** গল্পের শেষ ** কাবেরী বোস ঘোরাই
** গল্পের শেষ **
কাবেরী বোস ঘোরাই
এটাই আমার শেষ লেখা , আর তোমরা আমার কোনো লেখা পড়তে পারবেনা কারণ !!! লেখা থামিয়ে টেবিলের ওপর রাখা স্লিপিং পিল গুলো গলঃকরণ করে নিলো লোকটি,আর সে লিখতে পারছেনা সত্যি কারণ আর সে বাঁচতেই চাইছেনা!!এই কথাগুলো বিখ্যাত লেখক বারীন বাড়ুজ্জ্যের লেখা, খুব সাধারণ দেখতে রোগা ছিপছিপে গাল তোবড়ানো একটা লোক , ধুতি পাঞ্জাবিতেই চিরকাল স্বচ্ছন্দ ছিলেন কিন্তু কালের টানে এখন পায়জামা পড়েন তাও ঢোলকা মতোন , চোখে মুখের চেয়ে বড় একটা আদ্যিকালের মোটা কালো ফ্রেমের চশমা , জীবনে শখ আহ্লাদ বলতে ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে পুঁইশাক এর চচ্চড়ি , কচি পাঁঠার ঝোল , আর দামি ব্র্যান্ডের কিছু সিগারেট খাওয়া তবে এই তিনটেই প্রায় বন্ধের দিকেই কারণ কিছুটা শারীরিক বেশীরভাগটাই আর্থিক এবং বাকি পুরোটাই মানসিক! পৈতৃক সূত্রে উত্তর কলকাতায় একটা পুরোনো দুকামরার বাড়ি আছে তার ,তবে সেটাও দেখাশোনার অভাবে ভগ্নস্তূপে পরিণত হচ্ছে ধীরে ধীরে , একটা ঘরেই বারীন থাকে এবং ওই ঘরেই তার সবকিছু , পাশের ঘরটা এখন রান্না খাওয়া করে , সে একা মানুষ কি এমন খায় কিন্তু তবু অন্য কিছু করতে মন চায়না কারণ সুরমা মানে তার বৌ ওই ঘরটাই রান্নাঘর প্লাস খাওয়ার ঘর হিসেবে তৈরী করেছিলো কারণ রান্নার জায়গাটা বড় ছোট তাদের এক ফালি জায়গা মাত্র , ওখানে এখন বারীন চেয়ার রেখে রোদ পোহায় বই পড়ে এসব আর কি!! সুরমা যতদিন ছিলো তবু একটু শান্তি ছিলো ,তার আগোছালো মনখারাপিগুলো বহু যত্নে রোদ্দুর পেতো সুরমার কোলে মাথা রেখে বারীন তার শুখনো জীবনে তা দিতো , আর আশ্চর্যজনক ভাবে সুরমা কিভাবে যেনো তার ছেঁড়াফাটা সংসারটাকে ঠিক সেলাই করে রিফু করে চালিয়ে নিয়ে যেতো! কারণ বারীন লেখা ছাড়া আর কোনো কাজই সেভাবে পারতোনা , প্রথম দিকে বেশ নাম ডাক হবার পর আস্তে আস্তে লেখাও কমিয়ে দিয়েছিলো বারীন কিজানি কেন আর মন বসতোনা , লেখা আসতোনা অথচ পাঠক চাহিদা তুঙ্গেই ছিলো !তবু বারীন লিখতে পারতোনা ওই কোনোক্রমে দু তিনটে !! রয়ালিটির টাকাতেই চলতো সংসার তবে ওই যে বললাম সুরমা ঠিক চালিয়ে নিয়ে যেতো!! তারপর একদিন মার অসুখের খবর পেয়ে বারীন দেশের বাড়ি গিয়েছিলো সাতদিন বাদে এসে দেখে সুরমা চলে গেছে তাকে ছেড়ে! একটা চিঠি রেখে গিয়েছিলো তাতে লেখা ছিলো ,খুঁজতে হলে নিজেকে খুঁজো আমায় নয় কারণ আমায় তুমি হারিয়ে ফেলেছো যদি কোনোদিনো নিজেকে খুঁজে পাও তাহলে আমাকেও ফিরে পাবে!! বারীন হতভম্ব হয়ে তবু খুঁজেছিলো তন্ন তন্ন করে অনেক থানা পুলিশ অনেক হয়েছিলো কিন্তু ওই চিঠি দেখে আর কেউ বিশেষ খোঁজেনি সুরমাকে!! শুধু বারীনের মনখারাপিগুলো ভিজে গিয়েছিলো তার বুকের কষ্টের আড়ালে!! আর কেউ তাকে গরম রুটি করে ডাকেনি বলেনি খেতে এসো নইলে এবার ঠান্ডা হয়ে যাবে খাবার , কেউ তার ঘর্মাক্ত গেঞ্জি জামা পরমযত্নে কেচে দেয়নি , কেউ তার এলোমেলো চুলে ঠান্ডা হাত দিয়ে হাত বুলিয়ে দেয়নি ! কেউ তার তোবড়ানো গালে চুমু খেয়ে বলেনি এই তুমিই আমার সেই প্রেমিক যাকে আমি স্বপ্নে জেগে সবসময় চেয়েছি!! একসময় সব খোঁজা শেষ হয়েছিলো আস্তে আস্তে অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো সুরমাবিহীন এই জীবন ! এরপর শুধু কিছু শুকনো জীবনের মতো শুকনো খাবার খেয়ে বেঁচে থাকা বারীনের !! লেখা প্রায় নেই বললেই চলে তবু খুব অনুরোধে লেখে একটাই কোনোক্রমে! যখন প্রতিনিয়ত লিখতো সবাই তাকে মাথায় তুলে নাচতো আজ সে প্রায় অবলুপ্তির পথে তাও ওই নামের জোড়েই চলছে কোনোরকমে , কিন্তু বারীন আজ এই লেখাটি তার মোবাইলে লিখেছে post প্রায় করেইনা সে তবু একটা একাউন্ট খুলে এইটুকুই জানান দেওয়া বেঁচে আছি ব্যাস এইটুকুই যেনো, সঙ্গে সঙ্গে বহু কমেন্ট আসা শুরু কি হলো ! কেন হলো !! কি হয়েছে ইত্যাদি সেসবের উত্তর দেওয়া নিষ্প্রয়োজন বারীনের কাছে , আস্তে আস্তে উঠে সে পাশের ঘরে গেলো সেখানে আলমারিটা বহু কষ্টে সরালো কারণ তার লিকলিকে শরীরে অতো জোর কোথায়! বোঁটকা একটা গন্ধ নাকে এলো!! কিছু কেরাসিন ছিটোলো বারীন সেখানে তারপর আগুন জ্বালালো খুব সন্তর্পণে , আগুন জ্বলে উঠলো দাউদাউ করে !! বেশ কিছুখন পর বারীন সেখানে জল ঢেলে নিভিয়ে বাইরে চলে এলো!! সবাই জানে বারীন বাড়ুজ্জ্যের মাথাটা সুরমা চলে যাবার পর থেকেই ওরম হয়ে গেছে প্রায়ই সে নানা জিনিষ ঘরে বাইরে পোড়ায়!! কখনো পুরোনো ছেঁড়া কাগজপত্র কখনো জামাকাপড় বা কখনো সুরমার হাড় গোর!!! বারীন জেনে ফেলেছিলো সুরমা তাকে ছেড়ে যাওয়ার প্ল্যান করছে !! তার পুরোনো প্রেমিকের সাথে!! তারপর আর কি নিজের হাতে সুরমাকে মেরে এই আলমারির পেছনে ইটের প্রাচির দিয়ে গেঁথে দিয়েছিলো তারপর মার অসুখ বলে চলে যাওয়া আর এসে তন্ন তন্ন করে সুরমাকে খোঁজা আর চিঠিটা ওটা সুরমারই লেখা বারিনের বহু গল্পের আটকে যাওয়া জায়গা ফিল আপ করার জন্য সুরমারই লেখা , সেটাই ব্যাবহার করা সুরমার আত্মহত্যার চিঠি বলে!! সুরমাকে মারতে তার খুব কষ্টই হয়েছিলো,আসলে বারীন বাড়ুজ্জ্যের স্বভাব হলো তার গল্পের শেষটা মিলিয়ে দেওয়া তাই সে তার ভাবনাকে চিরকাল কোনো কাছের বিশেষ মানুষের মধ্যে তৈরী করেছে এবং সেইভাবেই বাস্তবে রূপায়িত করেছে সে যেভাবে গল্পের শেষটা মেলাতে চেয়েছে এইজন্য যতদুর যেতে হয় সে গেছে তাই আজ বহু বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজনহীন সে!! সেটা বাস্তবে আনার জন্য চরম পরিণতি সে গেছে বহুবার!! তবে এ অসুখ তার বাড়ছে দিন দিন তাই সে গল্প লেখা থামিয়ে দিয়েছে তবু সব গল্পের শেষে একটা মৃত্যু চাই এটাই তার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তাই সুরমাকে দিয়েই হাতেখড়ি হয়েছে তার কারণ গল্পের নামটাই ছিলো যে পরকীয়া!!! আর আজ যে শেষ গল্প লিখেছে তাতে শেষে লেখক আত্মহত্যা করছে!! গল্পের শেষ মিলিয়ে দিতে হবে যে তবেই তো সে জাত লেখক হবে নাকি কলম আঁচরে হাজার শব্দ নামিয়ে মাইকে চিল্লিয়ে আধডজন পুরস্কার জিতে প্রমান করতে হবে সে লেখক!!! নাঃ!! সে যে জাত লেখক চোখ বুজে আসছে দেখা হবে সুরমার সাথে আবার!!!!
#নীলবৃষ্টি
স্বত্ব সংরক্ষিত