# পর্যালোচনা-মাণিক মুভি। # চলচ্চিত্র-পথের পাঁচালি। # কলমে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
# পর্যালোচনা-মাণিক মুভি।
# চলচ্চিত্র-পথের পাঁচালি।
# কলমে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
আমার প্রিয় মাণিক মুভি পথের পাঁচালি।চলচ্চিত্রটি বুঝিয়ে দিয়েছিল যে দরিদ্রের কুটিরে,গ্রামবাংলার নিসর্গে এক বিষণ্ণ নিরুচ্চার ভালোবাসা জড়িয়ে থাকে এবং তাকে অবলম্বন করে উচ্চ মানের চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব। এক নির্ভেজাল মানবিকতার বার্তা ছড়িয়ে পড়ল সারা বিশ্বে।১৯৫৫ সালে মুক্তি প্রাপ্ত ছবিটি ১১ টি আন্তর্জাতিক পুরষ্কার পায়।১৯৫৬ সালে ‘কান’ চলচ্চিত্র উৎসবে পায়-শ্রেষ্ঠ মানব দলিল পুরষ্কার-Best Human Documentary. পুরষ্কার।
গল্পটি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালি।লেখক গ্রামবাংলার হত দরিদ্র এক পরিবারের পূরণ না হওয়া আশা-আকাঙ্খা র বেদনা লিপিবদ্ধ করেছেন।সব কিছু দেখছে ঐ পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছোট্ট অপু।তার চোখে জীবন যেন পাঁচালি গায়কের পায়ে চলা পথ।সত্যজিৎ রায় সেই তথ্যই অসাধারণ দক্ষতায় চলচ্চিত্রে রূপায়িত করেছেন।
সিনেমার পর্দা জুড়ে গ্রামের দৃশ্য দেখে আমরা চিনে ফেলি এই তো আমার গ্রাম।পথের পাঁচালির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো ক্যামেরার কাজ।অপু-দুর্গার রেলগাড়ি দেখতে যাওয়া কাশফুলের ঝোপের মধ্যে দিয়ে,দূরে রেলগাড়ির ধোঁয়া,দিনের আলো নিবে সন্ধ্যা নেমে আসা অথবা প্রবল বৃষ্টিতে ভাইকে আঁচলের তলায় নিয়ে দুর্গার-লেবুর পাতায় করমচাকে-আহ্বান দর্শককে আবিষ্ট করে রাখে।গ্রামের জঙ্গলাকীর্ণ পথ,পুকুর,ডোবা নিস্তরঙ্গ জীবনের ছবি দেখিয়েছেন মাণিকবাবু।অনুসন্ধিৎসু ভাই-বোন সেখান থেকেই খুঁজে নেয় খেলার সামগ্রী।অপুর চোখ দিয়েই জীবনদর্শন।-“দিদিটা তাহলে সত্যিই চুরি করেছিল!”-তারপর জিনিসটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়া পুকুরে।জলের বৃত্তাকার ঘুর্ণনে জিনিসটার তলিয়ে যাওয়া, এক অসাধারণ জীবনবোধের পরিচয় দেয়। চুরির অপবাদে অপমানিত মায়ের হাতের নির্মম প্রহার,দিদির জন্য অপুর ব্যাকুলতা সবই অতি কঠোর বাস্তব।শতাব্দী প্রাচীন সমাজকাঠামোয় কন্যাসন্তান লাঞ্ছিত হয়েও বুঝতে পারত না সে অবহেলিত।তাই অপুর একবাটি দুধ খাওয়া সতৃষ্ণ অথচ সস্নেহ দৃষ্টিতে দেখে দুর্গা এবং খাওয়ার পরে ভাইয়ের মুখ মুছিয়ে দেয়। দর্শক অজান্তেই বলে ওঠেন-” ইস্ মেয়েটাকে দিল না!”-এবং এখানেই চিত্রনাট্যের সার্থকতা।বৃদ্ধা ইন্দির ঠাকরুণের সঙ্গে সর্বজয়ার রূঢ় ব্যবহারও যে মনস্তত্ত্বের এক জটিলতা তা অতি সরলভাবে দর্শকের বোধগম্য হয়ে ওঠে,মানবিকতার অশ্রু ভাসিয়ে দেয় চোখ।
ঝড়জলের রাতে ভাঙা ঘরে বসে অসুস্থ দুর্গার মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে বড় বড় চোখে সর্বজয়ার সেই সত্রাশ দৃষ্টি,বিদ্যুৎ চমকের আলো আঁধারি পরিবেশ সৃষ্টি,দুর্গার মৃত্যু দর্শককে চরম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
হরিহর আসে অনেক দিন পরে।সে দুর্গার জন্য শাড়ি এনেছে।সর্বজয়া মাথা নেড়ে জানিয়ে দেয় দুর্গা নেই।হরিহরের বোবা কন্ঠে -“মা”-বলে কেঁদে ওঠা,নেপথ্যে স্তব্ধ আবহ বুঝিয়ে দেয়,কত বড় মাপের পরিচালক সত্যজিৎ রায়।
সঙ্গীত পরিচালনায় উপযুক্ত সঙ্গত করেছেন রবিশঙ্কর। সমগ্র ছবিতে আবহ তাই বিশেষ মাত্রা পেয়েছে
প্রতিজন অভিনেতা অভিনেত্রী পরিচালকের পরিচালনায় ও নিজেদের দক্ষতায় বাস্তব হয়ে উঠেছেন এবং অবশ্যই কালজয়ী।অপুদের ভিটে ছাড়ার দৃশ্যের সঙ্গে সেই পরিত্যক্ত ভিটেয় সাপের প্রবেশ দর্শকের অন্তর কাঁপিয়ে দেয়।
সমগ্র সিনেমাতে এই ইঙ্গিত ধর্মিতাই ১১ টি আন্তর্জাতিক পুরষ্কার আনতে সহায়তা করেছিল।ভাষা সেখানে কোন প্রতিবন্ধকতা করতে পারেনি।তাই পথের পাঁচালি আমার অন্যতম প্রিয় মুভি।
সত্যজিৎ রায়কে প্রণাম জানিয়ে শেষ করলাম।💅💅