উপন্যাসিকা। সূর্য শিশির। পর্ব -৬ ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

উপন্যাসিকা।
সূর্য শিশির।
পর্ব -৬
ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
শাশুড়ি মহলে ফুসফুস গুজগুজ শুরু হয়ে গেছে। শতমন্যুর প্রৌঢ়া মা অত্যন্ত নিরীহ,একইসঙ্গে রুচিশীল মহিলা।বৌমাকে ভালোবাসেন যতো স্নেহ করেন তার থেকে বেশী। নদীয়া জেলার এই গ্রামে এখনো একটা চোখে পড়ার মতো পরম্পরা আছে। গ্রামটি পুরোপুরি মল্লিক বংশোদ্ভূত মানুষের বাসভূমি।গোটা সাতেক পুকুর আছে। এখনও এই একবিংশ শতাব্দীতেও পুকুরে যেদিন জাল পড়ে সাত শরিকের মধ্যে সেই মাছ ভাগাভাগি হয়। এখনও ক্ষেতের ফসলে এজমালি ব্যবস্থা।ফলে,সব তরফের মধ্যে একতা বজায় রাখার চেষ্টা বজায় আছে। সম্পন্ন গৃহস্থের সম্মানিত অস্তিত্বের গৌরব তাই সুপ্রতিষ্ঠিত রাখতে মল্লিক পরিবার যথেষ্ট সচেতন। পরিবারে বারো মাসে তেরো পার্বণ,দোল দুর্গোৎসব, উপলক্ষে শহর ও বিদেশ থেকে এসে উপস্থিত হয় পরিবারের সদস্যরা। শতমন্যু তার বান্ধবী গোপাকে এমনই এক অনুষ্ঠানে নিয়ে এসেছিল।মধুরা বলেছিলো-‘একা গোপাকে নিয়ে যাস না শতম। গ্রামের সমাজে কথা উঠতে পারে। আমি যাই তোদের সাথে। কথা উঠলে ম্যানেজ করে দেবো ‘- ছেলে বন্ধুও জুটে গেলো কয়েকজন।উৎপল, শুভ্র, কুমার। শতমন্যু বাড়ি গিয়ে বন্ধুদের সহপাঠী হিসেবেই পরিচয় দিলো। সঙ্কোচ বশতঃ গোপার বিশেষ পরিচয় দিলো না। ওদিকে মধুরা তার সরল অকপট ব্যবহারে মা, জেঠিমা, খুড়িমাদের মন জয় করতে সচেষ্ট থাকলো। এতো সুন্দর অভিজাত পরিবার, ধনী তো বটেই, শিক্ষিত বংশও। উঁচু উঁচু থামে ঘেরা এক একটা মহলতুল্য বাড়ি।শতমেরও নিশ্চয় আলাদা মহল আছে। গোপা হবে সেখানে একক রাণী! মাৎসর্যের বিষকাঁটা মধুরাকে রক্তাক্ত করে। এখানে মধুরা ছাড়া আর কাউকে মানাতেই পারে না।ছড়িয়ে ছিটিয়ে সাত শরিকের বংশ। মধুরা গিন্নিদের পেছন পেছন ঢুকে যায় রান্নাবাড়িতে। ছেলেমানুষের মতো আব্দার করে -‘ও বড়োমা,আমি কাঠের জ্বালে রান্না করবো।ও খুড়িমা,আমাকে বঁটিতে কুটনো কোটা শিখিয়ে দাও না গো। বঁটি পেতে কুটনো কুটতে বসে। কখনো খুন্তি দিয়ে কড়াইয়ে তরকারিটা নেড়ে দেয়। গয়লার পেছনে পেছনে গোয়ালঘরে গিয়ে দুধ দোয়ানো দেখে। কোমরে আঁচল জড়িয়ে দুধ এলাচগুঁড়ো ফুটিয়ে চা বানাতে শেখে জেঠিমার কাছে। গায়ে আঁচল জড়িয়ে দ্বিধাকম্পিত পায়ে বৈঠকখানায় গিয়ে জেঠু কাকুদের হাতে হাতে পৌঁছে দেয় চায়ের কাপ প্লেট। শতমন্যু যখন বন্ধুদের নিয়ে হৈ হৈ করে গ্রাম দেখাতে নিয়ে যায়,মধুরা তখন ঠাকুরদালানে বসে পুজোর জোগাড় গোছায়। পাটায় চন্দন ঘষে। পুষ্পপাত্রে ফুল, মালা, বেলপাতা, তুলসী নিপুণ হাতে সাজিয়ে রাখে। জেঠিমার দেয়া লালপেড়ে গরদ পড়ে ভাবি বধুর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তোলে। বাবা,জেঠু, কাকুরা মুগ্ধ! মা, জেঠিমা, কাকিমা, ঠাকুমারা আপ্লুত! পাল্টি ঘর বোসেদের মেয়ের বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব যায় মল্লিকবাড়ি থেকে। ভালোমানুষ শতমন্যু গোপার কথা উত্থাপন করার সুযোগ পায় না। এই ভাবেই মধুরা মল্লিকবাড়ির হেঁসেল ও ঠাকুরঘর থেকেই পৌঁছে যায় শতমন্যুর শোয়ার ঘরে; শতমন্যুকে ভালো না বেসেও। গোপা চোখের জল মুছে ফিরে যায়।
আজ মল্লিকবাড়ির মা জেঠিমা খুড়িমাদের মনে হয়,তাঁরা ভুল করেছিলেন। নিজেদের মধ্যে ফুসফুস গুজগুজ করেন, সেদিন মেয়েটার সরলতা আসলেই বেহায়াপনা ছিল! ছিঃ!