সেদিনের_কবিগান : কলমে : গীতালি ঘোষ
সেদিনের_কবিগান :
কলমে : গীতালি ঘোষ
পর্ব : ৪
শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে নিয়মিত বসত কবিগানের আসর। জানা যায় যে রাজা গোপীমোহন দেবও এই কবিগান শুনে খুবই আনন্দ পেতেন।
কবিয়াল বা ছড়াকারদের মধ্যে দুটি পক্ষের মধ্যে বিতর্ক চলে। তারা গান গেয়ে বা ছড়া বলেই নিজেদের যুক্তি উপস্থাপন করেন। বলা যেতে পারে এ এক কাব্যগীতির মাধ্যমে লড়াই। কবিয়াল আফাজুদ্দিন লিখেছিলেন :
” এ লড়াই-এ নেই লাঠালাঠি
শুধু কথার ফাটাফাটি
হয় না তাতে চটাচটি
থাকে যুক্তির পরিপাটি।”
এই ছড়ায় কবিগানের মূল সুরটি সুন্দর ভাবে ব্যক্ত হয়েছে।
সেসময়ে কোনো কোনো ধনী ব্যক্তির প্রাঙ্গণে রাতে বসত কবিগানের আসর। অনেক বেশি মানুষের সমাগমে উদ্যোক্তারা ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতেন। মাঝে মাঝেই লাঠি বা চাবুক চালাতে হত। এর মধ্যেই ঢুলিদের ঢোলে পড়ত ঘা। জমে যেত সভা। তারপর কবিয়ালদের প্রথম দল কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত লাল কাপড় পরে, দুপায়ে নুপূর বেঁধে সভার মাঝে এসে পৌঁছাত। মাথায় তাদের থাকত তিনকোনা টুপি, যার মাথায় থাকত পাখির পালক। তাদের নুপূরের ঝুমঝুম শব্দের মাঝেই অবতীর্ণ হত দ্বিতীয় দল। এর কিছু কিছু বর্ণনা ও বিষয়বস্তুর তথ্য পাওয়া যায় জয়নারায়ণ ঘোষালের ‘করুণানিধানবিলাস’এ যা ঈশ্বর গুপ্তের সংগ্রহেরও তিরিশ বছর আগেকার কথা। কিন্তু ১৮৩৭ সনের ১৩ই জানুয়ারিতে প্রকাশিত ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকায় “হিন্দু” নামক প্রবন্ধে কবিগানের দল ও আঙ্গিকের সংক্ষিপ্ত পরিচয় মুদ্রিত হয়েছিল।
যে কোনো কবির লড়াইএ সাধারণত ৫টি স্তরে এই লড়াই হত। সেগুলি হল :
১। ভবানী বিষয়ক ( মা দুর্গা বা মা কালীকে ভজনা করা)
২। সখী সংলাপ ( রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা বিষয়ক )
৩। বিরহ ( সাধারণ মানুষের দুঃখের কাহিনী )
৪। খেউড় ( পুরাণের থেকে কিছু এবং দেবতাকে উদ্দেশ্য করে গান )
৫। লহর ( প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে নেতিবাচক সমালোচনামূলক গান )
তাছাড়াও নানারকমের বিভাগ রয়েছে কবিগানের। যেমন,
ক।। আসরের আগে রচিত গানের রকমফের যা দুইপক্ষকেই গাইতে হবে–
১. ডাক
২. আগমনী / ভবানী/ মালসী
৩. গোষ্ঠ/ ভোর
৪. সখীসংবাদ
৫. কবি (লহর কবি )
খ।। আসরে উপস্থিত হয়ে রচিত গানের রকমফের, যেগুলি দুইপক্ষের গেয়–
১. সখী সংবাদ বা কবির জবাব
২. ধুয়া
৩. ত্রিপদী পাঁচালী
৪. ধুয়া ও সুর সহযোগে গান
৫. পয়ার পাঁচালী
৬. যোটক
এছাড়া যে বিভাগগুলি দেখা যায়, তা হল,
ক. ডাক গানের অঙ্গ বিভাগ–
১. প্রস্তাবনা বা ডাক যাকে আহ্বান বলা যায়।
২. অন্তরা বা চালনা
খ. ভবানী বা মালসীর অঙ্গ বিভাগ
১. চিতান
২.পাড়ন
৩. প্রথম ফুকার
৪. মিল অথবা ছাড়
৫. মুখড়া বা ধুয়া
৬. ডাইনা
৭. খাদ
৮. দ্বিতীয় ফুকার
৯. মিল
১০. অন্তরা বা লটক
১১. পরচিতান
১২. পাড়ন
১৩. তৃতীয় ফুকার
১৪. মিল বা ছাড়
কবিয়ালরা এই প্রতিটি নিয়ম মেনে সবসময় গান গাইতেন না। নিয়মের ব্যতিক্রম প্রায় ক্ষেত্রেই হত। যত সময় বয়েছে, কবিগানের আঙ্গিকেরও কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কবিয়ালরা তাদের গানের ধারাকে নিজস্ব ঘরানা দিয়েছেন, কিন্তু সেই লড়াইএর ভঙ্গিটি ছিল ঠিক তেমনই। (চলবে)