# বাংলা সাহিত্যের উৎস সন্ধানে চর্যাপদের কাব‍্যমূল‍্য। # কলমে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

# বাংলা সাহিত্যের উৎস সন্ধানে চর্যাপদের কাব‍্যমূল‍্য।
# কলমে-ছন্দা চট্টোপাধ্যায়

বর্তমানে বাংলা সাহিত্যচর্চার উৎসাহ ব‍্যাপক হারে দেখা যাচ্ছে। এটা খুবই ভালো লক্ষ্মণ। কোন্ বিবর্তনের ফলে সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হলো,তা বাংলা সাহিত‍্যের মনোযোগী সব ছাত্র,পাঠকই জানেন। আজ আমি আদিযুগের বাংলা ভাষার সর্বাংশে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন -“বৌদ্ধগান ও দোহা”- নামক গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত চর্যাপদগুলি নিয়ে কিছু আলোচনা করবো।গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছিলেন পণ্ডিতপ্রবর হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়।বাংলা সাহিত‍্যের আদিগ্রন্থ এখনো চর্যাপদকেই বোঝানো হয়।

প্রাচীনতম বাংলা পদসঙ্কলন চর্যাগীতিকা মূখ‍্যত তত্ত্ববাদের বাহক,গৌনত কাব‍্য। যা মূলত তত্ত্বদর্শনের মধ‍্যে বিধৃত এবং মুমুক্ষু চিত্তের কাছে অধ‍্যাত্ম আশ্বাসের ইঙ্গিত বহন করে। চর্যাপদ বিশুদ্ধ কাব‍্যের আদর্শে বিচার্য নয়। চর্যাপদ গুলি ছোট ছোট গীতিকবিতারই সমষ্টি। এদের বয়স প্রায় হাজার বছরের কাছাকাছি। বৌদ্ধতান্ত্রিক সহজিয়া সাধকগণই এই পদ গুলির রচনাকার।ঠিক সাহিত‍্যসৃষ্টির প্রেরণা নয়,রচনাগুলির সক্রিয় উদ্দেশ্য ছিলো সহজিয়া মতবাদের প্রচার। তার তান্ত্রিক ভাবধারা ও গুহ‍্য যোগসাধনার প্রকাশ। চর্যার সংখ‍্যা ৪৬/৪৭ টি।মোটামুটি ২৪ জন পদকর্তার নাম উল্লেখ করেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়।

চর্যাপদের মধ‍্যে স্বতঃস্ফূর্ত রসের আবেদন এবং বাক্ নির্মানের শিল্পকৌশল রক্ষিত হয়।কেউ কেউ কাব‍্যনির্মাতার পারিভাষিক রীতি অর্থাৎ আলঙ্কারিক বিচারপ্রক্রিয়ার সাহায্যে চর্যার ছন্দ, অলংকার
ধ্বনি, বক্রোক্তি, রস বিশ্লেষণ করে এর কাব‍্যধর্ম প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। এই রীতির কাব‍্যবিচার নিতান্তই বাহ‍্যিক। চর্যাকারগণ সচেতনভাবে কাব‍্য রচনার প্রয়াস পাননি। তাঁরা একটা বিশেষ ধরনের তত্ববাদ ও গুহ‍্য সাধনাকে প্রাকৃত অপভ্রংশের প্রকীর্ণ কবিতার মতো স্বল্পতম আয়ত নের মাধ‍্যমে নানা সংকেতের সাহায্যে ব‍্যক্ত করতে চেয়েছিলেন।
যে ভাষায় চর্যা লেখা হয়েছিল তাকে বাংলা তো নয়ই, একটা অপরিচিত ভাষার মতো সন্দেহ হয়।কারণ বাংলা ভাষা তখনো সৃজ‍্যমান,সবেমাত্ অপভ্রংশের খোলস ছেড়ে স্বতন্ত্র একটি রূপ নিতে শুরু করেছে।তাই এর বিশেষ আদল বুঝতে গেলে ভাষাতাত্বিক গবেষণার প্রয়োজন হয়। গবেষকরা লক্ষ‍্য করেছেন চর্যাপদগুলির বহিঃরূপ ও অন্তর্নিহিত রূপের অর্থবৈষম‍্য আছে। চর্যাগীযির আসল রহস‍্য তাঁরাই বুঝবেন,যাঁরা বৌদ্ধ সহজপন্থা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। একটি পদ উদ্ধৃত করলে বোঝা যাবে,
-“চিঅ সহজে শূন সংপুন্ন।
কান্ধবিয়োএঁ মা হোহি বিসন্না।
ভন কইসে কাহ্ন নাহি।
ফরই অনুদিন তৈলোএ পমাই।
মূঢ়া দিঠ নাঠ দেখি কাঅর।
ভাগ-তরঙ্গ কি সোষই সাঅর।
মূঢ়া অচ্ছন্তে লোঅ ন পেখই।
দুধ-মাঝে লড় অচ্ছন্তে ন দেখই।
ভব জাই,ণ আবই এথু কোই।
অইস ভাবে বিলসই কাহ্নিল জোই।।”- পদটিতে ব‍্যবহৃত ভাষার সঙ্গে একালের বাংলা ভাষার বিস্তর প্রভেদ। এর আদল অনেকটা ভারতীয় মধ‍্যযুগের আর্যভাষা প্রাকৃতের শেষ স্তর অপভ্রংশেরই মতো। আর রূপক-উপমাদি প্রয়োগের মাধ্যমে এই পদে যা প্রচারিত হয়েছে,তা সহজসিদ্ধাদের গুঢ় তত্বকথাই বটে।এতে সহজসাধক কৃষ্ণাচার্য সিদ্ধাবস্থায় তাঁর অনুভবের কথা বলেছেন।জগতের অনিত‍্যতা সম্বন্ধে তিনি জ্ঞানলাভ করেছেন।

দেখা যাচ্ছে, তত্বদর্শনের কথা বলতে গিয়ে চর্যাগীতিকার নানা রূপক,প্রতীকের ও চিত্রকল্পের সাহায্যে উদ্দিষ্টার্থকে মনোরম করে তুলতে চেয়েছেন। এই চিত্র প্রতীক গুলি একদিকে যেমন উদ্দিষ্ট অর্থকে সংহত আকারে প্রকাশ করেছে,তেমনই চিত্রকল্প ও রূপকল্পকেও আবার অজ্ঞাতসারে একটা শিল্পমর্যাদা দিয়েছে।অনেক সময় রূপক ও প্রতীকের সাহায্যে দূরূহ তত্বকেও স্পষ্টতর করা হয়েছে। যেমন– শরবৃক্ষ (১),ভবনদী পারাপার (৫), হরিণশিকার(৬),ডোম্বী ও শবরীর আৎষঙ্গ(১০,২৮),শবর ও শবরীর মদমত্ত উল্লাস(৫০), দরিদ্রা গর্ভিনী রমনীর মনোবেদনা(২০), গৃহদাহ(৪৭),জলদস‍্যুর আক্রমণ (৪৯), প্রভৃতি বাহ‍্যিক রূপকের সাহায্যে আচার্যগণ চর্যার গুঢ় রহস‍্য অদীক্ষিতের নিকট সংবৃত রাখলেও দীক্ষিতের নিকট বিবৃতই করেছেন।এর মধ‍্যে কোথাও বা চিত্রকল্প,সৌন্দর্যানুভূতি, কোথাও বা লোকজীবনের প্রতিচ্ছায়া ধরা পড়েছে। একটি চিত্র দেখা যাক– যখন চারদিক ঘিরে হাঁক পড়ে, মাংসলোলুপ শিকারীর দল হরিণকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়, মৃগের নিজের মাংসই যে তার শত্রু!! তখন আর্ত হরিণ আশ্রয় খুঁজে পায়না।-“হরিণা হরিণর নিলঅ ন জানী”- তবু হরিণী হরিণকে পথ দেখিয়ে দেয়।হরিণ মৃত‍্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়ে ছুটে বনান্তরে চলে যায়। এর মধ‍্যে হরিণীর যে প্রেমিকা সত্তার চিত্রটি ফুটে উঠেছে তার মানবিক মূল‍্য অনস্বীকার্য। আবার একটি ছবি বা মুভি দ্রুতধাবম যদি দেখি? দ্রুত ধাবমান মৃগের আত্মরক্ষার জন‍্য উদ্দাম পলায়নের চিত্রটি সহজেই নান্দনিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

কাহ্নপাদ ডোম্বীকে বিবাহ করার জন‍্য পটহ, মাদল বাজিয়ে যাত্রা করলেন।বিবাহ অন্তে যৌতুক লাভ করলেন,-
-“অমুত্তর ধন্ন”-। সারারাত কেটে গেল -” অপহঁরহেঁ”- এর নিহিতার্থ যাই হোক না কেন, এর মধ‍্যে দিয়ে প্রেমের উল্লাসই উপলব্ধি হয়।পদ (১৯)।

চর্যাগীতিকার সবশেষ পদটি নরনারীর তীব্র আশক্তিপূর্ণ জীবনলীলা স্বল্পতম পরিবেশে চমৎকার ফুটেছে। যেমন— শবরের বাড়ির চতুর্দিকে কাপাস ফুল ফুটেছে,রাত্রির আকাশ বেয়ে জ‍্যোৎস্না নেমেছে,কাঁকনিদানা পেকেছে।শবরী ও শবর কাঁকনিদানা থেকে প্রস্তুত আসব পানে মত্ত হয়ে উঠেছে। -“কভু না পাকেলারে শবরা শবরী মাতেলা,অনুদিন শবরো কিম্পি ন চেবই মহাসুঁহে ভোলা।”- একটি গৃহবধু টিলার ওপর বাস করে,পাড়াপড়সি নেই,নিরন্ন সংসার,তবুও অতিথি এসে ভীড় করে।ভেকের সংসারের মতো বহু অপত‍্যবিশিষ্ট দুঃখের জীবন।পদ(৩৩) এর ৩/৪ পর্ব গুলি তত্ত্বানুসন্ধিৎসুর নিকট গভীর অর্থবহ সন্দেহ নেই। কিন্তু দারিদ্রক্লিষ্ট গৃহিনীর জীবনটি স্বল্পতম রেখার সাহায্যে যেন ছোটগল্পের উপাদানে পরিণত হয়েছে।পদ (১০) এও তত্ত্বরসের অতিরিক্ত একটি আখ‍্যানের ইঙ্গিত আছে।কোথাও কোথাও পদকর্তা দুইচারিটি রেখার সাহায‍্যে অতি সহজেই পূর্ণতর চিত্রাঙ্কনে সক্ষম হয়েছেন। শুঁড়িনী চিকন বাকলে মদ বেঁধে রাখে।দুয়ারে সাংকেতিক চিহ্ন দেখে মদ‍্যপায়ীর দল হাজির হয়। সারি সারি চৌষট্টি সরায় সুরা ভরা আছে।তারা মদ গিলতে শুরু করলে আর উঠতেই চায়না।ছোট ছোট ঘড়ায় সরু নল দিয়ে মনের সাধে মদ গিলেই চলে। পদ(৩)। লক্ষ‍্যণীয় যে,কত সহজে স্বল্পতম বর্ণনায় শুঁড়িবাড়ী ও মদ‍্যপায়ীদের পূর্ণাঙ্গ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
শুধু চিত্রধর্মই নয়,গোটাকয় প্রহেলিকাজাতীয় চর্যার রচনাকৌশলও প্রশংসনীয়। কাছিম জাহিয়া পাত্রে ধরছে না।গাছের তেঁতুল কুমিরে খেয়ে ফেলে।উঠানকেই ঘরের মতো ব‍্যবহার করে।পদ(২)।কিংবা শাশুড়ি,ননদ,শালীকে মোর নাকে আনাত( অনাথ) করে কাহ্নপাদ কাপালিক হলেন।পদ(১২)। -“বলদ বিয়ালো,গাই বন্ধ‍্যা থাকলো।”- -“তিন সন্ধ‍্যা পাত্র ভরে ভালোই দোয়া হয়।”- -“যে বুদ্ধিমান সেই বুদ্ধিহীন”-। -“যে চোর সেই সাধু।”- -“রোজই শেয়ালে সিংহের সঙ্গে শোয়।”- এই রহস‍্য সংকেত করে চর্যার ঢেন্ঢনপাদ বলেছেন -“ঢেন্ঢনপাদর গীতি বিরলে বুঝঅ।”- চর্যা(৩৩)।অর্থাৎ তাঁর গান কম লোকেই বোঝে।
এই কারণেই চর্যাপদের ভাষাকে সন্ধ‍্যাভাষা বা সান্ধ‍্যভাষা বলা হয়।সন্ধ‍্যাবেলায় দিনের আলো নিবে গেলেও আঁধার পুরোপুরি নামে না। আলো আঁধারে একটা রহস‍্যময় অদ্ভূত সংমিশ্রণ ঘটে।চর্যাগীতি তেমনই এক রহস‍্যঘন দুর্বোধ‍্য ভাষা। যে ভাষাকে বুঝতে সম‍্যক ধ‍্যানের প্রয়োজন হয়। যদিও চর্যাকার গণ সম্পূর্ণ ধর্মীয় চেতনাবশে এগুলি রচনা করলেও তাঁদের মধ‍্যে রীতিমতো কবিত্বশক্তি ছিল।প্রতীকরূপের সাহায্যে চিত্রসৃষ্টি,আখ‍্যানের ইঙ্গিত, মানবচরিত্রের মধ‍্যে,সুখ-দুঃখ, বিরহমিলনের দৈনন্দিন জীবনচিত্রগুলি চর্যার দর্শন ও তত্বের নিষ্প্রাণতাকে কাব‍্যরসের স্পর্শে সজীবতা দান করেছে।অতএব প্রাচীনতম বাংলা সাহিত‍্যে নিদর্শন হিসেবে চর্যাগীতির মূল‍্য অসামান্য।

(এই প্রবন্ধ লেখার জন‍্য আমি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের সম্পাদিত বৌদ্ধগান ও দোহা এবং চর্যাচর্যবিনিশ্চয় গ্রন্থে উল্লেখিত কিছু তথ‍্য এবং ডঃ শহীদুল্লাহ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন,পণ্ডিতগনের লেখা,ও ভাষাতত্বের ইতিহাসের ওপর বিভিন্ন বই থেকে তথ‍্যঋণ গ্রহণ করেছি। তাঁদের আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *