ধারাবাহিক গল্প সংসার ও স্বপ্ন

ধারাবাহিক গল্প
সংসার ও স্বপ্ন
দ্বিতীয় পর্ব

সন্ধ্যের পর মৈনাক ফিরতেই অনুপমা দেবী বললেন–মনু একবার ছেলেটাকে ভালো করে দ্যাখ। আমাদের কেমন রাজপুত্রের মতো নাতি হয়েছে।অমৃতা বলল–মা আপনি তো নাতনির নাম মহুয়া রেখেছেন।আমি আপনার নাতির নাম মন্দার রাখলাম।শাশুড়ি মা বললেন–আমি বাপু ওকে গোপাল বলে ডাকব।গোপালের নিত্য পুজো করে আমাদের ঘরে ঠাকুর জ্যান্ত গোপালকে পাঠিয়েছেন।অমৃতা হেসে বলল–তাই হবে মা।আমি ও আপনার নাতিকে গোপু বলে ডাকব।

অনুপমা দেবী বললেন– একটা কথা বলি বৌমা।এই সোনার চাঁদ ছেলেকে ফেলে তোমার চাকরি করতে ইচ্ছে করবে?ছেলেকে বুকে রেখে মানুষ করলে তবেই তো মায়ের ওপর টান হবে।–মা আমার মউ ও তো আমার সোনার চাঁদ মেয়ে।ওরাও বড় হয়ে একদিন চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত হবে।ওদেরও সন্তান হবে।তখন চাকরির জন্য আপনার নাতনি নাত বৌ কেও বাইরে বেরোতে হবে।আমার ছেলে মেয়ের জন্য তবু তো দাদু ঠাম্মি আছে।ওদের হয়তো সেটাও থাকবে না।তাই বলে কি মায়ের ওপর টান ভালোবাসা থাকবে না?মৈনাক বলল–মা বৃথা কথা খরচ করছ। লেকচার দেওয়াটাই ওর কাজ।অমৃতা বলল–মোটেই লেকচার দিচ্ছি না।আমি শুধু মাকে যুক্তি দিয়ে বোঝাচ্ছি।

অমৃতা কলেজে যোগ দেওয়ার দিন আরো একবার ছোটোখাটো অশান্তি হয়ে গেল।শাশুড়ি মা বললেন–শোনো বৌমা সবার কথা অগ্রাহ্য করে তুমি যখন চাকরিটা করবেই ঠিক করেছো তখন আমিও একটা স্পষ্ট কথা বলে দিচ্ছি।তোমার মেয়েকে আমি আর বকবক করে খাওয়াতে পারব না।

শর্মিলা বলল–মউয়ের ছ বছর বয়স হতে চলল।আপনি তো অনেকদিন করলেন।ওকে এবার স্বাবলম্বী হতে হবে।ও এবার থেকে নিজে খাবে,নিজে স্নান করবে। শুধু কমলা দি একটু সহায়তা করবে।–তোমার মতো এমন নির্দয় মা ই এমন কথা বলতে পারে।ছেলে মেয়েকে জন্ম দিয়েই তুমি খালাস।এখন তো ঘর সংসারের কোনো কাজও করতে হচ্ছে না।পটের বিবি সেজে চাকরি করাটাই তোমার প্রধান কাজ।

অমৃতা বলল–মা,আপনার আর বাবার ওষুধের প্রেশক্রিপশনটা দিন।আমি আসার পথে নিয়ে আসব।অনুপমা বললে–থাক মা ওটুকু দয়া তোমার না দেখালেও চলবে।মেডিসিনের দোকানে মনু বলে রেখেছে।ওখানে ফোন করলেই ওরা ওষুধ বাড়িতে দিয়ে যায়।

রাতে শোবার সময় মৈনাক বলল–একি! ওকে এখানে আনলে কেন?আয়া মাসী কি করছে?শর্মিলা বলল–আজ আয়া মাসী ছুটি নিয়েছে।কিন্তু মা বলেছেন রাতের আয়া মাসীকে রাখার আর দরকার নেই।আসলে আমি এখন বড্ড গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ায় বলে মা এই ব্যবস্থা করেছেন।মানে রাতে গোপুর পুরো দায়িত্ব এখন থেকে আমাকেই নিতে হবে।আমার অসুবিধা হবে না। তাছাড়া আয়া মাসী থাকলেও গোপু কি সারারাত মা ছাড়া থাকবে? — আমার একটুও অসুবিধা হবে।–না। না,অন্তত পুরো একটা বছর আয়া মাসী থাকবে।বলেই অমৃতাকে কাছে টানল।ওদের আদর ভালোবাসার মধ্যেই গোপু তারস্বরে কেঁদে উঠল।

মৈনাক বিরক্ত হয়ে বলল–ডিসগাস্টিং।ওর কান্না থামাও। অমৃতা হেসে বলল–গোপুটা মনে হয় তোমার চেহারার সংগে তোমার স্বভাবটাও পেয়েছে।তুমিও মনে হয় মাকে এভাবেই জ্বালাতে। মউ তো জন্মের পর থেকে ভীষণই শান্ত। তার কান্নাকাটির আওয়াজ শোনাই যেত না।–রাত দুপুরে তোমার ন্যাকা কথাগুলো থামাও।কাল থেকে আয়া মাসীকে আসতে বলবে।এই বয়সেই তোমার আবেগ রোম্যান্স সব হাওয়া।আমার ওপর টানটা এখন শূণ্যতে।যতো মনোযোগ এখন তোমার দুটো বাচ্চার ওপর। না ভুল বললাম। মায়ের দায়িত্ব তো সেই কবে থেকেই আমার বাবা মা নিয়েছে।-

অমৃতা –বলল ওমা! তুমি তো ভারি হিংসুটে।আর মেয়েকে তো তুমিই জোর করেই মা বাবার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলে।আচ্ছা বিয়ের আগে বা পরের সেই রোমান্সটা কি বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর থাকে?একটু তো ভাটা পড়েই গো।এখন থেকে তুমিও দু দুটো বাচ্চার বাবা।এখন আমাদের জীবনটা সন্তানদের ঘিরে আবর্তিত হবে। তার মধ্যেই আমাদের ভালোবাসা থাকবে শারীরিক সম্পর্ক থাকবে। এই ঘুমিয়ে গেলে? আচ্ছা ঠিক আছে রাতের আয়া মাসী না হয় আরো কিছুদিন থাকবে। কিন্তু আমি মাকে রাতের আয়া রাখার কথা বলতে পারব না।উনি এমনিতেই আমার ওপর সব সময় রেগে থাকেন।

পরদিন সকালে উঠতেই অনুপমা দেবী বললেন–কাল রাতে গোপু এত কাঁদছিল কেন? মনুর তো ঘুমের বারোটা বাজছে।ওকে অফিসে অনেক হার্ড পরিশ্রম করতে হয়। ওর ঘুম দরকার।তোমার মতো তো আরামের চাকরি ওর নয়।আজ থেকে তুমি গোপুকে নিয়ে আলাদা ঘরে ঘুমাবে।অমৃতা বলল–গোপু মনে হয় সারাদিন ঘুমায় বলে রাতে ঘুমাতে চায় না।কিন্তু এই ব্যবস্থায় কি আপনার ছেলে রাজি হবে?–তাকে তো তুমি ভারি মেনে বসে আছো।অমৃতা বলল–মা গোপু তো আমাদের দুজনের সন্তান।তার দায়িত্ব আমাদের দুজনের ভাগ করে নেওয়া উচিত নয় কি?ওই বয়সের বাচ্চার সব বাবা মাদেরই এরকম কষ্ট সহ্য করতে হয়।অনুপমা বললেন–দ্যাখো বৌমা তোমার কাছে এই বয়সে তুমি আমাকে উচিত অনুচিতের শিক্ষা দিতে এসো না।ওসব লেকচার তুমি বরং তোমার ছাত্র ছাত্রীদের দিও।চিরকাল মা রাই বাচ্চাদের মানুষ করে।বাবা তাদের শিক্ষা ভরণপোষণের দায়িত্ব নেয়।

অমৃতা বলল–মা আপনার ছেলে বলছিল রাতের আয়া মাসী আরও কিছুদিন থাকুক।—শুধু শুধু আমার ছেলের নাম দিচ্ছ কেন?তুমি কি বাচ্চার ধকল নিতে বিরক্ত হচ্ছ ?বাচ্চার মা হবে আর বাচ্চার ধকল নেওয়ার বেলায় আয়া মাসী?–না মা আমার অসুবিধা হবে না।অসুবিধাটা আপনার ছেলের হচ্ছে।

রাতে গোপুকে ঘুম পাড়িয়ে চারিদিকে বালিশের ব্যারিকেটে রেখে অমৃতা মৈনাকের ঘরে এসে বলল–খাটে গোপুকে একলা রেখে আসা নিরাপদ নয়।এমনিতে বড্ড ছটফটে ছেলে।মৈনাক বলল–তুমি কি ডিউটি পালন করতে এলে? না কি দয়া দেখাতে এলে?সংসারে আর পাঁচটা কাজের মতো এটাও কি তোমার একটা কাজ?অমৃতা বলল–আহা তুমি এত রাগ করছ কেন?সকালে মায়ের কথাগুলো তো তুমিও শুনলে।তখন তো প্রতিবাদ করতে পারতে।–এই নিয়ে প্রতিবাদ করলে ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু হত।–কেন হত? স্বামী স্ত্রী একঘরে থাকাটা কি করে দৃষ্টিকটু হয়?তোমার যতো হম্বিতম্বি আমার ওপর।মাকে কিছু বলার সাহস নেই।–বললাম তো এটা নিয়ে কিছু বলা যায় না।–মানলাম,কিন্তু রাতে আয়া রাখার কথা তো বলতে পারতে।মৈনাক বলল–আমি অশান্তি এড়িয়ে চলি।–আমি কি গোপুকে নিয়ে এখানে আসব?ও তো গোটা রাত কাঁদবে না।

মৈনাক বলল– থাক,আমিই ও ঘরে যাচ্ছি। মধ্যে রাতে গোপুর কান্নাকাটিতে মৈনাকের ঘুম ভেঙ্গে গেল।অমৃতা পাশ ফিরে ছেলেকে ব্রেস্ট ফিড করিয়ে ছেলেকে ঠান্ডা করল।প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে মৈনাক পাশ ফিরে ঘুমালো।এভাবেই অমৃতার সংসার টক ঝাল মিষ্টিতে চলতে লাগলো।তার মধ্যেই কলেজ যাওয়ার সময় শাশুড়ি মার তীর্যক মন্তব্য,শ্বশুর মশাইয়ের ব্যাজার মুখ সবটা নিয়েই ছেলে মেয়ে বড় হচ্ছিল।

অমৃতা শ্বশুর শাশুড়ির বিরক্তি,বরের অবুঝ বায়না সবটাই ম্যানেজ করছিল।কিন্তু তাকে ভাবিয়ে তুলল মউয়ের আচরণটা।এখন তাকে কাছে টেনে আদর করতে গেলে সে ছিটকে সরে গিয়ে বলে–তুমি পচা মা,বাজে মা।তোমার আদর আমার চাইনা।অমৃতা মেয়েকে জোর করে কাছে টেনে বলল –কেন রে সোনা?আমি ভাইকে বেশি আদর করি বলে বলছিস?ভাইটা তো তোরই।সে যে এখন অনেক ছোটো সোনা।মউ ঘাড় বেঁকিয়ে বলল–তুমি আমাদের ফেলে চাকরি করতে কেন যাও?ঠাম্মি বলেছে তুমি আমাদের ভালোবাসো না।–মাম্মাম চাকরি করা কি খারাপ? তুমি ও তো লেখাপড়া শিখে চাকরি করবে।তুমিও একদিন মা হবে।তখন কি তুমি পরিশ্রম করে পাওয়া চাকরিটা কি ছেড়ে দেবে?আর কক্ষনো এসব কথা বলবে না।

ক্রমশ–

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *