ক্লিপটোম্যানিয়া ***** মিতা ঘোষ

ক্লিপটোম্যানিয়া
মিতা ঘোষ
…………………………
আজ কুড়ি বছর পর আকাশ এসেছে গঙ্গার ঘাটে সূর্যাস্ত দেখতে। গঙ্গার শীতল হাওয়া তার পুরাতন ক্ষতের উপর জমে থাকা ধুলোর আস্তরণ গুলিকে ধীরে ধীরে উড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। তার বুকে জমে থাকা উপল আর্তনাদ সরীসৃপের মত বুকে হেঁটে বেরিয়ে আসতে চাইলো। চোখের উষ্ণ প্রস্রবণে চোখ দুটি জ্বালা করে উঠলো।
হঠাৎ তার কানে ভেসে এলো
–আঃ…..!! আঃ…..!! আমাকে তোরা মারিস না!! আমাকে তোরা মারিস না তারপর উচ্চস্বরে নারী কন্ঠে কান্নার আওয়াজ।
আকাশ দৌড়ে গিয়ে দেখল এক মহিলাকে যে যেমন পারছে তেমনিভাবে কিল -ঘুষি, লাথি- চড় মেরে যাচ্ছে। সে চিৎকার করে বলল,
— থামুন!!থামুন!!
–কি করছেন কি!?
–একজন মহিলাকে এইভাবে মারছেন??
–পুরুষ মানুষ হয়ে মহিলাদের গায়ে হাত দিচ্ছেন??
— আপনাদের লজ্জা করে না???
মার বন্ধ করতেই আকাশ বলল —
” আমরা বড় অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ। যদি দেখি কেউ কাউকে মারছে, কেন মারছে?? তার কারণ জিজ্ঞাসা না করেই সুযোগ বুঝে ফলাও করে নিজের ক্ষমতাটাও জাহির করি।
আসলে আমরা প্রত্যেকেই দুর্বলের উপর আঘাত হানতে ভালোবাসি। কখনো ভাবি না এই আঘাতটাই প্রত্যাঘাত হয়ে আমাদের জীবনেও ফিরে আসতে পারে। ”
ভিড়ের মধ্য থেকে একটা কম বয়সী ছেলে বলে উঠলো
— কে আপনি দাদা??
বিনা পয়সায় জ্ঞান দিচ্ছেন?? নিজের জ্ঞান নিজের কাছে রাখুন, ভবিষ্যতে কাজে দেবে বলে বিকৃতভাবে হাসতে লাগলো ।
আরো কয়েকজন বলল
–জান, জান, পাতলা হন তো।
ধর্মরাজ পুত্র যুধিষ্ঠির এলেন রে ।
— আপনি জানেন ও কে??
ও একটা চোর। পাগলী সেজে চুরি করে ।
এমন সময় পাগলীটি দৌড়ে এসে আকাশকে জড়িয়ে ধরলো। জড়িয়ে ধরতেই আকাশের হৃদয়ের অন্তস্থলে এক শিহরণ জেগে উঠলো। এ এক অন্যরকম শিহরণ।এক অতি পরিচিত অনুভূতি। যা ভুলতে চাইলেও ভোলা যায় না।।
আকাশ–শুনছেন?
–ওরা চলে গেছে। এবার আপনি আমাকে ছাড়ুন।
— না…., না…… ওরা আমাকে মারবে।
— শুনুন,আর কেউ আপনাকে মারবে না।
আকাশ ধীরে ধীরে গলার থেকে ওনার হাত দুটো ছাড়িয়ে, সামনে আনতেই বিদ্যুতের মত চমকে উঠলো।
নিজের অজান্তেই অস্ফূট স্বরে বলে উঠলো চাঁ……..দ।
তারপর ধীরে ধীরে কম্পিত হাতে মুখের থেকে বাকি অবিন্যস্ত চুলগুলি সরিয়ে চোখের দিকে তাকাতেই আকাশ ওর মায়াবী চোখের নীল যমুনায় ডুবে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ভিক্টোরিয়ায় শেষ দেখার দিনটি—
আকাশদা দাঁড়াও — দাঁড়াও— আমি আর দৌড়াতে পারছি না। তারপর দুজনে হাঁপাতে হাঁপাতে সবুজে সবুজ নরম মোলায়েম ঘাসের উপর, একটি বড় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। আকাশের চাকরির খবর শুনে আনন্দে চাঁদ হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলল। তার দু গাল বেয়ে অঝরে নামতে লাগলো আনন্দাশ্রু ধারা। আকাশ দুহাত পেতে সেই অমূল্য মুক্ত সম অশ্রু বিন্দু সংগ্রহ করতে লাগলো।তাদের এই অবর্ণনীয় আনন্দের মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইল ওই কৃষ্ণচূড়া গাছটি । তার ঠান্ডা শীতল ছায়ায় , বসন্তের সুমধুর কোকিলের গান শুনতে শুনতে শুরু হলো তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখা…….
ভাবতেই, অব্যক্ত হৃদয়বিদারক যন্ত্রণায় উপছে পড়তে থাকে আকাশের অশ্রু সমুদ্র।
পাগলীটা বলে উঠলো
— এই তুই কাঁদছিস কেন রে??
–আমাকে মারবি না??
সম্বিত ফিরতেই আকাশ বলল
–না, আর কেউ কোনদিনও তোমাকে মারবে না।
— ও শিশুর মত হাসতে হাসতে হাততালি দিয়ে বলল
— কি মজা….! কি মজা…..! আমাকে আর কেউ মারবে না। আর কেউ মারবে না….।
তারপরেই কাঁদতে কাঁদতে বলল
— আমার না খুব খিদে পেয়েছে।
–কিছু খেতে দিবি?
আকাশ অতি যত্নে ওকে গাড়ি করে বাড়ি নিয়ে এলো।
কলিং বেল বাঁচতেই
দুর্গা মাসি দরজা খুলে বলল
–এই পাগলীটাকে কোত্থেকে ধরে আনলে দাদা বাবু??
–একেবারে ঘরে নিয়ে এলে ??
— ছ্যাঃ ছ্যাঃ কী নোংরা…..।
— কী গন্ধ গায়ে ……..বাবারে বাবা!!
বলে নাকে কাপড় চাপা দিলো।
আকাশ এতক্ষন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। দুর্গা মাসি বলতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখল সত্যি– ছেঁড়া ময়লা জামা কাপড় পরা, সারা গায়ে নোংরায় কালো কালো ছোপ পড়ে গেছে। বড় বড় নখ, জট পাকানো উস্কো খুসকো চুল, বহুদিন ব্রাশ না করায় দাঁতগুলি লাল, গায়ে অজস্র আঘাতের চিহ্ন। দেখেই আকাশের চোখ ফেটে জল এলো।
— আমার খিদে পেয়েছে……….
— খেতে দে।
— মাসি ওকে স্নান করিয়ে নিয়ে এসো।
— আ –আ—মি!!
— হ্যাঁ তুমি। তুমি ছাড়া কে করাবে বল??
— আমার হয়েছে যত জ্বালা….।
আকাশ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়ের আলমারি থেকে শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ বের করে দুর্গা মাসির হাতে দিল।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুর্গা মাসি পাগলীটাকে টানতে টানতে বাথরুমে নিয়ে গেল। কিছুতেই স্নান করবে না। জোরজবস্তি সাবান শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করিয়ে দিলো ।
স্নানের পর ওর সামনে খাবার নিতেই গোগ্রাসে খেতে শুরু করল। একবার এ বাটি থেকে এক মুঠো তুলছে আবার অন্য বাটি থেকে একমুঠো। ওর খাওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে কত দিন পেট ভরে খেতে পায়নি। খাওয়ার পর আকাশ ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিলো।
পরের দিন সকালে আকাশ ওদের ফ্যামিলি ডাক্তার সুশোভন আঙ্কেল কে কল করে আনলো।
তিনি চাঁদকে দেখে প্রেসক্রাইড করে আকাশকে বললেন
— বাবা ওষুধগুলি আজ থেকেই খাওয়াতে শুরু করো। আমি দুদিন পর আবার ওকে দেখে যাব।
এ দুদিন আকাশ সকালে চাঁদকে খাইয়ে বেরিয়ে যেত আর আসতো অনেক রাত্রে। যাবার সময় দূর্গা মাসিকে বলতো
— মাসি তুমি ওর খেয়াল রেখো। ওর যেন যত্নের কোন ত্রুটি না হয়।
সারাদিন ঠিকমতো খাওয়া না, স্নান না, ঘুম না। দুর্গা মাসি রাগের চোটে, গজ গজ করতে করতে বলে
— এই পাগলীটার জন্য আমার ছেলেটা অসুস্থ না হয়ে পড়ে।
দুদিন পর ডাক্তার বাবু এসে চন্দ্রিমাকে চেকাপ করে আকাশকে বললেন
— কন্ডিশন খুব একটা ভালো নয় বাবা!!
এ কথা শুনে আকাশ ধরা গলায় বলল
— আঙ্কেল ও কথা বলবেন না। ওকে সুস্থ করে তুলতেই হবে। তা না হলে আমি বাঁচতে পারব না।
পয়তাল্লিশ বছর পর্যন্ত অকৃতদার থেকে আকাশের মত চরিত্রবান,ভদ্র ছেলের মুখে এই কথা শুনে, পিতৃসম ডাক্তার আঙ্কেল এবং মাতৃসম দুর্গা মাসি একইসঙ্গে বলে উঠলো
— মানে!!!
— এ কে!!!!!
— চন্দ্রিমা ব্যানার্জি।
— তোমার বান্ধবী চন্দ্রিমা!!??
— হ্যাঁ আঙ্কেল।
— যার জন্য আমি এত বছর অকৃতদার।
ঘরের পরিবেশটা থমথমে হয়ে উঠলো। আকাশ জানলা দিয়ে তারাদের নকশি কাঁথার দিকে তাকিয়ে টুকরো টুকরো মেঘের সঙ্গে ভেসে গেল অতীতে………
তার মনে পড়লো সেই কলেজ পালিয়ে বৈশাখের কাঠফাটা রোদ্দুরে দুজনের দক্ষিণেশ্বর যাওয়ার কথা……… দক্ষিণেশ্বরে পূজো দেওয়ার পর নৌকায় করে বেলুড়ে যাওয়া। দুজনের সেদিন কী আনন্দ!! নৌকায় বসে হাতে হাত কাঁধে কাঁধ রেখে গঙ্গার ফুরফুরে হাওয়া খেতে খেতে দুজনে ……….
হঠাৎ ডাক্তার আঙ্কেলের ডাকে তার স্মৃতি মন্থনে ছেদ পড়লো।
আকাশ বলল তবে শুনুন —
এক বিয়ে বাড়িতে গিয়ে চন্দ্রিমার সঙ্গে আমার আলাপ হয়। ধীরে ধীরে দুজনের মধ্যে এক গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
আমরা দুজনেই সূর্যাস্ত দেখতে খুব ভালবাসতাম। তাই মাঝে মাঝেই সন্ধ্যার সময় দুজনে পাশাপাশি বসে সূর্যাস্ত দেখতাম। পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্তমিত প্রায়, তার রক্তিম আভা বায়ু তাড়িত জলরাশির উপরে পড়ে শত সহস্র অস্তমিত সূর্য খন্ড- বিখণ্ডিত হয়ে রক্তাভ চাদরের ন্যায় আস্তরণের মনোরম দৃশ্যের সৃষ্টি করত। সেই অপরূপ দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে দুজনে হারিয়ে যেতাম স্বপ্নালোকে……..।
আমরা দুজন একে অপরকে ছেড়ে বাঁচার কথা ভাবতেই পারতাম না।
চন্দ্রিমা আমাদের বাড়িতে অনেকবার এসেছে। মা-বাবা ওকে ভীষণ ভালবাসতেন। ওকে ভালো না বেসে থাকাই যায় না। যেমন সুন্দরী তেমনি নম্র, ভদ্র বিনয়ী এবং মেধাবী ছিল।
আমি চাকরি পাওয়ার পর পরই বাবা মা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে চন্দ্রিমাদের বাড়িতে গেল । চন্দ্রিমার বাবা ছিলেন গোড়া ব্রাহ্মণ। তিনি আমার বাবা-মাকে বললেন
— আমার মেয়েকে আমি কেটে জলে ভাসিয়ে দেব তবু অন্য কাস্টে মেয়ের বিয়ে দেব না।
চন্দ্রিমার মা, আমার বাবা-মা ওনাকে অনেক বোঝালেন কিন্তু কিছুতেই তিনি রাজি হলেন না।
তিন দিনের মধ্যে এক দোযবেরে লোকের সঙ্গে জোর করে চন্দ্রিমা কে বিয়ে দিয়ে দিলেন। তিনি চাঁদের থেকে প্রায় কুড়ি বছরের বড়। তার আট ও দশ বছরের দুটি ছেলে আছে।
–সত্যি সত্যি চাঁদের বাবা চাঁদকে জলে ভাসিয়ে দিলেন।
আঙ্কেল আপনি তো জানেন,আমি এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে বাবা মাকে নিয়ে বিদেশে চলে গেলাম। চন্দ্রিমা যাতে ভালোভাবে সংসার করতে পারে তাই আমি সব বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম।
— এখন মনে হচ্ছে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করাটাই ছিল আমার জীবনের সবথেকে বড় ভুল ডিসিশান।
বলতে বলতে আকাশের দুগাল বেয়ে টপটপ করে ঝরতে লাগলো অবারিত বেদানাশ্রু ধারা।
বহু বছর পর দেশে ফিরতেই চাঁদের কথা ভীষণভাবে মনে পড়তে লাগলো। তাই গিয়েছিলাম গঙ্গার ঘাটে।
— দেখুন,ঈশ্বরের কি খেলা……………..!!
— চাঁদকে আমার বুকে ফিরিয়ে দিলেন ঠিকই কিন্তু এ কোন চাঁদ………..???
–আমি তো ওকে এইভাবে পেতে চাইনি কখনো ??
এই দুদিন উদভ্রান্তের মতো ওর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধবের কাছে ঘুরে ঘুরে ওর সমন্ধে যা জানতে পারলাম………..সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা শুনলে আপনারাও চোখের জল আটকাতে পারবেন না।
ফুলশয্যার রাতে চাঁদের স্বামী ঘরে ঢুকে ওকে বলল–
তুমি আমার থেকে কিছু আশা করোনা। আমি কেবলমাত্র আমার সন্তানদের জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি। তারপর ছেলে দুটিকে ওর কাছে দিয়ে উনি অন্য ঘরে শুতে গেলেন। সেদিন থেকেই শুরু হল ওর সংসার জীবনের সংগ্রাম।
না পেল স্বামী সুখ না পেল সন্তান সুখ। দাসী বিত্তি করেই ওর জীবন কাটছিল। বলতে পারেন বলির পাঠা হিসেবে নিজের জীবনটাকে উৎসর্গ করে দিয়েছিল সংসারের জন্য।
চাঁদ বাবার উপর অভিমানে বেদনায় একদিনের জন্যও বাপের বাড়ি আসেনি। ওর মাও এটা মেনে নিতে পারেননি তাই কিছুদিনের মধ্যেই তিনি মারা যান। ওর জীবন আরও দুঃসহনীয় হয়ে ওঠে।
চাঁদ আপ্রাণ চেষ্টা করে ছেলেদের বড় করে তুলল ঠিকই কিন্তু প্রকৃত মানুষ করতে পারলো না। তাকে ভালোবাসার মূল্য দেওয়া তো দূরের কথা, সব সময় অপমানজনক কথাবার্তা বলত, অসম্মান করতো। তারা চাঁদকে সৎ মায়ের মতই দেখতো।
গত পাঁচ বছর আগের কথা —
চাঁদ স্বামীকে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ কিনতে যায়। তারপর হঠাৎই পাশের দোকান থেকে ছোট্ট বাচ্চাদের একজোড়া মোজা ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নেয়। অনাভ্যস্ত কারণবশত সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে যায়। দোকানদার চোর চোর বলতেই সবাই আগে পিছে কিছু না জেনে বেধরক পিটিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে রাখে । ওর স্বামী ওই মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে ওকে মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখে নিরবে বাড়ি চলে যান।
খবর পেয়ে চাঁদের ছেলেরাও ওকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে আসেনি। বরং ওর জ্ঞান ফেরার পর, অতি কষ্টে বাড়ি আসলে ওকে বলে
— কোন চোরের এ বাড়িতে জায়গা হবে না। তারপর দূর দূর করে দরজা থেকে তাড়িয়ে দেয়।
এইভাবে চাঁদ হারিয়ে যায় ঘন তমশাচ্ছন্ন মেঘের আড়ালে। গ্রাস করে রাহু………
নতুন নামকরণ হয় চোর,পাগলী…….
পেটে ভাত জুটুক বা না জুটুক মারধোর কপালে রোজই জুটতে থাকে। শেষ কথাটা বলতে গিয়ে আকাশের দম বন্ধ হয়ে এলো, গলাটা কাঁপতে লাগলো।
সে উঠে গিয়ে খোলা ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে উদাস চোখে বাইরে তাকাতেই দেখে–
আকাশটা ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে । অন্ধকারাচ্ছন্ন গুমট পরিবেশ। মনে হয় এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে।
ডাক্তার আঙ্কেল চশমা খুলে চোখ মুছলেন। আর দুর্গা মাসি আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে দৌড়ে চাঁদের ঘরে ঢুকলেন। তারপর মাতৃ স্নেহে চাঁদের কপালে একটার পর একটা চুম্বন করতে লাগলেন।
সব কিছু শোনার পর ডাক্তার বাবু বললেন
–আমার মনে হয় চন্দ্রিমা ক্লিপটোম্যানিয়ায় ভুগছে।
আকাশ বলল
— ক্লিপটো ম্যানিয়া কি??
ক্লিপটোম্যানিয়া হল
— বারবার চুরির একটি অনিয়ন্ত্রণ যোগ্য ইচ্ছা। এটাও এক ধরনের মানসিক সমস্যা।
এই রোগটা যেকোনো বয়সে বিভিন্ন কারণে হতে পারে–
যেমন- অত্যাধিক মানসিক আঘাত, মাথায় ধাক্কা লাগার মতো শারীরিক আঘাত ইত্যাদি ইত্যাদি…..
গবেষকদের মতে এটি মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক পদার্থ কম বা বেশি হবার কারণেও এই রোগটা হতে পারে।
আমার মনে হয় চাঁদের অত্যাধিক মানসিক আঘাতের কারণেই এই রোগটা হয়েছে।
আরো বললেন —
নেশাগ্রস্ত লোকেদের যেমন নেশা না করলে ভীষণ কষ্ট হয়।ঠিক তেমনিই ক্লিপটোম্যানিয়া পেশেন্টদের চুরি না করলে ভীষণ কষ্ট হয় । এটা একটা আবেগের মতো আসে। যেটা সে দেখছে সেটা তাকে চুরি করতেই হবে। তা না হলে তার এক ধরনের মানসিক কষ্ট হয়। চুরি করার সময় সেই মানসিক কষ্ট কমে যায়, আনন্দ পায়। এরা কেবলমাত্র এদের মনের এক অদম্য শক্তিশালী চুরি করার ইচ্ছা থেকেই চুরি করে ফেলে। এরা খুব কম দামের জিনিস চুরি করে এবং চুরি করা জিনিস ব্যবহার করে না।চুরি করার পর এদের প্রচন্ড অপরাধ বোধ , ভয়, আত্ম ঘৃণা, অনুশোচনা ও লজ্জা হয়।
হঠাৎই এই রোগটার জন্য চন্দ্রিমা মোজা জোড়া চুরি করে ফেলে। তখন যদি ওকে তাড়িয়ে না দিয়ে ঠিকমতো ট্রিটমেন্ট করা হতো, তাহলে ওর এই অবস্থা হতো না।
বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া, চোর অপবাদ, রোজ মার খাওয়া প্রভৃতি কারণে চন্দ্রিমা পুরোপুরি বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হয়েছে। এমনকি স্মৃতিশক্তি ও হারিয়ে ফেলেছে। আকাশ এতক্ষণ অন্তরিন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করছিল চাঁদের হৃদয়বিদারক যন্ত্রণা।
হঠাৎ বাইরে বজ্রবিদ্যুৎ সহ মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। ধুয়ে যেতে লাগল একের পর এক ধুলো-ময়লার আস্তরণ। আবর্জনার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো সবুজে সবুজ…….
।
— এবার কি হবে আঙ্কেল ??
— তুমি চিন্তা কোরোনা বাবা। লন্ডনে আমার এক ডাক্তার বন্ধু আছে। সে নামকরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। আমার বিশ্বাস ওই ডাক্তারের ট্রিটমেন্টে , তোমার সুশ্রূশায়, ভালোবাসায়, চন্দ্রিমা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি চন্দ্রিমাকে বিয়ে করে লন্ডনে চলে যাও।
আকাশ বলল
— আমি চাঁদকে এখন বিয়ে করতে পারব না আঙ্কেল।
— কেন ….!!!
চাঁদেরও তো একটা মতামত আছে আঙ্কেল। আমি নিজের ইচ্ছাটাকে ওর উপর চাপিয়ে দিতে চাই না।
— চাঁদ সুস্থ হবার পর ও যদি আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়, তবেই আমি ওকে বিয়ে করব।
— ঈশ্বরের কাছে আমার একমাত্র প্রার্থনা, ” তিনি যেন আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় চাঁদকে সুস্থ করে তোলেন”। এছাড়া এ জীবনে আমার আর কিছুই চাইবার নেই।
এ কদিনের মধ্যে চাঁদ আকাশকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। খেতে গেলে আকাশকে লাগবে শুতে গেলে লাগবে। মাঝে মাঝে আকাশকে জড়িয়ে ধরে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কি যেন একটা খোঁজার চেষ্টা করে। আর বলে
–তোকে আমার খুব ভালো লাগে। তুই আমার সঙ্গে সব দিন থাকবি তো বল?
আকাশ চাঁদকে শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে ওর সারা মুখে চুম্বন করতে থাকে আর বলে
–থাকবো তো! থাকতেই তো চাই।
এ কথার মানে চাঁদ ঠিকমতো বুঝলো কি না জানিনা কিন্তু সে আকাশের বুকের মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সঁপে দেয়। এর থেকে বোঝা যায় তার অবচেতন মনে কোথায় যেন একটা বিশ্বাস ও ভরসার জন্ম হয়েছে আকাশের প্রতি। এগুলি শুনে ডাক্তার আংকেল বললেন
–এটা চাঁদের একটা পজিটিভ দিক।
তারপর ডাক্তারবাবুর আপ্রাণ চেষ্টায় খুব তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। আকাশ চন্দ্রিমা ও দুর্গা মাসিকে নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল। প্লেনের মধ্যে চাঁদ সব সময় আকাশকে স্বর্ণলতার মত জড়িয়ে রইল। ছোট্ট শিশুর মতো।
আসুন না আমরা– চন্দ্রিমাদের মত মানুষদের পাগল বলে অন্ধকারে ঠেলে না দিয়ে, এদের ভালোবেসে সুস্থ হতে সাহায্য করি। গড়ে তুলি সুন্দর পৃথিবী। যেটা হবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ভরসার, বিশ্বাসের, ভালোবাসার আবাসস্থল।”
খুব সুন্দর লাগলো।