মুক্তগদ্য “বৈশাখ হে মৌনী তাপস” -বিজয়া দেব।

মুক্তগদ্য
“বৈশাখ হে মৌনী তাপস”
-বিজয়া দেব।
“জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক…” এভাবেই নতুনের আহ্বান করি আমরা। পেছনে ফেলে আসি মূল্য অমূল্য। যা ফেলে আসি তার নির্যাসটুকু সম্বল করে নিয়ে নতুনের পথ চলি। আবার অনন্ত কালস্রোতে দাঁড়িয়ে দেখি আমাদের ফেলে আসা খন্ডমুহূর্ত ও গ্রহণ করা নতুন মুহূর্তের সমবায়ে আমাদের যাপন আধো আলো আধো ছায়ার রহস্যালোকে আবৃত। নিজেকেই তখন বড্ড অচেনা বলে বোধ হয়। তখন ভাবি জীবন কি সত্যিই অর্থবহ না কি নিরর্থক না কি পুরাতন নতুনের সমবায়ে এক প্রশ্নময় অস্তিত্ব।
৩৬৫ দিন ঘুরে গেলে নতুন বছর আসে আমাদের যাপনে দু’বার। একবার নতুন ইংরাজি বছরে আরেকবার বাংলা নববর্ষে। পাশ্চাত্য শৈলীতে ৩১ শে ডিসেম্বর ও ১লা জানুয়ারি উদযাপিত হয় আর ৩০ শে চৈত্র ও পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয় বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির হাত ধরে।
শৈশবে পঞ্জিকা হাতে নিয়ে দেখতাম নববর্ষে হালখাতার ছবি। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে আমন্ত্রণপত্র আসত। চিঠির উপরে হালখাতার উৎসবে এক ধুতিপাঞ্জাবি পরা বাঙালি আসনপিঁড়ি হয়ে বসে আছেন আর সামনে বেশ বড় খাতা হাতে কলম ধরা। একটা হিসেবনিকেশের ব্যাপারকে দিব্যি ফুটিয়ে তোলা হতো।
এই হালখাতা ব্যাপারটি ঠিক কি? স্বাভাবিক ভাবেই মনে প্রশ্ন জাগত। পরে জানতে পারি হালখাতার বেশ কিছু ব্যাপকার্থ রয়েছে। “হাল” শব্দটির অর্থ আমরা জানি “এখন” কিংবা “নতুন” । সে হিসেবে “নতুন খাতা” মানে নতুন বছরে নতুন হিসেব নিকেশের নতুন খাতা। পুরাতন হিসেব নিকেশ শেষ হতো শেষ চৈত্রে।
আবার অন্য আরেকটি ইতিহাসও আছে। “হাল” শব্দটি “হল” থেকে এসেছে বলেও জানা যায়। “হল” মানে “লাঙল”। লাঙল আবিষ্কারের পর মানুষ সমাজবদ্ধ হয় ও আশ্রয়স্থল তৈরি করে বসবাস শুরু করে। লাঙল আবিষ্কারের পর কৃষিজাত দ্রব্য উৎপন্ন হওয়া সহজতর হয় এবং কালক্রমে তা কৃষিপণ্যে পরিণত হয়। এই কৃষিপণ্য বিনিময়ের হিসেব যে খাতাতে লেখা হতো সেই খাতাকে বলা হতো হালখাতা। সেই থেকে পুরনো হিসেব মিটিয়ে নতুন খাতাতে নতুন বছরে নতুন হিসেব লেখার খাতাকে বলা হল হালখাতা। হালখাতার মলাট লাল কাপড়ে মোড়া উপরে স্বস্তিকাচিহ্ন। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে এই হালখাতার পুজো হয় এবং মাঙ্গলিক পথ চলার সংকেতবাহী হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
এছাড়াও, রাজা রাজড়া সম্রাট বাদশারা সারা বছরের রাজস্ব আদায়ের হিসেবনিকেশের শেষে একটি উৎসবও পয়লা বৈশাখে করতেন বলে জানা যায়। সম্রাট আকবর এই রাজস্ব আদায়ের বার্ষিক হিসেবনিকেশ শেষে পয়লা বৈশাখে পুণ্যাহ উৎসব চালু করেন। পরবর্তীতে মুর্শিদাবাদের শাসক মুর্শিদ কুলি খাঁ-ও পুণ্যাহ উৎসব করতেন।
লোকায়ত জীবনযাপনেও শেষ চৈত্র ও পয়লা বৈশাখের বিশেষত্ব রয়েছে। চড়কপুজো নীলষষ্ঠী শিবের গাজন ইত্যাদি আমাদের যাপনে কখনও প্রত্যক্ষ কখনও পরোক্ষে জড়িয়ে আছে। আমাদের আসাম অঞ্চলে পুরো চৈত্রমাস জুড়ে চড়কপুজোর জন্যে বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল সবজি ডাল টাকা পয়সা নেওয়ার প্রথা চালু আছে লোকায়ত জীবনে। সারা চৈত্রমাস জুড়ে হরগৌরীর নাচ, কালী সেজে এসে নাচ দেখানো এসব রীতি শৈশব স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে। বিশেষ করে উদাসী চৈত্রের সন্ন্যাসীরূপের সঙ্গে চড়কপুজোর হরগৌরীর দুপুর রোদে ঘুরে ঘুরে নাচ দেখানো, শিবের সারাদেহে ভস্মের রূপকল্পে সস্তার রূপোলি রঙ মাখানো দেহে চৈত্রে খরতাপের ঝলসিত রূপ, মাথার উদাসী জটাজুট, গৌরীর কাঁচাহলুদ মাখা মুখের সাথে চৈত্রের সন্ন্যাসীরূপের অদ্ভুত সাযুজ্য দেখেই উপলব্ধ হয় প্রকৃতির সাথে লোকায়ত জীবন কী অপরূপভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। যাঁরা চড়কপুজো করেন এঁরা শিবের উপাসক। চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক গাছকে ঘিরে নিজেদের নানাধরণের কষ্ট দিয়ে এঁরা মহাদেবকে সন্তুষ্ট করতে চান বর্ষশেষে, নতুন বছর শুরু করতে চান মহাদেবের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে।
এদিকে বস্ত্রবিপণিতে তখন চলে চৈত্রসেল। জীর্ণ পুরাতনকে সরিয়ে দিয়ে নতুনের সম্ভার দিয়ে বিপণিকে সাজানোর প্রক্রিয়া।
বৈশাখের প্রথম দিনে বাঙালি মেতে ওঠে বর্ষবরণে। গানে কবিতায় নৃত্যে পত্র পত্রিকা প্রকাশে নতুন বছরকে বরণ করার এই নান্দনিক প্রকাশ নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বর্ণাঢ্য হয়ে ওঠে। আর এদিকে খরবৈশাখের মৌনী তাপস মূর্তি তা প্রত্যক্ষ করে তার বিলগ্ন বৈশিষ্ট্যে।
………………………………………….