স্পর্শ (১) ✒️✒️ সুদেষ্ণা সিনহা
স্পর্শ (১)
সুদেষ্ণা সিনহা
অন্ধকারে পুলুর সারা শরীর জুড়ে হাতটা ঘোরাফেরা করে। এই হাত বড় চেনা তার। শক্ত,খসখসে দুটো হাত।এই হাত ধরেই পুলুর বড় হয়ে ওঠা।এই হাত বড় নির্ভরতা দেয় তাকে। এই হাত তার আম্মুর হাত।
জন্ম ইস্তক পুলুর চোখে আলো নেই।সে তার আব্বাকে চেনে না। কোনদিন দেখেওনি। ইমরান তার ছেলেবেলার বন্ধু। মাধ্যমিক পাশ করে মাদ্রাসাতে এগার ক্লাসে ভর্তি হয়েছে এবারে। তাদের মসজিদ পাড়াতেই থাকে। পুলু দেখতে পায়না বলে গ্রামের ইস্কুলে ভর্তিও নেয়নি তাকে।মাস্টারমশাই বলেছিলেন অন্ধদের আলাদা স্কুল আছে।সেই ইস্কুলে ভর্তি হতে টাকা লাগে।পুলুর আম্মুর অত টাকা নেই।
ইমরানের আব্বা মক্কায় থাকে। হজযাত্রীদের জুতো পাহারা দেয়। ওর আব্বা যখন এদেশে আসে,ইমরানের জন্য তখন অনেক উপহার নিয়ে আসে।পুলু ভাবে তারও যদি এরকম একটা আব্বা থাকত!
পুলু আম্মুকে আগে জিজ্ঞেস করত,”আম্মু আব্বু আসে না ক্যান?”
আম্মু বলত,” বাপ এ কতা থাক এহন।তোমারে পরে কইমু।”
পুলুর আম্মু,রাবেয়া কোলকাতায় আয়ার কাজ করে।কাজের বাড়ি থেকে যে খাবার পায় আম্মু তা টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে নিয়ে আসে পুলুর জন্যে। খাবারের থাক থাক বাটি বের করে আম্মু গরম করে।কান খাড়া করে শব্দ শোনে সে।বাটির শব্দ,কড়াই-এ খুন্তি নাড়ার শব্দ,ফুঁ দিয়ে কেরোসিন স্টোভ নেভানোর শব্দ….তারপরই যত্ন করে হাঁড়ি থেকে হাতা দিয়ে ভাত বের করে আম্মু,চামচে করে তরকারি সাজায় থালায়, পুলুর সামনে এনে ধরে।বড় সুস্বাদু খাবারের গন্ধে পুলুর পেটে খিদে জানান দেয়।জিভে রসালো লালা বেরিয়ে আসে। কোনমতে ঢোক গিলে পুলু বলে,”খাওয়াই দাও না আমারে।”
পরম যত্নে ভাত তরকারি মেখে পুলুর মুখে ধরে রাবেয়া,”নাও বাপ।অহন আ কর।বড় কইরা আ কর দেকি।গপাগপ খাইয়্যা লও।”
এখন পুলু জানে তার আব্বা তার আম্মুকে তালাক দিয়েছে।আম্মু বলতে চায়না কোন কথা ,কিন্তু তার নানীমা তাকে বলেছে তার কারণেই আব্বা তার আম্মুকে তালাক দিয়েছে। সে জন্ম থেকেই অন্ধ।ছয় মাস বয়সে সবার নজরে পড়ে যে বেটা চোখে দেখতে পায় না। আব্বা রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে কেরালায় গিয়েছিল।ঈদের সময় বাড়ি আসলে দাদিমা তাকে সব জানিয়েছিল। সব শুনে আম্মুর চুলের মুঠি ধরে মারতে মারতে আব্বা বলেছিল,”তু এত খেয়ে কানা বেটার জন্ম দিলি? তুরে আমি মাইরা ফেলুম। কাইট্যা ফেলুম।”