রম্য রচনা “বন রাজ্যে সরকারের কর্মকাণ্ড” ✍️ রাজা চক্রবর্তী

রম্য রচনা
“বন রাজ্যে সরকারের কর্মকাণ্ড”
✍️ রাজা চক্রবর্তী

এককালে বনের রাজা ছিলেন সিংহ। হ্যাঁ, সেই গর্জনদাতা, গর্বিত, গম্ভীর সিংহ। কিন্তু বয়স হলে তাঁর গলা আর গর্জে না, শুধু কাশে। তখনই মঞ্চে উঠল এক নতুন মুখ—নেই গর্জন, আছে গর্জনের অভিনয়। নাম তার: ম্যাডাম শিয়ালিনী।

শিয়ালিনী বললেন, “আমি বনের মা! আমি তোমাদের অগ্নিকন্যা! আমি বাঁধতে জানি, গাইতে জানি, কবিতা লিখতে পারি, এমনকি নাচতেও পারি, ডিলেট ফিলেট, পি এইচ ডি, সি এইচ ডি (চুরি বিদ্যা) সব করতে জানি! আমাকে ভোট দিলে এই জঙ্গলে উন্নয়ন হরিণের মতো দৌড়বে, ময়ূরের মতো নাচবে, আর কচ্ছপের মতো টিকে থাকবে!”

পাখিরা খুব খুশি। তারা ভাবল, উড়ন্ত উন্নয়ন আসছে। বানররা গাছ থেকে লাফিয়ে নামল—বল “আমরা তোদেরই দলে!”

শুরু হলো উন্নয়ন। প্রথমেই এক প্রকল্প: বনের প্রতিটি গাছকে রঙ করে সাজানো হবে। বলা হলো, এতে পর্যটন বাড়বে। পেঁচা জিজ্ঞেস করল, “রঙের টাকা এল কোথা থেকে?” শিয়ালিনীর মন্ত্রিসভা থেকে উত্তর এল, “পেঁচা বেশি জানলে রাতের ঘুম হারাম হবে, সাবধান!”

তারপর এল চড়ুই উন্নয়ন প্রকল্প—সব চড়ুইকে দেওয়া হবে বিনামূল্যে দানা, তবে ছবি তুলে রাখতে হবে। এক সাংবাদিক কাঠবিড়ালি চুপিচুপি ছবি তুলতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল। ব্যাস, তার বিরুদ্ধে মামলা: “বনদ্রোহিতা এবং বাঁদরভক্তি।”

তবু উন্নয়ন চলল। শিয়ালিনীর ভাগ্নে শশক দাদা পেল ৩৩টা গর্ত, যেখানে সে “গর্ত খনন শিক্ষা কেন্দ্র” খুলবে। কচ্ছপ পেল পাঁচটি পুকুর, যেখানে সে “তৈরি হও জলস্রোতের জন্য” নামে প্রশিক্ষণ দেবে।

কেউ কিছু বললেই, মদন গণ্ডার আর কেষ্ট কুকুর এসে বলে, “আমাদের নেত্রী সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি ফরমুলা ওয়ানে গেছেন, গলা দিয়ে চিৎকার করে বক্তৃতা দিয়েছেন, বনের ভাষায় ছন্দে ছন্দে কথা বলেন!”

একদিন হঠাৎ পাতাল থেকে ডাক এল। পাতালের প্রাণীরা বলল, “আপনারা তো খুব ব্যস্ত উন্নয়নে। আমাদের একটু জায়গা দিন, আমরা একটু ওপরে এসে থাকি।”
শিয়ালিনী বললেন, “স্বর্গে উন্নয়ন আর পাতালে শান্তি—দুটো একসাথে চলতে পারে না। নিচে থাকাই আপনাদের ভাগ্য।”

কিন্তু পাতালও আর চুপ করে থাকল না। তারা তৈরি করল পাতাল সরকার। কেঁচো, পিঁপড়ে, ভূগর্ভস্থ ব্যাঙ—সব একত্রে ফুঁসে উঠল। তারা বলল, “আমাদের উন্নয়ন চাই না, চাই একটু আলো!”

এদিকে বনের মুরগি, হাঁস, টিয়েরা বলল, “আমরা উন্নয়ন দেখতে পাচ্ছি না, কেবল পোস্টার আর প্রকল্পের নাম শুনছি। আমাদের পরবর্তী ছানারা কি করে খাবে তার জন্য ফলের গাছ তো লাগানো দরকার নাকি?

কেউ মুখ খুললেই, শিয়ালিনীর একমাত্র গান বাজে—
“আমি সর্বভুক, আমি সর্বগুণে গুণান্বিতা, আমি সব জানি—তোমরা চুপ থাকো!”

শেষ পর্যন্ত বনের এক প্রবীণ গণ্ডার বলল, “এই উন্নয়নটা বোধহয় একটা দুঃস্বপ্ন। ঘুম ভাঙলেই দেখব, আবার কোন শিক্ষিত ময়না পাখি হয়তো চিৎকার করছিল, তার মুখেটা সেলুটেপ মেরে দিয়েছে। আমরা এখনো গাছের তলায় বসে ভাবছি, গাছের উপরে যাওয়ার সাহস নেই আমাদের—‘আর কতদিন?’”

শেষে পাণ্ডববর্জিত বনরাজ্যে এখনো শিয়ালিনী গান গাইছে, আর বানরের দল হাততালি দিচ্ছে। পাখিরা ভাবছে পালাবে, কচ্ছপরা হাঁপাচ্ছে, আর পাতাল থেকে আসছে একটাই আওয়াজ উঠছে— “এবার একটু বদল!”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *