আজ আমার কলমে,,,, চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ নারীর স্বাভাবিক জীবন কিন্ত বড়োই কঠিন যাপন ,,,,,,, কলমে-নিতু চৌধুরী।
আজ আমার কলমে,,,,
চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ নারীর স্বাভাবিক জীবন কিন্ত বড়োই কঠিন যাপন ,,,,,,,
কলমে-নিতু চৌধুরী।
সুধী পাঠকগন ,
একটা জিনিস খেয়াল করেছেন কখনও?আমাদের মানে মানব জীবনের গল্প গাঁথায় মোটামুটি সব বয়সেরই একটা নাম থাকে, এই যেমন ধরুন-শৈশব, কৈশোর, যৌবন, মেয়েবেলা, বৃদ্ধবয়স কিন্ত মেয়েদের চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ এই বয়সটার কোন নাম নেই অথচ একজন নারীর জীবনের অনেক টা অস্তিত্ব, অনেকটা না পাওয়ার গল্প, অনেকটা আইডেন্টটিটি ক্রাইসিস বা অনেক টা আশাহত হওয়ার গল্প জুড়ে থাকে এই বয়স টাতে ,তাহলে সেই সময়টার কোন নাম হয়না কেন বলতে পারেন?সংসারের জাঁতাকলের মতো বোধহয় এখানেও নারীর বয়স জনিত সমস্যা বলেই বোধহয় নাম থেকেও সে ব্রাত্য হয়েই থাকে।
চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ এই সময়টা একটা নারীর কাছে কিন্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ সময় কারণ আজ সে সব দায়িত্ব পালন করেও নিজের জন্য বাঁচতে শিখতে চায়, নিজেকে চিনতে চায়। আজ কিন্ত সে ম্যাচিওর দেহে এবং মনে।তাই নিজেকেই ভালোবাসতে চায়।নিজেকে নতুন রূপে দেখতে চায় প্রতিনিয়ত। কিন্ত এখানেও সে ব্রাত্য হয়েই থাকে ,কখনও কখনও নামহীন, গোত্রহীন এমনকি পরজীবী প্রাণীর মতো।
আজ আমার কলম বলবে সেই তথাকথিত অবহেলিত নারীদের কথাই,,,,,
একটা মেয়ে যখন জন্মায় , তখন তার নাম, তার গোত্র,তার বংশ পরিচয়, তার জীবনের নিত্য নৈমিত্যিক রুটিন সবই তার বাবার নামের সঙ্গে,বংশের সঙ্গে,গোত্রের সঙ্গেই জড়িয়ে থাকে। অর্থাৎ তার জীবন চলতে থাকে বাপের বাড়ির নিজস্ব নিয়মেই। ঠিক সেভাবেই মেয়েটির শরীরের গঠন, মনের পরিবর্তন, দেহের পরিবর্তন, শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াও চলতে থাকে নিজস্ব নিয়মেই।হঠাৎই একদিন সেই ছোট্ট মেয়েটি হয়ে ওঠে পূর্ণ যৌবনা বা যুবতী। নতুন নিয়মে তাকে বেঁধে ফেলে সমাজ, তার পরিবার, সে দায়ও সে মেনে নেয় মেয়ে হওয়ার অপরাধে।
কালক্রমে সে যখন তার মতো করে কিছু শিখছে,নতুন করে নিজের পছন্দ অপছন্দ খোঁজার চেষ্টা করছে ঠিক সেই সময় তাকে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ করে দেওয়া হয় সামাজিক রীতি অনুসারে।আজকাল অবশ্য ব্যতিক্রম হয়না তা নয় ,কিন্ত তবুও এখনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনও বিবাহযোগ্যা কন্যার পিতা মাতা বোধহয় সবসময়ই সমাজ সংসারের দায়ভার বহন করতেই বাধ্য হয়।
বিবাহিত মেয়েটি এবার ছাড়তে বাধ্য হয় তার অভ্যাস, পুরোনো চাল চলন এমনকি পুরোনো পদবী এমনকি কখনও কখনও তার বাবা-মায়ের দেওয়া আদরের নামটিও।অবশ্য এক্ষেত্রেও ইদানিং ব্যতিক্রমী মনোভাব বা ভাবধারা চালু হয়েছে কিন্ত সত্তর আশির দশকে সব মানুষকে ওভাবেই ভাবতে শেখানো হতো ,বা কোন কোন ক্ষেত্রে জোর করে ঘাড়ে নিয়মাবলী চাপিয়ে দেওয়ার রীতিই প্রচলিত ছিলো।নাহলে সেই সদ্য বিবাহিত কন্যাটির বাবা মাকেই অশিক্ষিত প্রতিপন্ন করা হতো মেয়েকে যোগ্য শিক্ষায় শিক্ষিত না করার অপরাধে।যদি কোনও বাবা মা মেয়ের অবিবাহিত থাকার ইচ্ছে কে মেনে নিতেন তাহলে তাদের কেও কটুক্তির স্বীকার হতে হতো বা এখনও হয়। স্বভাবতই আঠারো থেকে পঁচিশের মধ্যেই বিবাহযোগ্যা কন্যাকে পাত্রস্থ না করতে পারলে, বাবা মায়ের রাতের ঘুম উধাও হওয়ার জো।
এবার আসল কথায় আসি,,,,
কোন একটি মেয়ে হয়তো কুড়ি বছর বয়সে বিয়ে হয়ে শবশুর বাড়িতে গেলো। সেখানে গিয়ে সে তার কুড়ি বছরের অভ্যাস ছেড়ে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আপন করতে বাধ্য হলো বা বাধ্য করানো হলো, সেই বাড়ির আদব -কায়দা ,খাওয়া-দাওয়া,রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান এমনকি পদবী বা কখনও কখনও পিতৃ দত্ত নামটাও ছাড়তে। এক্ষেত্রেও হয়তো ব্যতিক্রম আছে কিন্ত তাহলে বলতেই হবে সেক্ষেত্রে সেই মেয়েটি অবশ্যই ভাগ্যবতী।
মোদ্দা কথা,মোটের উপর তখন থেকে মেয়েটি বা সেই গৃহবধুটি আস্তে আস্তে নিজের নাম পরিচয় ভুলে হয়ে গেলো অমুকের বউ,তমুকের বউমা, কারোর বৌদি এবং কালক্রমে কারোর মা, কাকিমা, জেঠিমা বা মামিমা।এই নাম গুলিই হয়ে উঠলো গৃহবধুটির পরিচয়।এবং মেয়েটি সব ছেড়ে শুধু অপরের জন্য নিবেদিত প্রাণ হয়ে বাঁচতে শিখলো কেবলমাত্র একজন ভালো গৃহবধু নামের জন্যই নয়, বাবা-মায়ের যেন কোন বদনাম না হয় সেই লক্ষ্যে।
এভাবেই বেশ ভালোই কাটছিলো তার দিনগুলো।আজ সে একজন চল্লিশোর্ধ প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়সের ভদ্রমহিলা ,যদিও মনে এখনও সে যুবতী। ঘন কালো লম্বা চুল এখন বেশ পাতলা হয়েছে,চুলে অল্প বিস্তর পাক ধরেছে। চোখের নিচে একটু কালো ছোপ,বা বেশ একটা দীর্ঘ রেখার সহাবস্থান হয়েছে। গায়ের চামড়ায় সেই উজ্জ্বলতা আর নেই, ফর্সা রঙ এখন বেশ ফ্যাকাশে।হাঁটু কোমর ইদানিং বয়সের কথা মনে করানোর জন্য বদ্ধপরিকর প্রতি মুহুর্তে।আজ সংসারে তার অবাধ স্বাধীনতা। কথায় কথায় শাশুড়ির কটু বাক্যবাণের জ্বালা সহ্য করা নেই, শবশুর মশাই এর ঘনঘন চায়ের আব্দার মেটানোর ঝামেলা নেই, ননদ-দেওর যে যার সংসারে ব্যস্ত। স্বামী নামক দেবতাটিও ইদানিং তার নিজের জগতে ব্যস্ত। সন্তানেরা তাদের মতো করেই তাদের জগতে বেশ খুশিতেই আছে। এখন আর তার ছেলেমেয়েদের তাকে খুব বেশি দরকার পরেনা। কিন্ত সেই মেয়েটি এবার বুঝতে পারলো এতো সবের মধ্যে তার নিজের জগত টিই হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে তার পছন্দের গান গাওয়া, ছবি আঁকা, গল্পের বই পড়া, হারিয়ে গেছে সেই ছোট্ট বেলার প্রিয় বন্ধুরাও, হারিয়ে গেছে তার স্কুল শিক্ষিকা হওয়ার স্বপ্ন বা ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। শুরু হয় তার নিজস্ব আইডেন্টটিটি ক্রাইসিস।
এখন তার জীবনে শুধুই হতাশা। গত কয়েক বছর ধরেই তার শরীরে আর হরমোন নিঃসরণ ঠিকমতো হয়না ফলতঃ সেই কারণেই শারীরিক নানা সমস্যা তার নিত্য সঙ্গী এখন। এখন সারাদিন যেন একটু শুয়ে বসে থাকতে চায় মন।কাজ করতেও সবসময় সাথ দেয়না শরীর। চুপ করে থাকতে ইচ্ছে করে অহেতুক কথার উত্তর না দিয়ে, যখন তখন ঘুম পায়।হঠাৎই গরম লাগতে শুরু করে পৌষের কনকনে শীতেও। কেমন যেন মনে হয় নিজের মতো থাকতে।হঠাৎ হঠাৎ মন কেমন করে ওঠে।মনে হয় ধূর এ জীবনে কিছুই তো করা হলোনা,কেমন যেন অকেজো লাগে নিজেকে।
ডাক্তারি পরিভাষায় এই চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর সময়টাকে মেনোপজ বলা হয়।
চীনে এই সময়টাকে বলা হয় “অকাল বসন্ত “,আর আমাদের দেশে বলা হয়, “ওর বয়স হয়েছে, নারীত্ব যেতে বসেছে এখনও সাজের ঘটা দেখো। যখন তখন চেঁচামেচি করা অভ্যাস হয়ে গেছে কারণ কার্য ক্ষমতা কমে গেছে, বুড়ি হয়ে গেছে।”
মেয়েটি তখন মেক আপের আড়ালে বা একগাল হাসির আড়ালে তার কষ্ট যন্ত্রনা গুলো লুকোনোর চেষ্টাই বদ্ধপরিকর হয়।
আমার একটাই প্রশ্ন পাঠক গন,
এই ভাবে না দেখে এই বয়সটার কি একটা নাম দেওয়া যায়না?
সেই মহিলা টিকে একটু সহমর্মিতা দেখানো যায়না?সে কেন ইচ্ছে মতো সাজলে, চড়া রঙের পোষাক পরলে অহেতুক কটু কথার শিকার হবে?কেন একজন নারীকেই না পারলেও সব কাজ অনিচ্ছা সত্বেও করতে হবে, কেবলমাত্র নারী বলে?
এতোদিন যে মানুষ টি বিনা পারিশ্রমিকে ঘরের সমস্ত কাজ যেমন ধরুন ধোপার কাজ, আয়ার কাজ,নার্সের কাজ,রাধুনীর কাজ,বাচ্চা মানুষ করার কাজ,স্বামী সেবার কাজ,অতিথি আপ্যায়নের কাজ হাসি মুখে করলো, একটা বাড়িকে স্বর্গ বানালো নিজের সব শখ আহলাদ বিসর্জন দিয়ে ,তার এই একাকীত্বের সময়ে ,এই যন্ত্রণার দিনগুলোতে, এই মেনোপজের সময়টাকে আশেপাশের মানুষ নরক বানাতে তৎপর কেন হয়?আজ কেন সে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পারবে না, আজ কেন সে বৃষ্টি ভিজে তার পছন্দের গান গুনগুন করতে পারবে না?কেন কারণে অকারণে খিলখিল করে হেসে উঠলে তার চারপাশের মানুষজন তাকে তার বয়স মনে করানোর জন্য তৎপর হয়ে ওঠে।কেন সমাজ তার কোন কাজ ঠিক আর কোনটা দৃষ্টিকটূ এটা বোঝানোর দায়ভার নেবে?
নারী শরীরে লুকিয়ে থাকে ভবিষ্যত প্রজন্মের বীজ। তাকে অবহেলা, অসম্মান করে কি আখেরে নিজেদের ক্ষতি নয়?
নারী যদি বিদ্রোহ করে তার নাম বদল না করতে চায়, সন্তান ধারণের কষ্ট সহ্য না করতে চায়,যদি নিজের মতো করেই বাঁচতে চায় আইডেন্টটিটি ক্রাইসিসে ভোগার বদলে তাহলে কি করে টিঁকবে এই সমাজ ব্যবস্থা নাকি এগোবে মানব প্রজন্ম?
যদি নারীরা বিদ্রোহী হয়ে বলে ওঠে ,,,,,
হোক চল্লিশ প্লাসের দুঃসহ যন্ত্রনা
অকাল বসন্তের আগমন,
শরীরে জমা বার্ধক্যের খাঁজগুলো
অকারণে করবো না আর লুকিয়ে রাখার পণ।।
ছানি পরা চোখে স্বপ্ন দেখার সাধ পূরণ করবোই, যতোই রাত্রি শেষ হোক আধো ঘুমে, আধো জেগে ,
আনমনা ঋতুর অকারণ ডাক সয়ে ,যতোই থাকুক শরীরে মনে ক্লান্তির দাগ লেগে।।
গাঁটে ব্যথা নিয়ে দৌড়োবার সাধ মেটাবোই, হোক যতোই রক্তে বাতের অবাধ যাতায়াত,
কুড়িতেই বুড়ি কথার কথা যদি হয়,চল্লিশ প্লাসে তবে কিসের করবো ভয়?
কিশোরী চঞ্চল মন, এখনও যে আমার খুকী ,
মুখ ফিরিয়ে বার্ধক্যের থেকে
যৌবনের ডাকে দেবোই উঁকিঝুঁকি।।
আমার একটাই অনুরোধ পুরুষ পাঠকগন, দয়া করে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবুন। একটা নারীকে তার কাজের ভিত্তিতে নয়,বয়সের ভিত্তিতে নয়, সৌন্দর্য্যের নিরিখে নয়, মানুষ হিসেবে ভাবতে শিখুন,দয়া করে সম্মান করতে শিখুন, আপনার বাড়ির নারী সদস্যাটির এই অযাচিত বয়সজনিত মেনোপজের সমস্যার সময় তাকে একটু সহমর্মিতার চোখে দেখুন। তাকে অবহেলা না করে ভালোভাবে তার নিজের মতো করে বাঁচতে সাহায্য করুন তবেই টিঁকবে এই মানব জাতির অস্তিত্ব,,,,
পরিশেষে একটাই কথা বলবো, নিজে একজন নারী বলেই না, একজন লেখিকা হিসেবে আমার চিন্তাভাবনা শেয়ার করলাম মাত্র।কারণ একজন লেখিকা হিসেবে আমি মনে করি পাঠক মনোরনঞ্জনের সাথে সাথে সমাজ সংস্কারক বা সমাজ কে সচেতন করাও একটা কলমের দায়িত্ব হয়ে থেকে যায়,,,,
ধন্যবাদান্তে,,,,
লেখিকা।