মিরুজিন আলো (পর্ব ষোল) বিজয়া দেব
মিরুজিন আলো (পর্ব ষোল)
বিজয়া দেব
জুহির পড়ার টেবিলে দুটো চিঠি – একটি দেবাংশীর জন্যে একটি জুহির জন্যে। পত্রলেখক জগবন্ধু।দেবাংশীর চিঠিটা নিয়ে জুহি দেবাংশীর ঘরের সামনে গিয়ে মৃদু টোকা দিল। ভেতর থেকে ভেজানো। দেবাংশী বেরিয়ে এল। ঘুম ক্লান্তি জড়ানো চোখ মেলে তাকিয়ে বলে-কি ব্যাপার?
জুহি কথা না বলে চিঠিটা এগিয়ে দিল। একটা ভাঁজ করা সাদা কাগজ।
– এটা কি?
-খুলে দেখো।
বলে কথা না বাড়িয়ে জুহি চলে যাচ্ছে।
দেবাংশী কাগজ খুলে দেখে ক’টা লাইন লেখা – মা, তুমি আমায় মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছ। কিন্তু পাপী আমি তোমার ঋণ শোধ করতে পারলাম না। নিজের ঠেকে ফিরে যাচ্ছি। আমায় ক্ষমা করতে পারবে না জানি। কোনও মা-ই আমায় ক্ষমা করবে না। যাচ্ছি মাগো। – জগবন্ধু।
জুহি চিঠি দিয়ে নিঃশব্দে চলে গেছে। জগবন্ধু কখন গেল? দেবাংশী অফিস থেকে ফিরে আসার পথে তাদের উইমেন্স ক্লাবে গিয়েছিল। ফিরতে খানিকটা রাত হয়েছে। কালরাতের ডিনারটা বাইরে সারতে হয়েছে। সবাই জোর করছিল। গতকাল শুক্রবার ছিল। এরপর দুদিন বন্ধ, উইকএন্ড। এখন সকালবেলা।নিশ্চয়ই জগবন্ধু গতকাল রাতে ছিল না। কিন্তু জুহি তাকে ফোন করে জানায়নি। জানালে অফিস থেকে সোজা বাড়ি ফিরত দেবাংশী। কি হয়েছিল ঠিক? জগবন্ধুকে দিয়ে তার অন্ধকার জীবনের কথাগুলো বলিয়েছে জুহি। হয়ত শক্তকথা শুনিয়েছে জগবন্ধুকে। ও মেয়ের তো কিছু ঠিক নেই! দেবাংশী জুহির ঘরের দিকে এগোয়। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। কোনদিন না কোনও কান্ড করে বসে। আজকাল কীসব হচ্ছে। কত কী শোনা যায়। দু’বার দরজায় নক করল দেবাংশী। কোনও সাড়া নেই। জগবন্ধুর সাথে জুহির একটা স্নেহের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। খুব শান্তি এনে দেওয়ার মত একটা ব্যাপার ছিল সেটা। সে তো নিশ্চিন্তে অফিস ক্লাব সমাজসেবা ইত্যাদি করে যাচ্ছিল। এভাবে চলতে থাকলে জগবন্ধু অতীতটা ভুলতে পারত। সেটাই জরুরি ছিল হয়ত। আরও দুবার নক করল দরজায় দেবাংশী। এবার দরজা খুলল জুহি। কথা না বলে সে তাকিয়ে। চোখে প্রশ্ন।
-জগবন্ধু কখন গেছে জানিস?
-বলে গেলে চিঠি দিত?
-কখন থেকে দেখতে পাচ্ছিস না তাকে?
-এখন গোয়েন্দাগিরিটা জাস্ট বন্ধ করো। গতকাল কত রাতে ফিরলে?
-অসভ্যতা করো না জুহি। আর ভেতর থেকে দরজা লাগিও না। বাড়িতে এখন শুধু তুমি আর আমি। আজ শনিবার। শনি রবি দুদিন যদি একটু শরীর মনে বিশ্রাম না পাই তাহলে তো খুব মুশকিল। দরজা খোলা রেখো।
দেবাংশী কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে। জুহি দেখছে। একটা অজানা আক্রোশ জুহির ভেতর থেকে পাক খেয়ে উঠছে। কীসের এ আক্রোশ সে জানে না। জুহি তো দরজা লাগিয়েছে এজন্যেই, দেবাংশীর গোয়েন্দাগিরি করার সুযোগ না দেওয়ার ইচ্ছেতে। অসহ্য! তবে জগবন্ধু চলে যাওয়ায় সবকিছু বড্ড ফাঁকা লাগছে। লোকটা তাকে স্নেহ করত, কিন্তু এমন লোককে জুহি বিশ্বাস করবে কি করে! পারুলের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে যে! মা সবটা জানতে পারে নি। তার কষ্ট হচ্ছে। বেশ কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতর একটা পাক খাওয়া কষ্ট। থিতু হতে কিছুটা দিন যাবে। নাহ বেরিয়ে পড়বে আজ। যেখানে হোক। নীলাভকে একটা ফোন করবে? দেবাংশী আবার দরজায়।
– চলো, আমার সাথে আজ বাজার যাবে।
– তুমি যাও। আজ আমি বাইরে লাঞ্চ করব।
-বিকেলে ট্যুইশান আছে না?
-হ্যাঁ। একেবারে সেরে রাতে ফিরব।
– পড়াশুনো কখন হবে?
-রাতে।
-কোথায় লাঞ্চ করছ?
-সে আছে।
-মানে? কোথায় যাচ্ছ বলে যাবে না? একটা আপদবিপদ হলে কোথায় খোঁজ করব?
-থানায় যাবে!
-মানে? তুমি কোথায় যাচ্ছ বাড়িতে বলে যেতে হবে না? কী ভেবেছ তুমি? যাচ্ছেতাই করবে?
-আচ্ছা! তুমি বলে যাও বাড়িতে? আপদবিপদ হলে কোথায় খোঁজ করব?
-উইমেন্স ক্লাবে করবে। অফিসের বাইরে ওখানটাই আমার ঠিকানা। তোমার তো তেমন নয়। কোথায় যাচ্ছ কার সাথে যাচ্ছ তার কোনও হদিস কেউ কখনও বের করতে পারবে না।
-ঐ থানা পুলিশ করতে হবে আর কি!
-জুহি!
দেবাংশী গর্জন করে ওঠে।
-চোখ দেখিও না মা। সে অধিকার তুমি হারিয়েছ।
নিজের ঘরে এসে হতাশ দেবাংশী বসে পড়ে। কি করা উচিত তার? কি করা উচিত ছিল তার? নিজেকে জয়মাল্যর সম্পত্তি হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া? মেয়ের দিকে সে নজর দেয়নি? অসুখবিসুখে রাত জাগেনি? শিয়রে বসে ছোট্ট মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়নি? একটি নারীকে কি কি করলে বিশ্বসুদ্ধ সবাইকে খুশি করা সম্ভব? কি কি ভুল সে করেছে? তবে কেউ খুশি হল কিনা তা নিয়ে সে কেন ভাববে। কিন্তু সন্তান? বুকের ভেতর কেন এত কষ্টের বান ডাকে? আজ ভেবেছিল একটু ভালো খাবারের ব্যবস্থা করবে। মেয়ের পছন্দের খাবার বাজার থেকে কিনে আনবে।
ফোনটা বাজল। তুলতেই এক অজানা নারীকন্ঠ। – দেবাংশী বলছেন? পারিজাতকে চেনেন? চেনেন তো? আমি তার রাঙাপিসি। চিনতে পেরেছেন? একসময় আপনাদের উইমেন্স ক্লাবে ছিলাম। বর্তমানে শরীর ঠিক থাকে না, তাই আর আসতে পারি না। একসময় জুহি আমার বাড়িতে আসত।আপনার সাথেও ফোনে কথা হয়েছে কত। বলছি যে আপনার বাড়িতে থাকত জগবন্ধু এখন আমার এখানে। আপনাকে জানানো দরকার, তাই জানালাম। আমার পাগল ভাইপো পারিজাত রাস্তা থেকে তুলে এনে এখানেই ঠাঁই দিয়েছে।জগবন্ধু চলে যেতে চাইছে। বলেকয়ে আটকে রেখেছি বলতে পারেন। আপনাকে বলে এসেছে কি?
(ক্রমশ)