|| হার – জিত || © মোনালিসা সাহা দে

|| হার – জিত ||
© মোনালিসা সাহা দে
সকাল থেকেই আজ মন উচাটন রেশমীর। কখন যে বিকেল হবে!
কোন জিন্স টা পরবে, তাও ঠিক করে উঠতে পারছে না সে। নাকি টপ-লং স্কার্ট পরবে! আবির বলেছিল তার নাকি শাড়িই বেশী পছন্দের। কিন্তু শাড়ি পরে তো রেশমী একদমই সামলে উঠতে পারে না। কী যে করে সে!
নাঃ! শাড়িই পরতে হবে। আলমারীটা খুলে একবার দেখে নিল সে। দূর! যত সব আদ্যিকালের মায়ের শাড়ি। একটাও পছন্দ হচ্ছে না। আচ্ছা ওই দ্বিতীয় তাকে কি একটা নীল নীল দেখা যাচ্ছে, ওটা কি? ওহো!! ওটাই তো দু বছর আগে ঋতম দিয়েছিল তাকে! সিফন প্রিন্টেড ডিপ নীল শাড়ি। মাথাতেই ছিল না রেশমীর।
ঋতমের সাথে তার ছয় বছরের স্টেডি রিলেশনের ব্রেক আপও তো প্রায় এক বছর হতে চলল। ঋতম সেন। উল্টোডাঙ্গার ঋতম সেন। এত তাড়াতাড়ি ঋতমকে এভাবে অস্তিত্বহীন সে নিজেই করে দিয়েছে, তাই ভুলে যাওয়াটাই তো তার পক্ষে স্বাভাবিক। লেখাপড়াতে মন্দ ছিল না ঋতম। কিন্তু কবি কবি টাইপ টিউশন করে বেড়ানো প্রাক্তন প্রেমিককে মনে রেখেই বা করবে কি রেশমী! খুব প্যানপ্যানে টাইপ ছিল তো সে। সবসময় নীতি আদর্শের বুলি কপচানো ওয়ালা। পাতি মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির সভ্য ভদ্র ছেলে। চার চাকা কেনার স্বপ্ন নেই, অর্থ রোজগারের চাহিদা নেই, পুরো বোগাস! বাপরে! সম্পর্ক ভেঙে বেঁচেছে সে। ওর দ্বারা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কোনদিনই হত না। অত নীতি-ফিতি মানতে গেলে চলে নাকি? তাহলে আবিরকে পেত সে? কলকাতাতে জন্ম হওয়া, মাধ্যমিক- উচ্চমাধ্যমিকে স্কলার, ডাক্তার দম্পতির একমাত্র সন্তান আবির। যাদবপুরে কম্পিউটার ইন্জিনিয়ারিং পড়া, বর্তমানে মা-বাবা সহ নিউ ইয়র্কে প্রবাসী আবির গাঙ্গুলী। এখন ওখানকার পাকাপাকি বাসিন্দা হলেও শিকড় তো তার কোলকাতারই। পার্ক স্ট্রিটে বিশালাকার বাড়ি তার। বর্তমানে সে বাড়ি কেয়ারটেকার দেখাশোনা করে। এমন পাত্র তার মা বাবাও ঠিক করতে পারত তার জন্য? এন. আর. আই ইঞ্জিনিয়ার বলে কথা!
সবসময় হুল্লোড়ে মেতে থাকা, জীবনকে উপভোগ করার আর এক নাম আবির। ফেসবুকে আলাপ, নিজেই রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছিল রেশমী। অত্যন্ত হ্যান্ডসাম আবির। ঝাঁ চকচকে প্রোফাইল দেখেই ভালো লেগে যায় তার আবিরকে। তারপরে চ্যাট শুরু। যেচে যেচেই আলাপ জমিয়েছিল রেশমী। যথেষ্ট সুন্দরী সে! আধুনিকা এবং বাকপারদর্শিনী। ইতিহাসে এম.এ. পাঠরতা রেশমীর ডাকে সাড়া না দিয়ে কেই বা কদিন থাকতে পেরেছে! কদিনের মধ্যেই ভালো লেগে যায় আবিরেরও তাকে। শুরু হয় চুটিয়ে চ্যাটিং।
এদিকে তখনও ঋতমের সেই রোজ দিনের সৎ পথে চলা, রেশমীর প্রতি নির্ভরতা আর চিরকালের ভালোমানুষী বিরক্ত লেগে যাচ্ছিল রেশমীর। কবে তার সরকারি চাকরি হবে, কবে বোনের বিয়ে দিতে পারবে, কবে সে রেশমীর দায়িত্ব নিতে পারবে, এ ব্যাপারে রেশমী নিজেই সংশয়ে পৌঁছে গিয়েছিল। তাছাড়া আবিরের সাথে নিয়মিত চ্যাটে নেশাগ্রস্তও হয়ে গিয়েছিল সে।
আবিরকে সব কিছুই জানিয়েছিল সে… তার মধ্যবিত্ত বাবা-মা, ভালো লাগা, মন্দ লাগা, ব্যবসায়ী দাদা, উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনোভাব… সবই। শুধু তার জীবনে ঋতমের উপস্থিতি টুকু ছাড়া। তারপরে টুক করে একদিন ঋতম কে ফোন করে জানিয়ে দেয় সে আর সম্পর্ক রাখতে পারবে না। না, এর চেয়ে বেশি সে কিছুই আর বলেনি ঋতমকে। সবকিছুতে রাতারাতি ব্লক করে ফেলে সে ঋতমকে। মোবাইলেও সে ঋতমকে রিজেক্ট লিষ্টে ঢুকিয়ে দেয়। এমন কি যে কমন ফ্রেন্ডের মাধ্যমে ঋতমের সাথে তার পরিচয় হয়েছিল, তার সাথেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় রেশমী। প্রথম প্রথম দু একবার তাও ঋতম যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল তার সাথে। পরে আর করেনি। উড়ো খবর কানে এসেছিল ঋতম নাকি অবসাদে চলে গিয়েছিল। অবশ্য সেটাই হয়ত ওর পক্ষে স্বাভাবিক ছিল। কারণ রেশমীর উপর ভীষণ ভাবে মেন্টালি ডিপেন্ডেড ছিল যে সে। কিন্তু রেশমী তখন আবিরের নেশায় মশগুল। অত ভাবার সময় কোথায় তার! তবে একটা ব্যাপারে রেশমী আজও ঋতমের কাছে কৃতজ্ঞ। ঋতম এত কষ্ট পেয়েও কখনো রেশমীর বাড়ির ধারে কাছে আসেনি। নাহলে এইসব জানতে পারলে রেশমীর বাবা কি রেশমীকে আস্ত রাখতো?
যাক গে! যা হবার তা হয়েছে। আনন্দের কথা এটাই যে আবির তাকে গত মাসে প্রপোজ করেছে, কালই সে দীর্ঘদিন পর কোলকাতা এসেছে, একাই। শুধুমাত্র রেশমী আর তার পুরোনো বন্ধুদের সাথে দেখা করতেই তার অত্যন্ত ব্যস্ত জীবন থেকে দু দিনের সময় বের করেছে সে। আজ শেষ রাতেই তার ফিরে যাওয়ার ফ্লাইট, আর আজ বিকেলে তার সাথে আবিরের প্রথম দেখার মুহূর্ত। কী ভীষণ এক্সাইটেড সে! যদিও এতদিন ধরে ছবি আর ভিডিও কলে তারা বহুবারই পরস্পরকে দেখেছে, তবু চাক্ষুষ দেখার তো আলাদাই চার্ম!
আবিরটা খু্ব জেদী। কোন এক ছোটবেলার বন্ধু, ‘রাজু’ না কি একটা নাম, তার বাড়িতেই উঠতে হলো তাকে। এতবার করে রেশমী আবিরকে বলেছিল তার বাড়িতে উঠতে, যেহেতু বাড়িতে সবাইকে সে আবিরের ব্যাপারে আগে থেকেই বলে রেখেছে, তারাও যথেষ্ট খুশি তাদের সম্পর্কে, তবু আবির তার কথা শুনলে তো! মাঝে মাঝে ভেবেই রাগ হচ্ছে রেশমীর।
যাক গে! অতশত ভেবে লাভ নেই। আবিরের সঙ্গে তার রিলেশনের আজ একটা গোল্ডেন দিন। অত সাত পাঁচ ভেবে কি হবে আর! সুন্দরী, এম.এ পাঠরতা রেশমী সেই সিফন শাড়িটাই পরে নিল। সাথে ম্যাচিং সব অক্সিডাইসড গয়না। স্টেপকাট খোলা চুল আর ম্যাট মেকআপে তাকে অপরূপা লাগছে, আয়নাতে নিজেকে দেখে নিজেই তৃপ্ত আজ রেশমী। এক মুহূর্তের জন্য শাড়িটার দিকে চোখ পড়তেই ঋতমের মুখটা ভেসে উঠল রেশমীর। চয়েজ ছিল ঋতমের। এত সুন্দর শাড়িটা! শুধু জীবনে কখনো জিততে পারলো না ছেলেটা তার আদর্শের চাপে পড়ে। সারাজীবন হেরেই গেল। বাট রেশমি ইজ অলওয়েজ এ উইনার। আত্মতৃপ্তিতে ভরে উঠল সে।
**
সাতটায় দেখা করার টাইম! বাজে এখন পাঁচটা। আজ আর বাসে যাবে না রেশমী। বিধ্বস্ত লাগবে তাকে তাহলে। কেষ্টপুরের ছোট্ট বাড়ি থেকে ওলার শেয়ার ট্যাক্সি করে নিল সে। একটু তাড়াতাড়িই বের হল রেশমী। কতো বড় বড় রেষ্টুরেন্ট থাকতে কিনা আবির ডাকলো তাকে সেই কলেজস্ট্রীটের কফিহাউসে। দূর! ভাল্লাগে না। ও তো বয়ষ্কদের জায়গা! আবিরের সেই বন্ধুও নাকি সঙ্গে আসবে, আর তার পছন্দের স্থান কিনা কফি হাউস। কী বিরক্তিকর! বন্ধুকে আনারই বা কি দরকার ছিল কে জানে। কই, সে তো কোনো কাবাব মে হাড্ডি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে না! কী আর করে রেশমী! প্রথম দেখার দিনে আবিরের সঙ্গে কোনো বিতর্কে যেতে চায় না সে। অগত্যা..!
কাঁকুড়গাছির প্যান্টালুনস এর সামনে জ্যামে আটকে আছে রেশমীর ট্যাক্সি। আবিরের নেশায় বুঁদ হয়ে রয়েছে সে ট্যাক্সির মধ্যেও। আবির তাকে ‘মেঘা’ বলে ডাকে। কি মিষ্টি লাগে তার নামটা। সেই যেদিন আবিরের সাথে তার প্রথম মোবাইল নম্বরের আদান প্রদান, সেদিনই আবির প্রথম তাকে ফোন করে এই নামে ডেকেছিল। সেদিন থেকেই তাদের প্রেমের সূচনা। বাইরে অঝোর বৃষ্টি, আর ঘরে সারা রাত ধরে আবিরের সঙ্গে ফোনে গল্প, কি দারুণ ছিল সেই রাতটা!
“ম্যাডাম এসে গেছি”। ড্রাইভারের খ্যানখ্যানে গলায় চমকে ওঠে রেশমী। ওমা! তাই তো! লাষ্ট মিনিটের মেক আপ টাচ দিয়ে নিল রেশমী তাড়াতাড়ি করে।
১৩নং টেবিলটা কোন দিকে! রেশমী বসল নির্দিষ্ট স্থানে। চারিদিকে কিসব অদ্ভুত মার্কা লোকজন সব বসে। ভালো লাগছে না রেশমীর। দূর! আবির এখনো এসে পৌঁছায়নি। পরে শান্ত হল রেশমী। না আসুক। একটু ওয়েটই না হয় আজ করলো রেশমী। কেষ্ট পেতে গেলে কষ্ট তো করতে হয় বস্।
আবির বলে দিয়েছিল আজ তারা ফোনাফুনি, হোয়াটসঅ্যাপ করবে না বেশি। তাতে দেখা হওয়ার আবেগটা কমে যেতে পারে। তাই চুপচাপ চেয়ারে বসে ফোনে ফেসবুকের নিউজ ফিড চেক করতে থাকে সে। হঠাৎ পেছন থেকে সেই পরিচিত কন্ঠস্বর!
-”এসে গেছি!”
— ” উফ আবির! কতক্ষণ ওয়েট করালে।”
ঘুরে তাকিয়েই চমকে উঠল রেশমী। যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট! আবিরের পাশে দাঁড়িয়ে ঋতম!
**
দু ঘন্টা কমপ্লিট। রেশমী বাড়ি ফিরছে, সঙ্গে আবির, আবিরের এস.ইউ.ভি.গাড়িতেই। তাদের এখানকার ড্রাইভার তাদের রেশমীর বাড়ি পৌঁছে দিয়েই ফিরে যাবে। আজই রেশমীর বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করে প্রাথমিক কথা বলে নিতে চায় আবির। ফিরে গিয়ে নিজের বাবা মাকে নিয়ে ছয় মাস পরে আবার আসবে পাকা কথা বলতে। কথা দিয়েছে আজ আবির। এতটাই এক্সাইটেড সে।
মনের মধ্যে এক চোরাকাঁটা খচখচ করেই চলেছে রেশমীর। মুখে তেতো হাসি লাগিয়ে রেখেছে। ঋতমের সব মুছে ফেলা স্মৃতি ফিরে এসে এলোমেলো করছে তাকে। প্রথম আলাপ, ভালোবাসা, নির্জনে সেই ঘনিষ্ট হওয়া, ব্রেক আপ…. সঅঅব…।
আবিরের ছোটবেলার বন্ধু রাজুই যে ঋতম, একবারও মাথাতেও আসেনি তার। ঋতমের ডাক নাম যে ‘রাজু’, তা রেশমী জানত! তবু আবিরের নেশায় সে সবকিছু ভুলে গিয়েছিল। মনের মধ্যে একবারও কোনো প্রশ্ন উঁকি দেয়নি তার। আবির তার বন্ধুকে তার প্রেমিকার সাথে সাক্ষাতে আলাপ করিয়ে দেবে বলে তার নাম বা ছবি কিছুই শেয়ার করেনি, ফোনেও তার সামনে শুধু ‘মেঘা’, ‘মেঘা’ করেই ডেকে গেছে। ঋতম কি আজ এই ভয়ংকর আঘাত নিতে পারলো? চোখে মুখে তো সে নিরুত্তাপই রইল।
চাইলে ঋতম আজ তাদের অতীতের সব কিছু উগলে দিতে পারত আবিরের কাছে। কি অদ্ভুতভাবে সে পুরো পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক রাখার জন্য “জরুরী ফোন আসার” অজুহাত দেখিয়ে ফিরে চলে গেল। বরাবরই সে ভীষণ চাপা। আজ দুটো চোখের পলক একবার বন্ধ করে, ঠোঁটে আলতো হাসি এনে রেশমীকে সে যেন আশ্বস্তই করল তখন। তারপর নিঃশব্দে উঠে চলে গেল। আবিরের শত অনুরোধেও সে আর বসল না। আবির তো একটু রেগেই গেল ছোটবেলার অন্তরঙ্গ বন্ধুর উপরে।
সারাজীবন রেশমী ঋতমকে তার সততা আর ভালোমানুষীর জন্য খোঁটা দিয়ে এসেছে। অথচ আজ ঋতমের এই ভালোমানুষীর জন্যই রেশমী আবিরের জীবনে পাকাপাকিভাবে প্রবেশ করতে চলেছে। রেশমীর এই প্রথম নিজেকে খু্ব ছোট মনে হচ্ছে। মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।
সারাজীবন সে জিতে এসেছে সব ক্ষেত্রে। কিন্তু আজ কি সত্যি সে বিজয়ী হতে পারল? নাকি আয়নার মুখোমুখি হওয়ার পরীক্ষায় সেই হয়ে রইল সবথেকে বড় লুজার??
নাঃ! চোখ বন্ধ করে নিল রেশমী!
————- সমাপ্ত —————-
© মোনালিসা সাহা দে