ধারাবাহিক গল্প :- জীয়ন কাঠি কলমে :- ছন্দশ্রী দাস তৃতীয় পর্ব

ধারাবাহিক গল্প :- জীয়ন কাঠি
কলমে :- ছন্দশ্রী দাস
তৃতীয় পর্ব
নিমিষা অমলেন্দু মিত্রকে সম্মতি জানিয়ে চলে আসে ।তার মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন থাকে সেসব কথা কাউকে বলতে পারেনা। নিজের ঠামুকে তো একদমই না ।তাহলে তাকে এইখানে আসতে দেবে না ।অথচ তার মন বলছে ওই বাড়িতে কোন একটা কিছু ঘটে চলেছে যা তাকে দাদাভাই বলতে চেয়েছিল ।কিন্তু সে বুঝতে পারেনি। তাকে ভালো করে ঠোঁটের ভাষা পড়া শিখতে হবে ।তবেই সে দাদা ভাইয়ের সাথে কমিউনিকেট করতে পারবে।
ওই বাড়িতে থাকাটা তার কাছে একটা চ্যালেঞ্জের মত হয়ে দাঁড়ায়।
নিমিষা বাড়িতে এসে ওর গৌর দাদার সাথে আলোচনা করে।
গৌর বলে ছয়মাস সে ঠিক সোমালিবুড়ির খেয়াল রাখতে পারবে ।আর তাদের যে রান্না করে তার তিনকূলে কেউ নেই। সে সবসময় সোমালিবুড়ির কাছে থাকবে । তাদের রান্নার কাজ করে দিয়ে যাবে ।দুজনের মধ্যে বেশ ভাব আছে।
নিমিষা নিশ্চিন্ত হয় গৌর দাদার কথায়। সে জানে গৌর দাদা যখন কথা দিয়েছে তার আর চিন্তা নেই ।গৌর ঠাট্টা করে বলে,আর কদিন পরে নিমিষা আমাদের রাজকুমারী হবে। তখন এই গরীব দাদাকে মনে থাকবে তো?
নিমিষা গাল ফুলিয়ে বলে, যার সোনার খাটে গা রুপোর খাটে পা সে কি করে গরীব গৌরদাদাকে মনে রাখে বলো! বলে খিল খিল করে হেসে ওঠে ।তারপর বলে তোমাকে একটা কথা বলি ,ওই বাড়ি বড় গোলমেলে বুঝলে ।অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে ওখানে । সেইসব জানতেই আমাকে যেতে হবে । সম্পত্তি আমি চাইনা ।
নিমিষা খুব সাবধানে থাকবি আর দেখেশুনে পা ফেলবি। প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট নিয়েছিস তো!
হ্যাঁ, আর সবকিছুর জেরক্স কপি করে রেখেছি। ঠামুর কাছেও দেওয়া আছে ।আর তোমার কাছেও রেখে যাবো। তোমাকে হোয়াটসঅ্যাপে ফটো পাঠিয়ে দেবো ।তোমার ল্যাপটপে সেভ করে রেখো যাতে হারিয়ে গেলে আবার পাওয়া যায়।
ঠিক আছে রে। আমার বড় চিন্তা হচ্ছে।
কিছু ভেবো না আমি ঠিক থাকব ।আমার নাম নিমিষা। চোখের পলক ফেলার আগেই আমি সব বুঝতে পারি। আমার মাথার মধ্যে কেউ যেন বলতে থাকে সব ঠিক নেই। ভাল করে চোখ মেলে চেয়ে দেখ। তাই তো সেদিন আমি হাত থেকে ইচ্ছে করে রাহুলের খাবার বাটিটা ফেলে দিয়েছিলাম। আর রাহুলের মুখে ফুটে উঠেছিল স্বস্তির হাসি। আর ওর নার্স খুব রেগে গিয়েছিল।
হ্যাঁরে তোর দাদু অমলেন্দু কাকাকে কেমন দেখলি ?
বেশ ভালো ।বয়স হলেও যথেষ্ট স্টেডি আছেন। অবশ্য গলার স্বর শুনে বয়স হয়েছে বলে মনে হয় না ।আচ্ছা গৌরদাদা তোমার মনে আছে বড় দাদুকে?
হ্যাঁ। খুব হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত ছিলেন ।আমরা ছোট ছিলাম তো আমাদের সাথে খুব খেলত। কাকার ফর্সা বুকে একটা লাল জরুল ছিল। বুকের ডানদিকে। আমি খালি ওটা চাটতাম চাটনি বলে ।হা হা করে হেসে ওঠে গৌরদাদা।
নিমিষার মুখে মৃদু হাসি খেলে যায় ।গৌর চলে যেতে সে ঠামুর কাছে গিয়ে বসে ।ঠামু হাতের সেলাই রেখে দিয়ে তাকে কোলে টেনে নেয়। মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে সবকিছু হারিয়ে এই সবেধন নীলমণিকে নিয়ে দিন কাটত ।ভগবানের সইল না। তাকেও আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে ।জানিস মা আমার মন কেমন কু গাইছে ।মন বলছে ওখানে কোন ঘটনা ঘটবে যার সাথে তুই জড়িয়ে পড়বি। আর তোর প্রাণসংশয় হবে ।এক মন বলছে যেতে দিও না, আর এক মন বলছে মেয়েকে বাঁচার মত করে বাঁচতে দাও । দুনিয়াটাকে জানুক দেখুক নিজের চোখে।
জানিস নিমি ওসব পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা সম্পত্তিতে আমার বিন্দুমাত্র লোভ নেই। আমি জানি আমার নিমিষা বুদ্ধিমতী ও ঠিক নিজের পায়ে দাঁড়াবে। শুধু ওই যে তুই এসে বললি রাহুলের কথা আমার বুক যেনো ভালোবাসায় ভরে গেল। মনে হল আহা যদি বাছাকে কাছে পেতাম তো নিজের করে রাখতাম। রাহুলের জন্য তোকে পাঠাচ্ছি। দেখ যদি উদ্ধার করে নিয়ে আসতে পারিস ওকে ।
তোমার এমন কেন মনে হল ঠামু,রাহুলদাদা ওখানে বন্দী হয়ে আছে!
কি জানি, তবে মনে হলো রাহুল ভালো নেই ওখানে। আচ্ছা ঠামা বড় দাদুর কথা তোমার মনে আছে কিছু? আমি তো তাকে দেখিনি ।আমার বিয়ের আগেই সে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় ।তবে তোর দাদুর মুখে শুনেছি বাচ্চাদের খুব ভালোবাসতেন ।ফর্সা টকটকে রং আর বুকের ডান দিকে লাল জরুল ছিল।
নিমিষা নিশ্চিন্ত হয়। সে মনে মনে নানা কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে ।তার ঠাকুমা ও চুপ করে বসে থাকে। দেখতে দেখতে নিমিষার যাবার দিন এসে যায়। নিমিষা ওর সব দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে বলে তোমাকে একলা রেখে যেতে বড় কষ্ট হচ্ছে ।কোনদিন তোমায় ছাড়া ঘুমাইনি ।জানিনা ওখানে কি হবে। তবে তুমি সাবধানে থেকো। কোন অচেনা অজানা লোককে বাড়িতে ঢুকতে দিও না।আর তুমিও কথা বলবে না।
নিমিষা যখন ল্যাবক্যাবে পৌঁছালো তখন বেশ অনেক ছেলেমেয়েই এসে হাজির হয়েছে। তারা সবাই বাইরের বড় ড্রইংরুমে যে যার জিনিসপত্র নিয়ে বসে আছে ।সবার হাতেই স্মার্টফোন ।যে যার নিজের ফোনে নিমগ্ন। কেউ কারো দিকে ফিরে তাকায় না। তাদের চেহারা পোশাক আশাক দেখে বুঝতে পারে সবাই বেশ সচ্ছল পরিবারের সন্তান ।একমাত্র নিমিষাই হতদরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে। তারপর নিজের মনেই হেসে ফেলে ভাবে সবাই তো এক পরিবারের সন্তান, শুধু ডালপালা বিস্তার করেছে। তবে সম্পর্ক খুব দূরের নয়। তার চোখ দিয়ে গুনে দেখে তাকে নিয়ে আটজন ।আরো দুজন আসতে বাকি ।প্রায় ঘন্টা খানেক বাদে তারা আসে। সবাই এসে গেলে উজান ঘরে ঢুকে বলে, আপনারা সবাই জল খাবার খেয়েছেন তো? কোন কিছু লাগলে বলুন।
একটি ছেলে বলে আমি অনেকক্ষণ থেকে বসে আছি। আমার অনেক কাজ নষ্ট করে এখানে এসেছি। এখন যদি আমার ঘর দেখিয়ে দেন তো ভালো হয় একটু বিশ্রাম নিতে পারি।
উজান বলে দয়া করে আরো আধঘণ্টা অপেক্ষা করুন। একটায় লাঞ্চ টাইম। স্যার আপনাদের সবার সাথে খাওয়ার টেবিলে দেখা করবেন ।আর কিছু হয়তো বলবেন। একটু ধৈর্য ধরুন আপনাদের ঘর রেডি আছে। একটি মেয়ে বলে ওঠে আমি কারো সাথে রুম শেয়ার করতে পারব না। এতে আমার প্রাইভেসি নষ্ট হবে।
নিমিষা তার দিকে তাকিয়ে দেখে অতি-আধুনিক মেয়ে। তার চোখে-মুখে ঔদ্ধত্য প্রকাশ পাচ্ছে।
উজান বলে, না না ম্যাডাম আপনাদের সবার জন্যই আলাদা রুম এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আপনাকে কারো সাথে রুম শেয়ার করতে হবে না ।
তাদের কথার মাঝেই ভেতরের গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে ঢং করে একটা বাজার শব্দ হল ।ঘরের পর্দা সরিয়ে একটি লোক এসে বললো, দাদা সবাইকে নিয়ে টেবিলে চলে আসুন। সব রেডি কর্তাবাবা অপেক্ষা করছেন।
উজান সবাইকে নিয়ে ভিতরে যায় ।বিশাল হল ঘরের একদিকে ডাইনিং টেবিল ।সেখানে একসাথে ত্রিশজন বসে খেতে পারবে। নানা রকম খাবার সাজানো আর প্রত্যেকটা ডিস উপুর করে রাখা। টেবিলের শেষ মাথায় বসে আছেন অমলেন্দু মিত্র ।সবাই যখন হল ঘরে ঢুকে একে একে চেয়ার টেনে বসল তিনি সবাইকে তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ্য করতে থাকেন। নিমিষা চেয়ার টেনে বসার আগে সবার উদ্দেশ্যে বলে, শুভ দুপুর বন্ধুরা আজ এখানে আমাদের সবার প্রথম দিন তাই সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে দুপুরের আহার শুরু করি।
নিমিষার প্রত্যুত্তরে সবাই শুধু কাঁধ ঝাঁকায়। অমলেন্দু বলেন ,তোমরা কি জন্য এসেছ তা তোমরা সবাই জানো। এখানে তোমাদের ছয়মাস থাকতে হবে ।তাই তোমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাথে পরিচিত হয়ে নাও ।আমার ডান দিক থেকে শুরু করো।
আমি সুবোধ বসু। বাড়ি উত্তরপাড়া। আমার ঠাকুরমা আপনার ছোট বোন হন।
আমি দীপা আমার দাদু আপনার মেজ ভাই হন ।আমি আমার দাদুর বড় ছেলের মেয়ে।
আমি তিতিক্ষা দীপার খুড়তুতো বোন।
আমি অনির্বাণ আপনার বড় বোনের বড় ছেলের ছেলে। আমি শ্যামল আমি আপনার সেজ ভাইয়ের একমাত্র ছেলের ছেলে ।
আমি শুভময় আপনার বড় বোনের মেজো ছেলের ছেলে।
আমি কৃদন্তী। আপনার মেজ বোনের ছেলের মেয়ে। আমি দীপন আপনার মেজ ভাইয়ের ছেলের ছেলে।
আমি তন্ময় আপনার বড় বোনের ছোট ছেলের ছেলে। আমি নিমিষা। আপনার ছোট ভাইয়ের ছেলের মেয়ে।
সবার সাথে সবার পরিচয় হয়ে যায়। অমলেন্দু বলেন আমরা সবাই এক পরিবারের লোক কিন্তু যোগাযোগের অভাবে কেউ কাউকে চিনি না। আমিও বহু বছর বিদেশে ছিলাম। একটা দুর্ঘটনা আমাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসে ।আমার একমাত্র নাতি রাহুল ওই দুর্ঘটনায় তার সমস্ত রকম ক্ষমতা হারায়। চিকিৎসার গুনে এখন একটু একটু হাত পা নাড়াতে পারে। কিন্তু কথা বলতে পারেনা। বিছানায় শয্যাশায়ী ।তাকে ধরে কোন মতে হুইল চেয়ারে বসানো যায় ।তার বয়স 27 ।দারুন ব্রিলিয়ান্ট ছিল। ফিজিক্স নিয়ে রিসার্চ করছিল। হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই সে তার নতুন আবিষ্কার সবার সামনে নিয়ে আসত। কিন্তু তার ভাগ্য তাকে সেই সম্মান পাওয়া থেকে বঞ্চিত করে। আর তোমাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছি, যে আমার শর্ত মেনে চলতে পারবে সেই হবে আমার কোটি কোটি ডলারের মালিক। কারণ রাহুলের জীবন আর কদিনের। আমি চাইনা আমার মৃত্যুর পর সবকিছু সরকার নিয়ে নিক। তাই এই ছয়মাস আমি দেখব ।যাকে আমার যোগ্য উত্তরাধিকার বলে মনে হবে তার নামে সবকিছু লিখে দেবো। নাও এবার খাওয়া শুরু করো। বিশ্রাম নাও সন্ধ্যায় বলব প্রথম কাজের কথা।
সবাই চুপচাপ খেতে শুরু করে। খাওয়া হয়ে গেলে কাজের লোক গোপালদা এসে সবাইকে তার সাথে যেতে বলে। তাদের ঘর চিনিয়ে দেয় সবাই নিজের নির্দিষ্ট ঘরে ঢুকে পড়ে ।
সন্ধ্যাবেলায় গোপালদা এসে সবাইকে দোতলার ড্রইং রুমে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানেই সোফায় বসে আছেন অমলেন্দু। চায়ের ব্যবস্থা সেখানেই করা হয়েছে ।সবাই ড্রইংরুমে হাজির হয় সবাই সবাইকে বলে গুড ইভনিং এভরিবডি ।
অমলেন্দু বলেন ,এসো একসাথে চা পান করা যাক আর কিছু কাজের কথা আলোচনা করা যাক। সেন্টার টেবিলে এক মহিলা চায়ের সরঞ্জাম ও স্নাক্স দিয়ে যায়। সবাই হাত গুটিয়ে বসে থাকে। তখন নিমিষা এগিয়ে গিয়ে কাপে চা ঢেলে প্রথমে অমলেন্দুকে দেয়। তারপর সবাইকে দিয়ে নিজের চা নিয়ে বসে।
অমলেন্দুর ঠোঁটে হালকা হাসি খেলে যায়। তিনি বলেন , আমার এই যে বিশাল বাড়ি , শুধু মাত্র দু’জন কাজের লোক দিয়ে পরিষ্কার হয় না। তাই তোমাদের সবাইকে এই বাড়ির প্রতিটি কোনা পরিস্কার করতে হবে । এটাই তোমাদের প্রথম কাজ।
সুবোধ বলে, ওসব চাকরের কাজ। আমি ওসব কখনো করিনি ।ওইসব আমার দ্বারা হবে না।
সবাই অল্পবিস্তর সুবোধের সাথে গলা মেলায়।
অমলেন্দু বলেন , প্রথম কাজ যদি না করতে পারো তাহলে বন্ডে সই করেছিলে কেন? আর যখন এত বড় সম্পত্তি পাবে তখন তার দেখা শোনাও তো নিজের হাতে করতে হবে। নিজের বাড়ির পরিষ্কার করাকে কখনো চাকর এর কাজ বলে না ।
তখন সবাই চুপ করে যায় ।অমলেন্দুর অনুমতি নিয়ে যে যার ঘরে চলে যায়।সবাই যাবার আগে অমলেন্দু বলেন, ঠিক সাড়ে নটায় ডিনার ।সবাই হাজির হয়ে যাবে কেউ ডাকতে যাবেনা।
ক্রমশঃ
**************