মিরুজিন আলো(পর্ব এগারো) বিজয়া দেব।

মিরুজিন আলো(পর্ব এগারো)

বিজয়া দেব।

বড় একা লাগে পারিজাতের। কারোর সাথে সেভাবে মিশতেও পারে না। সেই ছোট্টবেলা থেকে সে এরকমই। তার বন্ধুরা আছে, কিন্তু কেমন যেন অসংলগ্ন সম্পর্কে বাঁধা। নিজেকে সে জানে বিশেষভাবে, কিন্তু চারদিকে ছড়ানো পৃথিবীটাকে একদমই চিনতে পারে না। লোকজন কাছে এলেও কেমন যেন বেজোড় হয়ে থাকে। এজন্যেই এক বিশাল নিরাকার অন্ধকার তার চারপাশে
এক অন্ধ বলয় রচনা করে চলে। সবসময় মনে হয় তাকে জানে বোঝে এরকম একটা মানুষ পেলে খুব ভালো হত।
ছোটবেলায় মা মারা গেছে পারিজাতের। বাবার কথা আজকাল আর মনেই পড়ে না। বাবা আরেকটা বিয়ে করেছিল, তবে কীসব অশান্তির জেরে বাবা তাকে রাঙাপিসির বাড়িতে রেখে দূর বিদেশে চলে গেছে। তার পড়াশোনার জন্যে প্রচুর টাকা রাঙাপিসিকে দেয়। পারিজাতের অর্থকরী কোনও অভাব নেই। বাংলাসাহিত্যে মাস্টার্স করেছে বলে বাবা নাকি খুশি নয়। আজকাল ফোনে যোগাযোগ হয় না, আগেও কি হত? গুরুগম্ভীর কন্ঠে কেমন আছ পড়াশোনা কেমন এগোচ্ছে এর বাইরে তেমন কিছু বাড়তি কথা বাবা বলেছে বলে পারিজাতের মনে পড়ে না।
পারিজাতের চাকুরি জোটে নি আজও তবে ট্যুইশানে ছাত্রছাত্রী জমে যায় ভালোই। উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রির ছাত্রও আসে।
আজ সকালটা কেমন যেন ঘোলাটে। দূর আকাশে ছবির মত ডানা মেলে পায়রা উড়ছে। ছোটবেলায় ছবির বইএ ঠিক এরকম ছবি কত দেখেছে।  ছেঁড়া মেঘেরা ভাসছে। তার মতই নয় কি?
রাঙাপিসির শরীরটা ভালো নেই। বয়েস হয়েছে। পাশের বাড়ির এক কাকিমা এসেছে। আজ রাঙাপিসি বলছিল বাইরে না যেতে। কিন্তু ঘরের ভেতর হাঁফিয়ে ওঠে পারিজাত। কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে পড়ে। সে কাউকে খোঁজে। কে সে? নিজেই জানে না। সে খুঁজে একটা মানুষ যে তার একান্ত আপন।
নাহ্ দূরে আজ কোথাও যাওয়া ঠিক হবে না।  রাঙাপিসির বয়েস হয়েছে। শরীর ভালো যায় না। পারিজাত দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে বাড়ির চৌহদ্দির ভেতরেই। দাঁড়িয়ে লোক দেখছে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছে – “নানাদিকে লোক ধায় নানা মতে কাজের অন্বেষণে…”
ছোটবেলায় পারিজাতেরও অভ্যেস ছিল কতরকম। এরমধ্যে একটি ছিল রাস্তার লোকদের দেখা, প্রত্যেককে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কেউ হনহন করে যাচ্ছে, কেউ বিড়ি টানতে টানতে, মুখময় দাড়ির জঙ্গল, কখনও দুজন কথা বলতে বলতে, কখনও কাঁধে ভারী বোঝা নিয়ে কুঁজো হয়ে। আজ অনেকদিন পর মনে হল সেই পুরনো অভ্যেসটা দিয়ে বিকেলটা কাটিয়ে দেওয়া যাক। প্রথমেই যাকে দেখল সে তো চেনা লোক, জুহির জগবন্ধু। হাতে একটা কাপড়ের পোঁটলা। যাচ্ছে কোথায় পোঁটলা নিয়ে? পারিজাতকে দেখে জগবন্ধুর মুখময় হাসি।
জিজ্ঞেস করবে পারিজাত – যাচ্ছ কোথা? উত্তরে কি জগবন্ধু বলবে – চাংড়িপোতা? সেই যে অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছড়া – কিসের জন্যে – নেমতন্ন। বিয়ের বুঝি – না বাবুজি….
এ-ও বুঝি চলল চাংড়িপোতা!
যাইহোক অন্নদাশঙ্করকে আপাতত সরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল – ও ভাই, যাচ্ছ কোথা?
জগবন্ধুর সারা মুখময় হাসি। বলে – দুচোখ যেদিকে নিয়ে যায় দাদাবাবু।
পারিজাত হেসে বলে – চাংড়িপোতা?
বলতেই জগবন্ধু দাঁড়িয়ে যায়। বলে – সেটা কোথায় দাদাবাবু? ভারি সুন্দর নাম।
পারিজাত তো এমন মানুষকেই খুঁজে বেড়ায়, মেলে কোথায়?
বলে – বেশ তো যাবে। তাড়া নেই তো তেমন? তাহলে এসো না, আজ রাতটা এখানে থাকো। একটু ভালোমন্দ গল্প করা যাবে।
-আমার কীসের তাড়া? কিন্তু আপনি আবার জুহিদিদি ও দেবাংশী মায়ের হাতে আমাকে তুলে দেবেন না তো?
-আরে না না। আমাকে ওরকম মনে হয় তোমার? আসলে চাংড়িপোতা যাচ্ছ তো তাই ভাবলাম একটু গল্পগুজব করি, তোমার সাথে দুদিনের জন্যে আমিও যেতেও পারি। চলে এসো।
জগবন্ধু বলে – না দাদাবাবু।
সে এবার বলল – বেশ তো আমি না হয় একাই যাব। তোমার খুশিতে ভাগ বসাচ্ছি না। তবু এসো না। একটু গল্পগুজব হোক।
জগবন্ধু হেসে বলে – খুশি বললেন? তা বেশ বললেন।
পারিজাত সদর গেট খুলে ডাকে-আরে এসো।
জগবন্ধু একটু ভাবল তারপর সদর গেট পেরিয়ে হাসিমুখে বাড়িতে এসে ঢুকল।

(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *