতে। সুন্দর এক রাজবাড়ি। তবে যত্নের প্রয়োজন। এ ধরনের সৌধগুলীর এক ঘটনাবহুল অতীত থাকে। তার কিছুটা জানা, অনেকটাই অজানা। এই জানা-অজানার আলো-আঁধার জানতে যতটা অধ্যবসায় ও সময় দিতে হবে, তা এই মুহূর্তে আমাদের দ্বারা হচ্ছে না। তাই চটপট দেখে ঝটপট গাড়িতে চড়ে রাজশাহী রওনা দিয়েছি।
তারপর…
বেলা অনেকটা হয়ে গেছে। ১টা বাজতে চলল। পুঠীয়ার রাজবাড়ি দেখে এগিয়ে চলেছি । আমাদের প্রায় ঝটিকা সফর চলছে। আজই রাজশাহী দেখে আবার রাতে পাবনায় ফিরতে হবে। তাই তাড়া আছে। কিন্তু তাড়াহুড়ো নেই। হাল্কা মেজাজে চলছি। যতটুক দেখা সম্ভব তাতেই খুশি। খুব ইচ্ছে হলে, না হয় আবার আসব।
আমি দেখেছি জীবনে প্রয়োজনের তুলনায় বেশী লম্ফ-ঝম্ফ করে বিশেষ কোন লাভ হয় না। কোন এক জায়গায় আমাদের সময়ের হিসেব আগে থেকেই ঠিক করে রাখা আছে।
এই বিষয়ে আমার নিজস্ব এক খ্যাংরা ব্যাখ্যা আছে। অনেকেই বেশ অপছন্দ করে। তাতে আমার বিশেষ সমস্যা হয় না। আমার মোটা মাথার মতে, জীবনের সব থেকে টেনশন হল “ভবিষ্যৎ”। কারণ ওটাই আমাদের অজানা । কিন্তু তা বলে “আমাদের অজানা” ভবিষ্যতটা তৈরি হয়ে নেই, এমনটা নয়। ওটাও রেডি করা আছে। শুধু সামনে আসা বাকি। অনেকটা সিনেমা হলে সিনেমা দেখার মত। পরের সিন কিন্তু প্রস্তুত। শুধুমাত্র সামনের পর্দায় উপরে পড়ার অপেক্ষা। জীবনের ভবিষ্যতের ঘটনাগুলিও তেমনি ভাবেই তৈরি করা আছে। শুধুমাত্র বর্তমানের পর্দায় আবির্ভূত হওয়ার অপেক্ষা মাত্র।
এখন তাত্ত্বিকগণ প্রশ্ন করবেন, সবই যদি ঠিক হয়েই আছে, তাহলে আর এত কর্মকান্ড কেন বাপু ! হাত গুটিয়ে ভবিষ্যতের অপেক্ষায় বসে থাকলেই হয়। এ তর্কের বিষয় নয়, গভীর অনুধাবনের বিষয়।
হাজার হাজার বছর আগেই, মাথায় ময়ূরের পালক পরা এক ভদ্রলোক, তার বন্ধু অর্জুনকে এ ব্যাপারে পরিষ্কার বলে গেছেন । অত বড় বীর অর্জুনবাবু তো যুদ্ধের আগেই ভবিষ্যতের আগডুম বাগডুম কথা ভেবে হাত থেকে অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ধপাস বসে পড়লেন। তাঁর নাকি গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। তখন তার সখা এক লম্বা লেকচার দিয়ে বললেন। এসব নিয়ে বেশী ভাবতে হবে না তোমাকে। আমি আগে থেকেই সব সেট করে রেখেছি। তুমি শুধু আক্টো করে যাও। যদিও যুদ্ধের ভবিষ্যৎ তার জানা ছিল, তাও তিনি একবারও অর্জুনকে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে বলেননি।
কথাগুলো নেহাত মিথ্যে নয়। তেমন হলে এত কাল পরেও তা সমুজ্জ্বল থাকত না। কিন্তু আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে চট করে বুঝে উঠতে পারিনা। একটু ভাবতে হয়। তবেই অন্তর্নিহিত অর্থ পরিষ্কার হয়।
সে যাই হোক। সেই লেকচার নিয়ে পরে একটা বই লেখা হয়ে গেল। ১৮ টা চ্যাপ্টার আর ৭০০ টা শ্লোকের ওই বইটা কিন্তু দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জীবন দর্শন বা ম্যানেজমেন্ট কিতাব। কপিরাইট নেই বলে, আমাদের দেশে তো বটেই পশ্চিম দুনিয়ারও ধর্ম প্রচারক, লেখক, ম্যানেজমেন্ট গুরুরা ওই বই থেকে স্রেফ টুকে নিজেদের নামে নির্লজ্জের মত চালিয়ে দিয়েছে এবং দিচ্ছে। কিছুদিন আগেও অ্যালকেমিস্ট বইটা পড়ার পরে অনেক খুঁজে দেখলাম যে পাওলো বাবু কোথাও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছেন কিনা।
এবার কোথাও না থেমে সোজা ঢুকে পড়েছি রাজশাহী শহরে। আর পাঁচটা শহরের মতই লাগছে। রাস্তায় গাড়ি-লোক-ভীড়। তবে অবিন্যস্ত ট্রাফিক। নিয়ন্ত্রণ আছে, আবার কোথাও নেইও।
প্রায় দুটো বাজে। আমারা প্রথমেই যাব এক বন্ধুর বাড়ি। সে আমাদের রাজশাহী ঘুরিয়ে দেখাবে বলেছে। তার আগে তার বাড়িতে দুপুরের আহার গ্রহন করা।
এবার মুশকিল হল সেই বন্ধুর হদিশ পাওয়া। তাকে তো সামনা-সামনি কোনদিন দেখিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় পরিচয়। স্বাভাবিক ভাবেই তার বাড়ি চিনি না। এখন একমাত্র উপায় মোবাইল ফোনে যোগাযোগ। আমার ফোনটা তো ইন্টারন্যাশনাল রোমিংএ আছে। ফোন করছি। কুঁ কুঁ আওয়াজ করে। কোন উত্তর পাচ্ছি না। মহা জ্বালাতন। বলেছিল, রাজশাহী রেল স্টেশনের সামনে এক জায়গায় সে দাঁড়াবে। আমারা গাড়ি নিয়ে সেদিকে এক পাক ঘুরে এলাম। তাকে দেখতে পাইলাম না। অবশেষে কৌস্তভের লোকাল ফোন থেকে বার কয়েক ফোন করে তাকে পাওয়া গেল।
এবার তাকে খুঁজে পেয়ে চলেছি তার বাড়ি। শহরের মধ্যেই বেশ সুন্দর তিনতলা বাড়ি। পাড়াটি বেশ শান্ত। অনেকটা যাদবপুর এলাকার ঘরোয়া পাড়াগুলোর মত।
আমাদের দেখে সে তো আনন্দে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। খুব উত্তেজিত। আতিথেয়তার ত্রুটি নেই।
কেবলই বলছে, এত দেরী কেন করলে, আমি তখন থেকে অপেক্ষা করছি। হাতে তো আর বেশী সময় নেই। রাজশাহী ভালো করে দেখতে হলে আরও সময় প্রয়োজন।
সময় যে প্রয়োজন তা তো আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু কি আর করা।
তাই কথা না বাড়িয়ে খেতে বসে গেছি। সুস্বাদু রান্না হয়েছে বলেই বোধ হচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি কৌস্তভ চিকেনটা পুরো সাফ করছে। আমি অবশ্য নিরামিষ।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমেই যাচ্ছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রাচীনতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেই হিসেবে এই ভূখন্ডের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।
বিরাট বড় ক্যাম্পাস। ভিতরে সুন্দর পিচের রাস্তা। দুই ধারে প্রচুর গাছ। সবুজ। সুন্দর। চারদিকে নানা রংয়ে, নানা রঙ্গে, যৌবন-তারুণ্য থোকা থোকা ঘুরছে, বসে আছে, আড্ডা দিচ্ছে। আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট, তবে যাদবপুর বা সেন্ট জেভিয়ার্স-এর মত ট্যাঁশ ব্যাপারটা নেই। আছে জিন্স, আছে শাড়ি, আছে হিজাব, আছে বোরখা।
বন্ধু এই বিশ্ব বিদ্যালয়েই লেখাপড়া করেছে। তার কাছেই জানলাম যে, পনের-বিশ বছর আগেও শাড়ির চলই প্রধান ছিল এখানে। এখন ধীরে ধীরে দেখতে পাওয়া যায় হিজাব-বোরখার আধিক্য । বাংলাদেশের বাঙ্গালীরা কি সত্যি তাহলে উত্তরণের পথে !
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি পবিত্র স্মৃতি সৌধের সামনে। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে যাঁরা মৃত্যু বরণ করেছেন, তাঁদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি উৎসর্গীকৃত এই সৌধ। নীচে জুতো খুলে আমরা বেদীর উপরে উঠলাম। কৌস্তভ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করল। ফুলের গুচ্ছটি অবশ্য আমার বন্ধু আগেই আমাদের হাতে দিয়ে দিয়েছিল।
এই সৌধের সামনে খোলা মাঠ। অনেক মানুষ আড্ডা দিচ্ছে। বেশীরভাগই মনে হচ্ছে ছাত্রছাত্রী। সৌধের পেছনে একটু দূরে দেখতে পাচ্ছি ইউনিভার্সিটি কাফেটেরিয়া। সৌধের মাঠের এক পাশে বেদীর উপরে রাখা আছে একটি পুরানো জীপ গাড়ির ধ্বংসাবশেষ। ঠিক তার পেছনেই আছে শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা।
এই জীপ গাড়ির একটা ইতিহাস আছে।
বাংলাদেশ হবার আগে তখন অত্যাচারী পাকিস্তানীদের শাসন চলছিল। সেই সময় সেনারা এই গাড়িটি করেই রাজশাহীর বহু মুক্তিযোদ্ধা, দেশ প্রেমিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, নারী-পুরুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মম হত্যা করত। তারপর স্বাধীন বাংলাদেশ হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সুন্দর পরিবেশ ফিরেছে। সেই জীপের ধ্বংসাবশেষ এখন এখানে রাখা হয়েছে সেই বীভৎসতার সাক্ষী হিসেবে।
কিন্তু সেই কালো দিনগুলো।
শুনলাম এখন কেমন করে ধীরে ধীরে আবার মৌলবাদীদের প্রভাব বাড়ছে। তাঁর আঁচ অনেকেই পাচ্ছে। কিন্তু ভয়ে মুখ বন্ধ। এবার কিন্তু আর পাকিস্তানী নয়। এরা বাংলাদেশী বিভেদকামী।
সৌধের সামনেই অনেকটা জায়গা জুড়ে বিশাল ও সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব মসজিদ। হাল্কা নীল রঙের। বাংলাদেশে হয়ত সব সরকারী প্রতিষ্ঠানেই মসজিদ আছে। নিয়ম অনুযায়ী নামাজ পড়ার ব্যবস্থা আছে। ইসলাম ধর্মের এই নিয়ম করে নামাজ পড়া ও এই ধর্মের অনুসারিদের তা পালন করা, এই নিয়মানুবর্তিতাকে আমি প্রশংসা করি। নিজেকে এক সুন্দর নিয়মে বেঁধে ফেলা সহজ কাজ নয়। তবে হ্যাঁ, নামাজ পড়ার পরেই কোন লোক অসৎ আচরণ করলে তা অবশ্যই প্রশংসনীয় নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এদিক ওদিক গাড়িতে করেই ঘুরলাম। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট বাইরে থেকেই দেখছি। সুন্দর সাজানো বিল্ডিং। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজের বাস সার্ভিস আছে।
১৯৪৭ মাত্র চারটি ডিভিশন বা বিভাগ নিয়ে পূর্ব পাকিস্থান (বা সেই সময়ের না-হওয়া-বাংলাদেশ) তৈরি হয়। ভাবা যায় কত ছোট্ট দেশ ! তার মধ্যে রাজশাহী ডিভিশন ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ । বাকি তিনটি ডিভিশন ছিল ঢাকা, খুলনা, আর চট্টগ্রাম। তখন মাত্র ১৯ টি জেলা ছিল পুরো দেশে। আর এখন আটটি ডিভিশন আর ৬৪ টি জেলা। দেশের আয়তন বাড়েনি। কিন্তু প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য অনেকগুলো ভাগ করা হয়েছে।
পাকিস্তানী সেনারা রাজাকারদের সাহায্যে এই রাজশাহীতেই সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের একসাথে হত্যা করেছিল। ২৫শে নভেম্বর ১৯৭১। সে এক করুণ কাহিনী। গা শিউরে ওঠে। ছাত্র সেজে মাস্টারমশাইকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গেছে রাজাকারের লোকেরা । তুলে দিয়েছে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে। এমন ভাবে মুক্তিকামী ডাক্তার, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, ও সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে নানা অছিলায় ডেকে নিয়ে গিয়ে রাজশাহীর বিভিন্ন জায়গায় একসাথে গুলি করে হত্যা করেছিল পাকিস্তানীরা। রাজশাহীর পদ্মায় সেদিন রক্তপ্লাবন হয়েছিল।
পাকিস্তানীরা বাংলাদেশে অনেক হত্যালীলা করেছে। ১৯৭১ এ ২৩শে মার্চ পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। আর ২৬শে মার্চ পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ঠিক এর আগেরদিন, ২৫ শে মার্চ, রাতের অন্ধকারে যে ভয়ঙ্কর ক্ষণ অপেক্ষা করছিল তা সাধারণ মানুষ ভাবতেও পারেনি। ওইদিন কুচক্রী পাকিস্তানীরা মরিয়া হয়ে দেশ জুড়ে নির্বিচারে বর্বরোচিত নৃশংস গণহত্যালীলা চালিয়েছিল। যাকে বাংলাদেশ এখন “কালরাত্রি” বলে।
এই ঘটনার আগের দিন, অর্থাৎ ২৪শে মার্চ, ঢাকায় আওয়ামীলীগ ও পাকিস্তান সরকারের বৈঠক ব্যর্থ হয়। তখন থেকেই পাকিস্তানীরা পরের দিনের ষড়যন্ত্রের ব্যবস্থা পাকা করতে থাকে। ভাবতে অবাক লাগে যে, এমনই এক ২৪শে মার্চ তারিখেই, ১৯৪০ সালে, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাব মুসলিম লীগের সভায় গৃহিত হয়েছিল এই পাকিস্থানীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে। সেদিনের প্রেমিক পরে হয়ে গেল ঘাতক। নিয়তির কি পরিহাস! কাকে বিশ্বাস করবে মানুষ! তাহলে কি সেদিনের বাঙ্গালী মুসলিম নেতারা তাঁদের স্বজন চিনতে ভুল করেছিলেন?
অথবা এমনও হতে পারে। শয়তানী বুদ্ধির পাকিস্তানী নেতারা মিষ্টি কথা, সুন্দর ভবিষ্যত, আর মুসলমান সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করে সহজ বিশ্বাসী বাংলার মুসলিম নেতাদের ব্যবহার করেছিল দেশ ভাগ করতে। কারন এদিককার মুসলিম ভোট না পেলে দেশ ভাগ সম্ভব নয় সেটা তারা ভালোই বুঝেছিল। যেমন করে যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলকে বোকা বানিয়েছিল পাকিস্তানীরা। শেষে ওই লোকটার কি করুণ পরিণতি হয়েছিল তা যারা খোঁজ খবর রাখেন তারা জানেন।
আজ তো ভাবনা আসতেই পারে। যদি তারা সেদিন উন্মত্ত হয়ে বাংলা ভাগ না করতেন। যদি তারা পাকিস্তানের সাথে হাত না মেলাতেন। যদি তারা হিন্দু-মুসলমান ভেদ না করতেন। তাহলে তো এতগুলো বাঙ্গালীর নিধন-যজ্ঞ সংঘটিত হত না। এত হত্যা, এত রক্ত, এত স্বজনহারা, এত অশ্রু ঝরত না।
আমি নিশ্চিত যে, তাহলে আজ বিশ্বের দরবারে বাঙ্গালী (হিন্দু-মুসলমান নয়) এক অসম্ভব শক্তিশালী মানব গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করত। তাই বলতে বাধা নেই, নেতারা সব সময় ঠিক নয়। তাঁদের নেতৃত্বে ভুল থাকে। মারাত্মক ভুল। যা একটা জাতিকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম অন্ধকারে ঠেলে দেয়।
আজকের বাংলাদেশের নব প্রজন্ম স্বাভাবিক ভাবেই এই পাকিস্তানী বর্বরতা চোখে দেখেনি। জানিনা তারা তাদের আগের প্রজন্মের ভয়ঙ্কর রক্তঝরা বেদনা, যন্ত্রণা কতটা অনুভব করে । বাংলাদেশ আজ অনেক এগিয়ে এসেছে। তবে আজকের বাংলাদেশে পাকিস্তানী প্রেমীদের প্রছন্ন বাড়বাড়ন্ত যা আমার চোখে পড়েছে, তা আবার অন্য কোন অশনি সঙ্কেত নয় তো?
বেলা শেষ হয়ে আসছে। তাই আর কোথাও দাঁড়াচ্ছি না। ঠিক হল, এখান থেকে সোজা পদ্মার পাড়ে যাব। সেখান থেকে সূর্যাস্ত নাকি অপরূপ। গাড়ি নিয়ে চলে এসেছি পদ্মাপাড়ে।
পদ্মার জল তীর থেকে বেশ কিছুটা দূরে। অনেক জায়গায় চরা পড়েছে। তবে জায়গাটি বেশ ভালই লাগছে। অনেক লোক তাদের বন্ধু, সঙ্গী, পরিবার নিয়ে বেরাতে এসেছে।
নদীর তীরে বালির উপরে সারি সারি আরাম কেদারা পাতা রয়েছে । অনেকেই হেলান দিয়ে বসে সামনে বিস্তীর্ণ পদ্মার জলরাশির সৌন্দর্য উপভোগ করছে। সামনে আদিগন্ত জলরাশি দেখলে এমনিই মানুষের মন কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। যেমনটা হয় সমুদ্র তীরে।
সূর্যাস্তের সোনালী রং পদ্মার জলকে মায়াবী করে তুলেছে। মনে হয় অনেকক্ষণ চেয়ে থাকি। জলে দেখছি অনেকগুলি মোটর-বোট । বেড়াতে আসা লোকজন নিয়ে আরো কিছুটা দূর থেকে ঘুরিয়ে আনছে। বেশ আনন্দদায়ক বোট-রাইড।
নদীর পাড়ে বাদাম ভাজা, বিস্কুট, চা বিক্রি হচ্ছে। আমরা চা নিয়ে সামনে পড়ে থাকা খালি আরাম কেদারার উপর বসতেই, কোথা থেকে একটা ছেলে এসে বলে, ভাইয়া, এখানে বসলে ঘন্টায় কুড়ি টাকা । আমরা বেশ অবাক হলাম। এতক্ষণ তো আশেপাশে কেউ ছিল না! এ কোথা থেকে চলে এল! যাই হোক ২০ টাকা দিয়ে আমরা বসে বসে পদ্মার কোলে ধীরে ধীরে পড়ন্ত সূর্য-শিহরণ দেখছি। বেশ খানিকক্ষণ এই দৃশ্য দেখে এবার ফেরার পথ ধরি।
সন্ধ্যা হয়ে গেল। এখন যাবো রাজশাহীর বিখ্যাত সিল্ক ফ্যাক্টরি দেখতে।
ক্রমশঃ