ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (দ্বাদশ পর্ব) ✒️✒️সায়ন্তন ধর
ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (দ্বাদশ পর্ব)
সায়ন্তন ধর
দীর্ঘ তিন বছরের ভিডিওকল মিটিং এর পর আবার সশরীরে উপস্থিত থাকার ডাক এলো রিজিওনাল অফিস থেকে। এবারে পূর্বোত্তর সম্পর্ক ক্রান্তি এক্সপ্রেসে চেপে চলে এলাম ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। এই ট্রেনটি জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে দাঁড়ায় না বলে এনজেপি তে গিয়ে ধরতে হলো। লং জার্নির এই ট্রেন স্বভাবতই লেট। রাত দেড়টা নাগাদ ট্রেন ছাড়লো। সকাল হলো নিউ বঙ্গাইগাঁও স্টেশনে। তারপর নরনারায়ন সেতু দিয়ে ব্রহ্মপুত্রকে ক্রস করে দিপর বিলের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম গুয়াহাটি। সঙ্গী আমার কলিগদাদা। স্টেশন এখন একদম ঝাঁ চকচকে। সেখান থেকে উবেরে করে খানাপাড়াস্থিত রিজিওনাল সায়েন্স সেন্টারে। এখানে একটু শিলিগুড়ির কথা না বললে কার্যকারণ সম্পর্ক ঠিক থাকবে না, তাই বলছি। শিলিগুড়িতে পৌঁছে আমি সংগ্রহ করে নিলাম পায়েল দি, দীপায়ন দা ও আমাদের স্যারের সাথে সাথে আমারও লেখা বই “Herbarium Technique: Evolution From Conventional To Digitization” এর তিনটি হার্ড কপি। এদিকে তাড়াতাড়ি এনজেপি তে আসার ফলে কিছু সময়ের জন্য একটা হোটেল বুক করতে হলো। কোন একটা উৎসব চলছিল হোটেলের পিছনেই। ডেসিবেলের চোখ রাঙানিতে মথাটা সেই যে ভারী হয়ে গেলো তা ভোর রাতের ঘুমে একটু কমলেও পুরোপুরি ফ্রেশ হইনি। তাই ভাবলাম দুপুরটা একটু ঘুমিয়ে নেবো। কোথায় কি, অফিসের সেকেন্ড বস ফোন করলেন, তাঁকে সাথে করে নিয়ে এলাম আমার ঘরে। বললেন, “গল্প করতে এলাম”। বেশ ভালো লাগলো কারণ দূরে দূরে থাকার কারণে অফিসিয়াল কথা ছাড়া তেমন কথা হয় না কখনোই। আমার এবারের পরিকল্পনায় বরাক ভ্যালি থাকায় অসমীয়া মানচিত্র বইটি নিয়ে এসেছিলাম সাথে করে। সেটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, “আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায় স্যার?” তিনি শিবসাগর জিলা বের করে একটু যেন উদাস ভাবে স্বগতোক্তি করলেন… “শিবসাগর কত বড় জিলা ছিল, এখন ভেঙে গিয়ে চরাইদেউ, শিবসাগর, মাজুলী, যোরহাট ও গোলাঘাট জিলা হয়েছে।” তারপর বললেন, “এই শিবসাগরেই আমার বাড়ি।” আমি বললাম, “তাহলে আপনার বাড়ির কাছ দিয়ে দিখৌ নদী বয়ে গেছে?” তিনি বললেন, “না, দিচাং নদী, শিবসাগর জিলার দিচাং মুখ গ্রামে আমার বাড়ি। ঠিক যেখানে ব্রহ্মপুত্রের সাথে দিচাং নদী মিশেছে।” এভাবে অনেকক্ষণ গল্প চললো। সন্ধ্যা হয়ে গেলো। অফিসের বস এলেন। এসে বললেন যে দুর্গাপূজার সময়, তাই ভীষণ জ্যাম হচ্ছে, তাই যারা স্থানীয়রা যেন ফিরে যায়। যাঁর সাথে কথা হচ্ছিল, তাঁর সিম্পলিসিটি লেভেলের তারিফ করতে হয়। আমার রুমেই ওনার ব্যাগ রেখে চলে গেলেন বাড়ি। পরদিন মিটিং এর সময় তো আসবেনই। এদিকে এবারে এত বছর পর দেখা হলেও সকল কলিগ একসাথে মিলিত হতে পারলাম না। নাগাল্যান্ডের কলিগ বন্ধু শরীর খারাপ হেতু অনুপস্থিত। মিজোরাম ও ত্রিপুরার কলিগবন্ধুরা স্ব স্ব স্থানে মিলিত হবে। মণিপুরের প্রতিনিধি এবারে নেই। না নেই বললে ভুল হবে, মণিপুর ও মেঘালয়ের দায়িত্ব এবারে একজনের কাঁধেই। সে এসেছে। অসমের দরঙ্গ জিলার মঙ্গলদৈ থেকে আসা কলিগ বন্ধু আমার রুম পার্টনার। এই চারজনে মিলে ডিনার করে এলাম। খানাপাড়ার জয়নগর চারিয়ালির কাছে একটা সুদৃশ্য রেস্টুরেন্ট থেকে। এই চৌরাস্তা বা চৌপথী কে চারিয়ালি আর তেমাথার মোড়কে যে তিনিয়ালি বলে এটা কিন্তু ভীষণ মিষ্টি লাগে শুনতে। পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে যথারীতি চলে গেলাম ভেষজ উদ্যানে। আরোও একটু বেশি সুসজ্জিত লাগছে যেন। লাল রঙ্গন অভ্যর্থনা জানালো। মিঠে রোদে হাসি ছড়িয়ে দিলো কামরাঙা, কালমেঘ, নিশিন্দা, শেফালী, সর্পগন্ধা, গন্ধনকুলী, নয়নতারা, ভৃঙ্গরাজ, লুচিপাতা, চন্দ্রপ্রভা, হেলেঞ্চা, করবী, কলকে, কৃষ্ণচূড়া, মেহেন্দি, জবা, শিমুলকন্দ, লজ্জাবতী, কলমী, কোস্টাস, পিলিয়া, মুসান্ডা, অপরাজিতা, পান্থপাদপ, অ্যাজারেটাম ও বকফুলেরা। ফেরার পথে হলুদ, গোলাপী রঙ্গনেরাও দেখা দিলো। একটা পার্পল স্যাফায়ার প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে লাল রঙ্গনের ফুলে ফুলে। গেস্ট হাউজের সিড়ি দিয়ে উঠতে যাবো, দেখি বস উঠে পড়েছেন। আমাকে সুপ্রভাত জানিয়ে এক দিকে নির্দেশ করলেন। দেখি রেলিং বেয়ে নেমে এসেছে দুটি বানর। টালিবসানো মেঝেতে নেমে মনের সুখে খেয়ে চলেছে ছোলা। এক সস্প্যান জলও রাখা ওদের জন্য। সাবধানে ওদের কয়েকটি ছবি তুলে রাখলাম। এরপর ওই বইটির একটি কপি নিয়ে স্যারের কাছে দিয়ে এলাম। স্যার বললেন, “এটা আমি হেড কোয়ার্টারের লাইব্রেরিতে রাখবো। আমাদের স্টাফের লেখা বই, সেখানেই সবচেয়ে বেশি মর্যাদা পাবে।” এরপর ফ্রেশ হয়ে প্রাতঃরাশ সেরে কনফারেন্স হলে পৌঁছে গেলাম সাড়ে ন’টার মধ্যে। কথা ছিল দু’দিন মিটিং হবে। পর দিন ষষ্ঠী। তাই স্যার এক দিনেই প্রয়োজনীয় কথাবার্তা সেরে নিলেন। রাতে স্যারের তরফ থেকে ডিনার ছিলো। জয়নগর চারিয়ালির উল্টো ডিরেকশনে হাঁটছি। টাটার তাজ ভিভান্তা হোটেলের সামনের উড ফিনিশ্ড ফুট ওভার ব্রীজের নৈশ শোভায় মুগ্ধ হয়ে ছবি তুললাম বেশ কিছু। তবে মন যেন ভরলো না। পরে আরও ভালো করে দেখতে হবে এই ভেবে এগিয়ে চললাম। শুনলাম স্যার গাড়ি কিনেছেন। কিন্তু কেউ দেখেনি, কোন গাড়ি সেটা জানার ভার পড়লো আমার ওপর। আমি সরাসরি স্যারকে জিজ্ঞেস করে বসলাম। স্যার বললেন, নাম বলবো না, দেখতে পেলে দেখিয়ে দেবো। অপেক্ষা নিয়ে হাঁটছি। এরপর এলাম চাওলা’স স্কয়ারে। এলাহি আয়োজন। যা ওর্ডার দেওয়া হলো, তার সবটা টানতে পারলাম না, অগত্যা প্যাক করে নেওয়া হলো। এদিকে শেষ পাতে গোলাপ জামুন মন কাড়লো পরিবেশনের গুণে। ততোধিক সুন্দর তার টেস্ট। মুখে দিতেই গলে গেলো যেন। ফেরার পথে মারুতি সুজুকি গেলো, টয়োটা, হোন্ডা, হুন্ডাই, টাটা সব গেলো, স্যার আর দেখান না। তারপর হঠাৎ স্যার বললেন দিস ওয়ান। আমরা চার জনেই এমনভাবে ঘুরে তাকালাম যে গাড়ির মালিক সামনে থাকলে রীতিমতো অবাক হতেন। নিশানের ম্যাগনাইট গাড়িটি দেখতে ভীষণই সুন্দর। পরদিন ছুটি সকলেই বেরিয়ে গেল। আমি আর কলিগদাদা থাকলাম। ষষ্ঠীর দুপুরটাও বেশ মজাতেই কাটলো। সে গল্প শুনতে একটু অপেক্ষা তো করাই যায়।
(ক্রমশঃ)