মিরুজিন আলো —- চার

মিরুজিন আলো
চার

-আমাদের গাঁয়ে, বুঝলে জুহিদিদি রাত ঘনালে আলো আসে গন্ধ আসে..তুমি বলবে আঁধারে আবার কীসের আলো? কীসেরই বা গন্ধ! আঁধারের আলো আছে গো! আর গন্ধও আছে। চোখ বুজে দ্যাখো দিনি… কত আলো..
জুহি চোখ বন্ধ করে। হ্যাঁ আছে। একটা উৎসার আছে। একেবারে নিবিড় আঁধার নয় এটা।
-কী দেখলে? আমি ঠিক বলিনি? কিন্তু সবাই তো সেটা বোঝে না। তাই ভারি কষ্ট। যখন বোঝে না তখনই নিপাট আঁধার।
কথাগুলো বলে রায়কাকা চোখ বন্ধ করে নিল। বলে – এখনও চোখে ভাসে সেই নদী।
জুহি বলে – নাম কি নদীর?
-তিয়াসা। নদীর তীরে ঘর। বর্ষায় যখন নদী উপছে পড়ছে তখন কী তার রূপ গো। ভুলতেই পারি না যে।
-আমি যাবো একবার রায়কাকা। তোমাদের গাঁয়ে।
-সে হয় না রে। সে হয় না। ওখানে গেলে আর ফেরা যায় না।
-খুব যায়! ইচ্ছে হলেই যায়।
-না রে মামণি। হয় না। ওসব স্বপ্ন, সেই নদী, সেই আলো, সেই আঁধার.. ভয় পাই অন্ধকারকে। মানুষের মাঝে বড় অন্ধকার।
-রায়কাকা, যে ছবিগুলো তুমি আঁকো, সেগুলি ঠিক কী!
-জানি না জানি না। তবে এরা আছে এরা আছে।
-তুমি যখন ওসব আঁকো তখন আমার খুব ভয় করে রায়কাকা।
-সে তো করবেই। ওগুলো তো অন্ধকার।
-অন্ধকার ।
-হ্যাঁ গো মা। অন্ধকারের কত রূপ।
-হ্যাঁ গো রায়কাকা, আঁধার আর অন্ধকার বুঝি এক নয়?
-আঁধারের আলো আছে গো। অন্ধকারের নেই।
-তোমার সবকথা আমি আজও জানি না রায়কাকা। তাহলে যা লিখেছি তোমার কথা সব ভাসা ভাসা। তোমার সঙ্গে ওখানে ঠিক কী হয়েছে বলো না রায়কাকা।
-ভয় করে। আমাকে ওসব ভুলে থাকতে দাও। কোনও গাঁ গেরাম নেই গো কোথাও, সবটাই স্বপ্ন। আমার গাঁয়ে জন্মও হয় নি, বড়ও হই নি।
-তাহলে? তুমি যে শুধু গাঁয়ের কথা বলো।
-ফিরেছিলাম গাঁয়ে।
জুহি চুপ হয়ে যায়। কী ব্যাপার হতে পারে!
রায়কাকা হেসে বলে – ঠিক আছে বলবখন। তবে আজ নয়, আরেকদিন। যেদিন ঝুম মেরে বৃষ্টি পড়বে সেরকম এক দিনে।
-কেন?
-ওরকম দিনে বললে আমি ঠিকঠাক বলতে পারব।
এখন যদিও বর্ষাকাল, তবু খুব গরম।ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুম মেরে বৃষ্টি কবে পড়বে! সমুদ্রে নিম্নচাপ তৈরি হলে হতে পারে। এছাড়া তো চান্স নেই ওরকম দিনের। শ্রাবণের শেষ। সেরকম বৃষ্টি হলোই না আর।
-তবে কিনা এরপর আমাকে আর খুঁজে পাবে না।
-মানে? কেন? সব খুলে বললে চলে যাবে কেন?
-মানে তোমরাই বলবে, চলে যাও।
-কেন?
-ভয় পেয়ে গেলে তো? তখন আরও ভয় পাবে।
কি বলছে রায়কাকা? লোকটা চোরডাকাত নাকি? রায়কাকা আছে তো অনেকদিন হল। মা নিশ্চয়ই কিছু জানতে চায় নি। কেন জানল না মা? তবে বেশ অনেকটা দিন গত হয়েছে। কোনও অঘটন ঘটেনি আজ অবদি। তবু কেমন একটা অস্বস্তি দলা পাকিয়ে ওঠে বুকের কাছে। চাপ চাপ লাগে। ভালো লাগাটাতে একটা দাগ পড়ে যায়। রায়কাকা যেন বুঝতে পারে। বলে – গাঁ গেরামের গল্প মাগো। খুব মার খেয়েছি রোজ। ছেলেপিলেগুলো রোজ মারত ।ইঁট পাথরের বৃষ্টি, খাবার জোগাড় করতে পারতাম না। ভিক্ষেও পেতাম না।
-কেন? তুমি কি কোন খারাপ কাজ করেছিলে?
-একটা পুরনো বাড়িতে পড়েছিলাম। ঐ পোড়োবাড়িতে সাপখোপ মেঠোইঁদুর মাকড়সা টিকটিকি, বিষাক্ত পোকামাকড় কী ছিল না! তারপর ধুঁকতে ধুঁকতে একদিন বেরিয়ে পড়লাম। ট্রেনে উঠলাম। ভিক্ষুক ভেবে কেউ কিছু বলল না। কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। স্টেশনে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম। ভিক্ষে চাইলাম। কেউ কেউ ভিক্ষে দিল। পেটে কিছু পড়ল। হাঁটতে হাঁটতে কোথা থেকে কোথায় চলে এলাম জানি না। বসে বসে ধুঁকছি। মনে হল কেউ কিছু বলল। তাকিয়ে দেখি মায়ের মুখ। মা আমাকে নিয়ে এল। এই বাড়ি, সেই ছোট্ট মেয়েটা, আজকের তুমি গো মামণি।
রায়কাকা উঠে চলে গেল। হঠাৎই চলে গেল। আরেকদিন সে রায়কাকাকে সেই রহস্যময় অতীত বলার জন্যে চাপ দিচ্ছিল। তখন মা এসে বারণ করেছিল। বলেছিল – চাপ দিও না ওকে। যদি বলার ইচ্ছে হয় তখন নিজে থেকেই বলবে।

-শোনো মামণি, আমার মা বহুলোকের সেবা করে আমাকে পেয়েছে। – আকন্ঠ চমকে জুহি তাকাল।
মা বলল – কিন্তু আমি তো ওসব জানতে চাইছি না জগবন্ধু।
-মা? মা এলে? বসো মা তুমি। মামণি অনেকদিন থেকে জানতে চাইছে। দেখলাম বলাটা এখন দরকার হয়ে পড়েছে।
জুহি চুপ করে থাকে। সে সত্যিই জানতে চায়। কী সে রহস্য? জুহি রায়কাকার বলে যাওয়া কথাগুলো লেখে। চকখড়ি দিয়ে আঁকা অদ্ভুত ছবিগুলো দেখে। সবটাই পারম্পর্যহীন। বিচ্ছিন্ন টুকরো টুকরো। কারণটা সে জানে না, অথচ সে জানতে চায়। জানার জন্যে মাঝেমাঝে অস্থির হয়ে উঠে। মা জানতে চায় না, সেটা মা-র ব্যাপার। মা আলাদা জীবনবৃত্তে থাকে। সাংসারিক একটা স্বস্তি সবসময় বজায় থাকুক এটা মা চায়। তবে এই মুহূর্তে জুহি রায়কাকার হাবভাব দেখে ভয় পেয়ে গেল। সে যেন এক অন্য মানুষ, সে এই ঘরে এই বর্তমানে আর নেই। চলে গেছে দূর অতীতে।

-আমাকে জন্ম দিয়েছে যে মা সে সতেরো বছর বয়সেই গাঁ থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। মা জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে যেত। ওখান থেকে কিছু লোক জোর করে তাকে তুলে নিয়ে যায় আর নষ্ট জায়গায় বিক্রি করে দেয়। এরপর মা নাকি কোনও দয়ালু লোকের সাহায্য নিয়ে ফিরে এসেছিল গাঁয়ে কিন্তু মায়ের বাবা মা তাকে আর ঠাঁই দেয়নি। আমি মায়ের সন্তান। বাবা কে জানি না। ছোটবেলা কেটেছে ওখানেই যেখানে বাবুরা রাতের বেলায় ফুর্তি করতে আসে। এরপর মা-র হয়ে গেল অসুখ। মা বাঁচল না, তখন আমার বয়েস কুড়ি। আমাকে মেয়ে ধরে এনে ঐ খাঁচায় ঢোকাবার কাজ দেওয়া হলো।
-মানে? তুমি মেয়ে ধরা দালালের কাজ করেছ?
-পেট বড় বালাই মামণি।

এতটুকু বলে রায়কাকা দাঁড়িয়ে পড়ল। একটা অস্থিরতায় সে পায়চারি করছে আর একা একা কীসব বিড়বিড় করছে।
জুহিকে জোর ধমক দিয়ে দেবাংশী বলে – তোমার এত বিচ্ছিরি কৌতূহল কেন? এই বুঝি তুমি রায়কাকাকে ভালবাসো?

(ক্রমশ)

1 thought on “মিরুজিন আলো —- চার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *