মিরুজিন আলো (পর্ব চৌদ্দ) ____ বিজয়া দেব

মিরুজিন আলো (পর্ব চৌদ্দ)

বিজয়া দেব

কোনও কিছুতেই মনটা লগ্ন হয় না পারিজাতের। একটা নেই আঁকড়া ভাব। সত্তর আশির দশকের রোমান্টিক সিনেমা দেখে আশ্চর্য হয়ে যায় পারিজাত। ওরকম ছিল তাহলে? প্রেম ভালবাসা নিয়ে তৈরি হত ছবি। এখন বিয়ের পর নাকি একই চেহারা দেখতে দেখতে ক্লান্ত অনুভব করে মানুষ। পরিবার প্রথা কি ভেঙে পড়বে ধীরে ধীরে? যাকগে ভেবে ভেবে কী হবে! “নদীর কূল নাই কিনার নাই রে…” একটা ভাটিয়ালি গান আছে না? সময়টা নদীর মতই পথ বদল করে দিক বদল করে  ভাঙনের মুখে কত আশ্রয় ভেঙে যায়। স্থিরতা বলে কিছু নেই, নদী তাই বলে। কিন্তু কষ্টে থাকা মানুষের দিকবদল হয় না। ঐ যে পারুল নামে মেয়েটির কথা বলল জগবন্ধু! কতশত পারুল এভাবে ঠিকানা হারিয়ে যৌনদাসীর জীবন যাপন করছে। এই জীবন তো তারা চায় নি। জোর করে ধরে এনে পিঞ্জরের ভেতর পুরে দেওয়া হয়েছে। কথাগুলো ভাবছিল পারিজাত পার্কে বসে। সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে আসছে। পার্কের বড় বড় গাছগুলোর মাথায় মাথায় জড়ো হচ্ছে আবছা আঁধার। এই সময়টা ভারি প্রিয় তাঁর।
জগবন্ধু বেশ আশ্চর্য মানুষ। পারুলকে সে ঐ চক্রের হাতে তুলে দিতে পারল কি করে? আবার ওখানেই ফিরে যেতে চাইছে। গিয়ে ঐসব কাজই তো করবে। একটা গোলমেলে লোক জগবন্ধু। তবু সে ওকে কিছুতেই ওখানে যেতে দেবে না, কিছুতেই না। যদিও জগবন্ধুর জায়গায় অন্য লোক বহাল হবে ওদের মহল্লায় এবং তরতর করে অসহায় মেয়েদের নিয়ে বাণিজ্য করার ব্যবসাটা চলতেই থাকবে।
এই ঘোর সন্ধ্যায় গাছের ঘন শাখাপত্রের ভেতর একটা বাদুড় ডানা ঝাপটে উড়ে গেল প্রতীকায়িত অলৌকিকের মত। যদি সে ভাবে এইটি পারুলের প্রেতাত্মা! তার মনের কথা বুঝতে পেরে এই গাছে এসে বসেছে তাহলে? তাকে বলে গেল কি, তুমি ভাবো আমাকে নিয়ে ভাবো। কেমন গা ছমছম করে উঠল না?
-কেমন আছেন? আকাশ পাতাল ভাবছেন?
পারিজাত আমূল চমকে ওঠে। পারুল কি? সন্ধ্যার আবছা আলোর ভেতর মেয়েটি অস্পষ্ট হাসে। বলে – এমনভাবে দেখছেন কেন? আমি কোনও অশরীরী নই। জলজ্যান্ত মানুষ। চিনতে পারেন নি, তাই না? সেই যে রেস্তরাঁতে.. মনে পড়ে?
মেয়েটি তার পাশে বসল।
-মনে পড়েছে। খুব কাঠ কাঠ কথা বলছিলেন সেদিন। আর কোনদিন আপনার সাথে দেখা হবে আর আপনি যেচে এসে বলবেন কেমন আছেন তা ভাবি নি। তাই আপনাকে ভুলে গেছি।  মনে করিয়ে দিলেন তাই মনে পড়ল। তা আপনি তো দেখছি আমাকে ভুলেন নি।
– দেখলাম গাছের দিকে তাকিয়ে আবোল তাবোল ভাবছেন সেজন্যে মনে পড়ে গেল এই আর কি। তা গাছ থেকে কি উড়ে গেল?
-আপনিও দেখলেন? অলৌকিক। প্রতীকায়িত।
-বাদুড়?
-দেখেছেন?
-ঠিকঠাক বুঝলাম না। তবে বাদুড়ই হয় সাধারণত।
কোনও মৃত মানুষের কথা ভাবছিলেন?
-হ্যাঁ ।পারুল।
-পারুল কে?
-যৌনদাসীত্বের জন্যে গ্রাম থেকে তুলে এনে বিক্রি করে দেওয়া একটি মেয়ে – নাম পারুল। একজনকে বিশ্বাস করেছিল। পরবর্তীতে এই মিথ্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে।
-তো সে এই বাদুড়ে রূপান্তর পেয়েছে?
-হতেও তো পারে।
-আপনি কি আমাকে প্রথমে পারুল ভেবেছিলেন?
-এই যে আবছা আলো তার ভেতর থেকে আপনি কেমন যেন ফুটে উঠলেন.. এর ঠিক আগে ডানা ঝটপট করে বাদুড়টি উড়ে গেল। আমি জগবন্ধু ও পারুলের কথা ভাবছি তারপর এই গাছের শাখাপত্র ভেদ করে বাদুড়টি উড়ে গেল। তারপরই আপনি… কেমন আছেন ইত্যাদি। আপনাকে এই পরিস্থিতিতে পারুল মনে হতেই পারে।
-জগবন্ধু কে?
-যাকে বিশ্বাস করে ভালবেসে গাঁয়ের মেয়ে পারুল বিক্রি হয়ে গেল।
-আপনি এতসব কি করে জানেন?
-জগবন্ধু বলেছে।
-জগবন্ধুকে কোথায় পেলেন?
-সে এখন আমার বাড়িতে আছে।
-সে কে?
-আগে জুহির বাড়িতে ছিল।
-জুহি কে?
-আমার প্রাক্তন।
-ওরে বাবা আপনারও প্রাক্তন আছে।
-কেন থাকতে পারে না?
-তা পারে।
-আরও জেরা করবেন?
-নাহ্! আমার প্রাক্তনও নেই বর্তমানও নেই।
-আপনাকে আমি তো কিছু জিজ্ঞেস করি নি।
-না করেননি। কেন করেননি?
-ধুর আপনার ওসব জেনে আমার কি হবে?
-আগ্রহ নেই?
-থাকলেই বা কি?
-থাকলে জিজ্ঞেস করুন।
-আপনি আমার সাথে মহল্লায় যাবেন?
-কিসের মহল্লা?
-ঐ জায়গাটাকে জগবন্ধু মহল্লা বলে থাকে। মানে যেখানে থেকে মেয়েরা পতিতাবৃত্তি করে।
-ওটা ওদের পেশা। বাঁচবার একটা উপায়। ওখানে কেন যাবেন? লেখালেখি করেন?
-নাহ্। লেখালেখির সঙ্গে ওখানে যাওয়ার কি সম্পর্ক?
-না মানে মেটিরিয়ালস চাই তো? মনে করুন আপনি একটি উপন্যাস বা গল্প লিখবেন বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকলে সেটি অনেক জীবনমুখী হবে। এধরণের ভাবনা থেকে লেখকরা ছদ্মবেশে কিংবা নিজবেশে ওখানে যায়। আপনি কেন যেতে চাইছেন?
-ঐ জীবনটাকে জানতে চাইছি।
-তাহলে আমাকেই জানুন না।
-মানে?
-আপনাদের ভাষায় আমিও একজন পতিতা। তবে ভদ্রতার ছদ্মবেশে করি। বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবে না।
বলতে পারেন কলগার্ল।
লাফিয়ে দাঁড়িয়ে যায় পারিজাত। প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে – না। একদম নয়। এটা হতে পারে না।

(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *