গল্প সংসার ও স্বপ্ন ***** প্রথম পর্ব
ধারাবাহিক গল্প
সংসার ও স্বপ্ন
প্রথম পর্ব
সকালে মৈনাকের হাতে চায়ের কাপটা দিয়ে অমৃতা বলল–আজ তোমাকে একটা সুখবর দেব।মৈনাক বলল–শুধু খবর নয় একেবারে সু-খবর?তো বলো শুনি তোমার সুখবরটা কি?–আসলে খবরটা আগেই জানাতাম।কিন্তু কনফার্ম না হয়ে জানাতে চাইছিলাম না। একেবারে ডাক্তারের সংগে কনসাল্টও করে এসেছি। –এত ভূমিকা না করে আসল খবরটা বলো। অমৃতা বলল–আমি কনসিভ করেছি।
মৈনাক বলল– মানেটা কি? তুমি কি সাত সকালে আমার সংগে রসিকতা করতে এসেছো?–তোমার কি এটাকে রসিকতা বলে মনে হয়?মউ তো এখন একটু বড় হয়ে গেছে।আর একটা বাচ্চা হলে ক্ষতি কি?আমি তো ভাবলাম তুমি খুশি হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানাবে।মৈনাক বলল–তুমি কোন আক্কেলে এমন হঠকারী কাজটা করলে?তোমার সাবধান হওয়া উচিত ছিল না?আমার বাবা মা না থাকলে মউ তো কুকুর বেড়ালের মতো মানুষ হত।
অমৃতা বলল–তুমি এমন রি অ্যাক্ট করছ কেন? মউ তো বাবা মারও নাতনি।ওনারা শুধু মউকে আদর ভালোবাসা দিয়েছেন।একবছর আগে পর্যন্ত ওর জন্য আয়া ছিল।একটা হোল টাইমার সহায়িকা আছে।বাচ্চার পিছনে যা যা কাজ আয়া করেছে।হ্যাঁ মউ দাদু ঠাম্মির সান্নিধ্যে থেকেছে।এটাও অনেকে পায় না।এটার বেলায়ও আয়া থাকবে।দ্যাখো আর একটা ছেলে বা মেয়ে হলে মউ আনন্দে থাকবে।আমাদের যখন দুটো বাচ্চাকে ঠিক মতো মানুষ করার মতো আর্থিক ক্ষমতা আছে তখন এত আপত্তি করছ কেন?
মৈনাক বলল–ঠিক আছে আমি তোমার কথা মানব।কিন্তু কলেজের চাকরিটা তোমাকে ছাড়তে হবে।আমার একার রোজগারে দুটো বাচ্চা মানুষ করার ক্ষমতা আছে।অমৃতা বলল–তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?এই চাকরিটার পিছনে আমার কতো লেখাপড়া ,পরিশ্রম আর ধৈর্য ছিল সে ধারণা তোমার আছে?বাবা মা রান্নার মাসীর হাতে খেতে পারেন না বলে আমাকে সেই ভোর থেকে উঠে রান্না জলখাবার সেরে কলেজ করতে হয়।আমি তো এই নিয়ে কখনও অভিযোগ বা ক্ষোভ প্রকাশ করিনি।–এত কষ্ট করার তো দরকার ছিল না।আমার বাবা মা আমি কেউ চাইনি তুমি চাকরি করো। আমি একটা এডুকেটেড মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম।চাকরিটা তো তুমি সবার অমতে বিয়ের পর পেয়েছিলে।—চাকরিটা আমার নিজের পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে অর্জন করেছিলাম।বিয়ের আগে তুমি তো একবারও বলোনি তুমি মেয়েদের চাকরি করা পছন্দ করো না।–করলে কি করতে?–বিয়েটা করতাম না।আমার জীবনের ফার্স্ট চয়েস ছিল স্বাবলম্বী হওয়া। কেন তোমার অফিসে মহিলা কলিগ নেই?
মৈনাক বলল–আমি শুধু আমার সংসার আর সুবিধা অসুবিধার কথা ভাবব।যারা চাকরি করে তাদের চাকরির প্রয়োজন আছে তাই করে।আমাদের তো প্রয়োজন নেই।আমার বয়স্ক বাবা মাকে দেখাশোনা করা তোমার কর্তব্য নয়?–আমি তো সেটা অস্বীকার করছি না। আর সেটা আমার একার কর্তব্য?
চাকরির পর আমার সাধ্যমতো তাদের দেখাশোনা করি।–ঠিক আছে,চাকরিটা যখন ছাড়বেই না তাহলে বাচ্চাটা এবরেশন করে নাও।– কেন এমন নিষ্ঠুরের মতো কথা বলছ?দ্যাখো দ্বিতীয়বার কনসিভ করতে আমিও চাইনি।কিন্তু অসাবধানতাবশত যখন যখন বাচ্চাটা চলেই এসেছে তখন পৃথিবীর আলো দেখার আগেই তাকে মেরে ফেলব? এই বাচ্চা তো তোমার আমার ভালোবাসারই ফসল। আমি সবদিক বজায় রেখেই চাকরিটা করব।
ছেলে বৌমার কথা কাটাকাটির মধ্যে মৈনাকের মা অনুপমা দেবী বেরিয়ে এসে বললেন–সাত সকালে তোরা কি শুরু করেছিস বল তো?মৈনাক বলল–মা তোমার বৌমা আবার সন্তান সম্ভবা।তাই আমি ওকে চাকরিটা ছাড়তে বলছিলাম।অনুপমা দেবী বললেন–তুই ঠিকই তো বলেছিস।ঘরে বাচ্চা আসবে সেটা তো আনন্দের খবর। একটা নাতি হোক এটা আমিও চাইছিলাম।কিন্তু এই বয়সে দু দুটো বাচ্চার ধকল কি আমাকে নিতে হবে?বৌ তো সারাদিনের নামে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সেজেগুজে বেরিয়ে যাবে।আমি তো বরাবর বলেছিলাম ওর চাকরি করার দরকার নেই।আমাদের টাকা পয়সার অভাব তো কিছু নেই। তোর বাবা মোটা টাকা পেনশন পায়।কিন্তু ও মেয়ে যা জেদি।ও কারোর কথা শোনার পাত্রীই নয়।কি দেখে যে বিয়ে করলি কে জানে।মেয়েমানুষের এত জেদ কি ভালো?
অমৃতা বলল–মা আপনার নাতি হবে না নাতনি হবে সেটা তো আপনি বা আমি কেউ জানি না।তার সংগে আমার চাকরির কি সম্পর্ক?অনুপমা বললেন–তোমার লেকচারটা তোমার কলেজেই দিও বাছা। আর তোকেও বলি মনু ,ও মেয়ে যে কারোর কথা শোনার মেয়ে নয় সেটা জানতিস না?বিয়ের পর তো ভেজা বিড়ালটি ছিল। চাকরিটা পাওয়ার পর থেকে তার আসল রূপ বেরিয়ে পড়েছে।তুমি এখনও হাঁ করে বসে না থেকে আর একবার চা করে রান্না জলখাবার কি হবে দ্যাখো।সপ্তাহে দুটো দিন তো একটু ভালোমন্দ খাওয়া জোটে।আর সব দিন তো ঝড়ের বেগে দায়সারা রান্না করে কলেজ ছোটো।
অমৃতা বলল–মা আপনার ছেলেকে বলুন এবার একটা রান্নার মাসী দেখুক।ডাক্তারবাবু আমাকে ভারি কাজ করতে নিষেধ করেছেন।অনুপমা দেবী বললেন–তোমার চাকরিটা বুঝি ভারি কাজ নয়?একঘন্টা ভীড় বাস ঠেঙিয়ে কলেজ যাওয়া বুঝি হালকা কাজ?–মা তিনমাস আমি ক্যাব বুক করে কলেজে যাব।ডাক্তার বাবু আমাকে বেড রেস্ট নিতে বলেন নি।টুকটাক হাল্কা কাজ করতে বলেছেন।আর কলেজ যেতেও নিষেধ করেন নি।
অনুপমা দেবী বললেন–তাহলে তো সোনায় সোহাগা।আগে তোমার আধঘন্টা সাজতে সময় লাগত এরপর দু ঘন্টা সাজগোজের সময় পাবে।তারপর গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ট্যাক্সি করে কলেজ যাবে।এখন থেকে কতদিন যে রান্নার মাসীর অখাদ্য রান্না খেতে হবে কে জানে।অমৃতা বলল–মা রবিবার দিনটা না হয় আমিই রান্নাটা করব।আর রান্নার বাইরেও আমাকে অনেক কাজ সামলে তবে যেতে হয়।মউকে স্কুলের জন্যে তৈরি করে খাওয়াতেই আমার অনেকটা সময় চলে যায়।–তবু তুমি চাকরিটা ছাড়বে না?অমৃতা বলল–মা একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন,সংসারে স্বামী স্ত্রী রোজগার করলে ভবিষ্যত অনেক নিরাপদ থাকে।দুটো বাচ্চার উচ্চ শিক্ষার জন্য টাকার দরকার।অনুপমা দেবী বললেন –তোমার রোজগারের টাকার একটা পয়সা এখনও পর্যন্ত এ সংসারে নেওয়া হয়না।তোমার শ্বশুরের পেনশন আর ছেলের রোজগারে সংসার স্বচ্ছন্দে চলে গিয়েও অনেক উদ্বৃত্ত থাকে।আমার দুটো নাতি নাতনির উচ্চ শিক্ষার জন্য যা থাকবে তাতে কোনো ঘাটতি পড়বে না। আমাদের কথা না হয় বাদ দাও।যেখানে তোমার স্বামী চাকরি করা পছন্দ করছে না সেখানে তার পছন্দ অপছন্দের গুরুত্ব তোমার কাছে কিছু নয়?
অমৃতা বলল–মা আমি শুধু মৈনাক কেন ,আপনাদের সবার পছন্দ অপছন্দের গুরুত্ব দিই।তাহলে আমিও তো আশা করব আপনারাও আমার পছন্দ অপছন্দের গুরুত্ব দেবেন।এই চাকরিটা আমার আত্মসম্মান, পায়ের তলার শক্ত মাটি,আমার মাথা উঁচু করে চলার রাস্তা।
নির্দিষ্ট সময়ে অমৃতা একটা পুত্র সন্তান প্রসব করল।নাতির মুখ দেখে শ্বশুর শাশুড়ি উচ্ছ্বসিত।অমৃতা জানে তার মেয়ে হলে তাঁদের এই উচ্ছ্বাসটা থাকত না।সৌজন্যবশত হয়তো মেনে নিত। মৈনাক একবার দায়সারা করে নার্সিংহোমে এসেছিল।
বাড়ি ফেরার পর অনুপমা দেবী উলুধ্বনি আর শঙ্খ বাজিয়ে একমুখ হাসি নিয়ে নাতিকে বরণ করলেন।শ্বশুর মশাই বললেন–একবারে বাপকা ব্যাটা হয়েছে।শাশুড়ি মা বললেন–আমার বংশের উত্তরাধিকার। চেয়ে দ্যাখো একেবারে মনুর মুখটা কেটে বসানো।অমৃতা মনে মনে হাসল।সদ্যোজাত সব বাচ্চার মুখ তার কাছে তো একই মনে হয়।এনারা কি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তাদের ছেলের সংগে এত মিল খুঁজে পেলেন?মউও নাকি তার বাবার মতো চেহারা পেয়েছে।তাহলে তার ভূমিকাটা কি?শুধু জন্ম দেওয়া? তার চেহারার ছিটেফোঁটাও কি দুই ছেলে মেয়ে কেউ পায় নি?যাকগে যে যাতে সন্তুষ্ট থাকে।নার্সিং হোম থাকার সময় মৈনাক আয়ার ব্যবস্থা করেছিল।অমৃতা মনে মনে মৈনাকের দূরদর্শিতার প্রশংসা করল। নিশ্চয়ই ছেলের মুখ দেখে তার সব বিরক্তি উধাও হয়ে গেছে।
ক্রমশ—