ডিপ্রেশন কলমে / শম্পা দেবনাথ
ডিপ্রেশন
কলমে / শম্পা দেবনাথ
মনখারাপ ‘ যার একটা পোষাকী নাম ‘ ডিপ্রেশন ‘।
ডিপ্রেশন, ফ্রাস্টেশন সবই এক মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।
কেন হয়, কাদের হয়, কখন হয়, কিভাবে হয়?
এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তর দেবে ডাক্তার, বিদ্বজনেরা।
আমরা একটু নিজেদের মত ভাবি বরং, আসুন।
পুরো আলোচনা কম পরিসরে সম্ভব নয়, কিছুটা নিয়ে হোক।
আমরা কি চাই ? অনেকে বলেন, চাহিদা কমলে জোগানের তারতম্য ঘটে। তাহলে কি অতিরিক্ত চাহিদাই কি ডিপ্রেশনের কারণ। মানে যা চাইছি , পাচ্ছি না, সুতরাং ভীষণ মনখারাপ। উদ্বিগ্নতা , বিরক্তি, হতাশা, বিষন্নতা মনখারাপের প্রাথমিক কারণ।
ধরলাম, একজন মানুষের তার সাধ্যারিক্ত চাহিদা, কিন্তু জোগান কম। সুতরাং ফল কম। এবং ডিপ্রেশন। একটু মাথা তুলে পরের লক্ষ্যে যেই না সে পা ফেলল, আবারো মনমতো রেজাল্ট নেই। এভাবে পরপর হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে সে পৌঁছে গেল ডিপ্রেশনে। তারপর ?
তারপর, মনে অশান্তি, ঘরে অশান্তি এবং চারিদিকে মতানৈক্য, মনানৈক্য। অবসাদে ডুবে যাওয়া।
একটু বুদ্ধিমান মানুষ বা তার পরিবার সে সময় ডাক্তারের পরামর্শ নেয়। কিন্তু কিছু আরো বেশী বুদ্ধিমান মানুষ জ্যোতিষী, বাবা, গুরুদেব, মন্দির, মসজিদ, গির্জা ইত্যাদিতে টাকা লাগিয়ে দেন। ওনারাও তো বসে আছেন রোজগারের আশায়। এটাই স্বাভাবিক। তাঁদেরও তো চলতে হবে। ফলস্বরূপ, আরো ডিপ্রেশন। এরা কিন্তু আমাদের চারপাশেই আছেন।
এবার আসি, তেমন কিছু মানুষের কথায়।
তাদের তেমন কিছু চাহিদা নেই। তাঁরা চান, একটু সুখ-শান্তির জীবন। পরিবার নিয়ে একটু সিকিউরিটি, একটু ভবিষ্যৎ এর জন্য অর্থ জমানো। পুজো, কুসংস্কার, শিক্ষা, বাস্তবতা সব নিয়েই এদের পাঁচমিশালী জীবন। খুব বড় স্বপ্ন এরা দেখতে চান না,তা নয়, কিন্তু দেখতে ভয় পান। তাই তারা ছোট ছোট খুশীতেই আটকে থাকেন। কিন্তু তাঁদেরও ডিপ্রেশন হয়। আসছি আমার মতন করে ব্যাখ্যায়।
আজকাল, নিউজ সে যে মাধ্যমেই হোক, দেখা যাচ্ছে, ডিপ্রেশন কথাটা সবার জানা। ছোট ছোট বাচ্চারাও বলতে শিখে গেছে, ” আমার মন ভালো নেই, ডিপ্রেশন হয়েছে।
আমাদের ছোটবেলায় শুনেছেন ? আজকাল ওয়েদারেরও নাকি ডিপ্রেশন হয় । বৃষ্টি নামে।
শুনেছেন আগে ?
সময় পাল্টাচ্ছে মশাই। শব্দ পাল্টাচ্ছে। জীবন পাল্টাচ্ছে। তার সঙ্গে পাল্টাচ্ছে অনুভূতি, মানে, ইচ্ছে।
ডিপ্রেশনের আর দোষ কি?
মনখারাপের কারণ অবশ্যই থাকে। অনেকেই বলেন, ” আমার কোনো চাহিদা নেই, কিন্তু মন খারাপ।”
তাহলে বলব, অবশ্যই কারণ আছে। কার্য ঘটলে, তার কারণ অবশ্যই থাকবে।
কেউই নিজের মনের কথা শোনে না, বোঝে না। যদি একটু গভীর ভাবে চিন্তা করত বুঝতে পারত এই মনখারাপের কারণ কি । মনের অন্তঃস্থলেই আছে মনখারাপের বীজ।
কিন্তু মনখারাপ আর ডিপ্রেশন কি এক? কোনও কারণে অনেকেরই দু’চার দিন মনখারাপ থাকতে পারে। তবে যদি দেখেন যে, সেই মনখারাপ থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না, ক্রমশ তা গ্রাস করছে আপনার অস্তিত্বকে, তখনই কিন্তু সচেতন হতে হবে। মাথা থেকে কিছুতেই বের করতে পারছেন না। এমনকি কোনও কারণ ছাড়াই কান্নাও পাবে। সব সময় অখুশি থাকাও কিন্তু ডিপ্রেশনের একটা কারণ হিসেবেই ধরা হয় | আবার সবসময় খুশী থাকাও ডিপ্রেশনের কারণ হতে পারে। ঐ যে, ‘ সব পেলে নষ্ট জীবন ‘।
আমাদের এখনকার ডিজিটাল জীবন অনেক জটিলতায় আক্রান্ত। কিছু পেয়েছি তেমন, হারিয়েছিও অনেক। একা হয়ে যাচ্ছি। নানা কারণে, অকারণে মনখারাপ বা ডিপ্রেশন হতে পারে। উপায় নিজেদের হাতেই। বাচ্চারাও এর থেকে মুক্তি পাবে না। কিন্তু এদের উদ্ধার করতে হবে পরিবারকেই।
লক্ষ্ণণ – অতিরিক্ত খাওয়া, খুব কম খাওয়া, বেশী কথা বলা, কথা না বলা, শরীর নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত যত্ন, একেবারেই যত্ন না নেওয়া, সবসময় অসুস্থ বোধ করা , অম্বলের সমস্যা, মাথা ব্যাথা, পেটের সমস্যা, গা ব্যাথা , ভুলে যাওয়া , প্রয়োজন ছাড়া ঝুঁকি নেওয়া, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, আত্মবিশ্বাস একেবারেই না থাকা, অন্য মানুষকে ছোট ভাবা , নিজেকে তুচ্ছ ভাবা , দুঃখী ভাবা, অতিরিক্ত সুখী ভাবা, অতিরিক্ত হিংসা, নির্লিপ্ততা ইত্যাদি ইত্যাদি।
১. একটু ভাবুন, গভীর ভাবে। প্রতি সপ্তাহে না হোক মাঝেমধ্যে একদিন নিউক্লিয়ার বা জয়েন্ট যেই ফ্যামিলিই হোক , পিকনিক করুন। ঘরে বা ছাদে। এটা মাস্ট। আপনি কিছু করবেন না, বাচ্চাদের দায়িত্ব দিন। ওরা যাই করুক। মেনে নিন। অবশ্যই শালীনতা রেখে। সহ্য শক্তি বাড়ান। দেখবেন ম্যাজিক হবে।
২. মন খুলে কাউকে মনের কথা বলুন, যে শুনতে চায়। যেমন, ছেলেমেয়েদের বলুন, আপনার সমস্যার কথা। যে বয়সই হোক, একটু বুঝতে পারলেই হল। শেয়ার করুন। মুখে চামচ তুলে দিলেও বলুন। দেখবেন, ওরাও বুঝবে। বাচ্চারা বেশী বোঝে। ওদের মতামত নিন। পরবর্তী কালে দেখবেন ,ওরা যত ছোট থেকে সংসারের জ্ঞান পাবে, তত পরিণত হবে।
৩. নানা কাজে নিজেকে যুক্ত করুন। যেমন, রান্না, বাগান করা, সেলাই, আঁকা, বই পড়া, ফোনে কথা বলা, সিনেমা দেখা, কাউকে না পেলে একা বেরিয়ে পড়া। দরকার হলে, পরিবারের সবার সঙ্গে আলোচনা করুন। ঝগড়া হলে হোক। ধরুন, আপনার ইচ্ছা ছিল, নাচ, অভিনয়, গান ইত্যাদিতে কিছু করার। হয় নি। নতুন করে শুরু করুন। নিজেকে সাজান। লজ্জা! ধুর, দরকার হলে বলবেন না হলে বলবেন না। এফোর্টটা কিন্তু আপনার।
৪. পরিবারের সাপোর্ট খুব দরকার। এমন মানুষকে কেউ বকবেন না। গল্প করুন। একটু সময় দিন। পরিবারের থেকে বড় ডাক্তার কেউ হয় না। যে আপনাকে ব্যঙ্গ করে বা আপনার যার মত, কথাবার্তা ভালো লাগে না, তাকে এড়িয়ে চলুন। ভালো থাকবেন।
৫. নেগেটিভ না, পজিটিভ ভাবুন। জানি, অনেক সমস্যা আছে। যার পেটে ক্ষিদে সে হয়ত বলবেন আমাকে, ‘আপনার এই জ্ঞান ভরা পেটে ভালো লাগে।’ জানি, কিন্তু সেটা তো রাজনৈতিক পরিস্থিতি। এখানে আপনি আমি সবাই শিকার। কিন্তু যারা মোটামুটি ভালো থেকেও নেগেটিভিটি ছড়ান, তাদের বলি, আপনাদের থেকেও অনেকে অনেক অনেক খারাপ আছেন। তাদের কথা ভাবুন।
৬. যাদের মাথায় ছাদ, পেটে ভাত, তারা হতাশার কথা বলবেন না, বরং অন্যদের উৎসাহিত করুন। একটা গোটা জীবনে দুঃখ তো থাকবেই। তাই ছোট্ট ছোট্ট সুখগুলো উপভোগ করুন। জমিয়ে রাখুন।
৭. মনখারাপের রুগীরা জানেন না, তারা নিজেদের ঠকাচ্ছেন। হ্যাঁ, ঠকাচ্ছেন। তাঁরা পরিশ্রম করতে চান না। কেমন পরিশ্রম? ।
প্রকৃতির কাছে যান, শরীরের যত্ন নিন, সুখাদ্য খান। ভালোলাগাগুলো খুঁজে বের করুন।অনেকেই ভাবেন, সব করছি। আসলে তা নয়। একটু ভাবুন, বুঝবেন কোথায় ফাঁক থেকে গেছে।
৮. হরমোন চেঞ্জ একটা বড় বিষয়। সেটার চিকিৎসা করতে হবে।
৯. বাস্তববাদী হোন। আশা-প্রত্যাশার ব্যালেন্স করুন। আমি জানি, অনেকেই বলবেন, ‘ আমি যা সয়েছি , তোমার বড় বড় ডায়লগ এখানে খাটে না ‘। আমি কান ধরে বলছি, ” তাহলে তো আপনিই শিক্ষক। আপনিই তো শেখাবেন, ভেঙ্গে পড়তে নেই। উঠে দাঁড়ানোর নামই জীবন, আশা যা মৃত্যু পর্যন্ত চলে।”
১০. সন্তান হারানো মা-বাবার ডিপ্রেশনের কোনো উপায় বা মুক্তি দেবার মত ধৃষ্টতা আমি করব না। কিন্তু এমন অনেক বাবা মা আছেন, তারা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সন্তানের নামে কোনো লক্ষ্য ঠিক করতে, কোনো আধার তৈরী করতে, যেখানে তাঁরা আরো অনেক সন্তান সম মানুষ পাবেন।
পরিশেষে বলি, আমি এখানে আমার মত অতি সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে কথা বলতে এসেছি, যাদের মোটামুটি সব কিছুই কম বেশী আছে। কিন্তু তাঁরা বেশী মনখারাপ বা ডিপ্রেশনের শিকার।
প্লিজ, বেরিয়ে আসুন। হাল ছাড়বেন না,লড়ুন। নিজেকে ভালবাসুন। ভাবুন তো, আপনার ছোট বেলার খেলার কথা। কেমন মাঠে, পাড়ায়, স্কুলে, কলেজে সবার সঙ্গে কেমন সমান টক্বর দিতেন ? তাহলে এমন কি হল, যে এই খেলাতে হেরে যাবেন? আপনার মতন সাধারণ মানুষরাই ম্যাজিক করতে পারে। সবাইকে ভালো রাখার সাথে প্রথমে নিজেকে ভালো রাখুন। এটাই জরুরী। এক জীবনে সবাইকে খুশী করতে পারবেন না। আগে নিজেকে খুশী রাখুন। দেখবেন, সবাই ভালো আছে।
আর, ভালো তো থাকতেই হবে। এটার কোনো দ্বিমত হয় না।