বর্ষবরণের সেকাল একাল **** ধারা ভৌমিক ভাদুড়ী

বর্ষবরণের সেকাল একাল

ধারা ভৌমিক ভাদুড়ী

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন – যাঁর বুদ্ধি বাল্যে পুস্তক মধ্যে , যৌবনে বোতলের মধ্যে , বার্ধক্যে গৃহিণীর অঞ্চলে , তিনিই বাবু …যাঁর ইষ্টদেবতা ইংরাজ , গুরু ব্রাহ্মধর্মবেত্তা , বেদ দেশি সম্বাদ পত্র ( সংবাদ ) এবং তীর্থ ‘ন্যাশানাল থিয়েটার’ তিনিই বাবু ۔۔۔ যিনি মিশনারির নিকট খ্রিশ্চিয়ান , কেশবচন্দ্রের নিকট ব্রাহ্ম , পিতার নিকট হিন্দু , এবং ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের নিকট নাস্তিক তিনিই বাবু ۔۔۔যিনি নিজ গৃহে জল খান , বন্ধুগৃহে মদ খান , বারবনিতার গৃহে গালি খান এবং মুনিম গৃহে গলাধাক্কা খান তিনিই বাবু ۔۔۔ যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করবেন , গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষীপূজা করবেন , উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করবেন , পাঁঠার লোভে গঙ্গাপূজা করবেন তিনিই বাবু ۔۔۔۔l

সেকালে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য এইসব বাবুরা নববর্ষের আগে বাড়ি রঙ করতেন l পুরোনো অট্টালিকার পুরোনো ঝাড়বাতি ফেলে দিয়ে নতুন ঝাড়বাতি লাগাতেন l কলকাতার বাঙালী বাবুদের মধ্যে রেষারেষি লেগে যেত কে কত জাঁকজমক পূর্ণ আড়ম্বর পূর্ণ উৎসব করছেন l বাঙালী বাবুদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন তনুবাবু l যিনি ছিলেন হাটখোলার প্রসিদ্ধ দত্ত পরিবার প্রথম পুত্র l সোনার চামচ মুখে দেওয়া এই মানুষটি র কাছে অর্থের কোনো মূল্য ছিলোনা l ওনার নববর্ষের পোশাক আসতো ঢাকা থেকে , ধোপদুরস্ত পোশাকে যিনি সবসময় ফিটফাট থাকতেন l সেই সব জামাকাপড়ের একেকটির মূল্য ছিল আকাশ ছোঁয়া l পাছে কোমরে কোনো দাগ হয় তাই মোটা পাড়ের অংশ কেটে ফেলে দর্জিবাড়ি ধোপাবাড়ি থেকে তাকে নতুন করে আনা হতো l এরপরেও যদি তা পছন্দ না হতো তৎক্ষণাৎ তিনি নতুন বস্ত্র আনার আদেশ দিতেন l পয়লা বৈশাখের দিন তাঁর বাড়িরকাছে গিয়ে দাঁড়ালেই বোঝা যেত তিনি সেরা বাবু কারণ ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ইরানি আতর ও গোলাপজল ছেটানো হত , চারিদিক গন্ধে একেবারে ‘ম’ম করতো , রাতের বেলায় সমস্ত অট্টালিকা যখন ঝাড়লণ্ঠন দিয়ে সাজানো হত , অন্ধকারের মধ্যে গোটা বাড়ি ঝলমল করতো তখন মনে হত স্বর্গপুরী – মানুষ অবাক হয়ে সে দৃশ্য দেখতো l নববর্ষের দিন তনুবাবুর বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার জন্য সোনা রূপোর থালাবাটি ব্যবহার করা হতো l পয়লা বৈশাখের দিন লোক খাওয়ানোতেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার ছিল l
জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তার খাওয়ানোতেই আনন্দ , এছাড়া গানবাজনা ও রঙ্গরসিকতার ব্যবস্থা থাকতো l তনুবাবুর পয়লা বৈশাখের আর একটা বৈশিষ্ট ছিল তিনি অকাতরে দান করতেন l l কোনো গরিব দুঃখী তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই পকেটে হাত দিয়ে যত মুদ্রা উঠতো তাই একজনকে দান করতেন l বহু দরিদ্র পরিবারের খাইখরচা সামলাতেন তনু বাবু l সেইসময় পয়লা বৈশাখের দিন কোলকাতার বাবুরা লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতেন – সে শুধু নিজেদের জন্য কিন্তু তনুবাবু ছিলেন ব্যতিক্রমী বাবু তাই সাধারণ মানুষ বলতো – বাবু তো বাবু তনুবাবু l সেকালের বাবুরা পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে তনুবাবুর সাথে পাল্লা দিতে না পেরে অনেকেই তাকে হিংসে করতেন তেমন ই একজন বাবু ছিলেন বাগবাজারের গোকুলচন্দ্র l একবার এক ব্রাহ্মণ তার কানের পুঁজ সারানোর জন্য গোকুল বাবুর কাছে একটু আতর চাইতে গেলে গোকুলবাবুর মাথায় দুষ্টবুদ্ধি খেলে গেল l তিনি সেই ব্রাহ্মণ কে পরামর্শ দিলেন – তনুবাবুর কাছে পয়লা বৈশাখের দিন কিছু চাইলে – তিনি কাউকে নিরাশ করেন না l ব্রাহ্মণ যেন তনুবাবুর কাছে গিয়ে একঘড়া আতর চান l ব্রাহ্মণ যথা সময়ে সেখানে গেলে তনুবাবুর বুঝতে বাকি রইলো না যে এ গোকুল বাবুর কারসাজি l তিনি কর্মচারীকে আদেশ দিলেন সেই ব্রাহ্মণ কে যেন একঘড়া আতর দেওয়া হয় l কর্মচারী সে কথা শুনে মাথা চুলকোতে শুরু করলো l তনুবাবু বুঝলেন আতর বাড়ন্ত l তিনি তৎক্ষণাৎ পকেট থেকে দশহাজার টাকা কর্মচারীকে দিয়ে আতর আনিয়ে ব্রাহ্মণ কে দান করলেন l ব্ৰাহ্মণ ও হত চকিত ! কারণ তিনি জানেন কানে পুঁজ হলে সামান্যই আতর লাগে l তবু সেই একঘড়া আতর গোকুলবাবুকে দেখালে তিনি বললেন – বাবু তো বাবু তনুবাবু l

পয়লা বৈশাখকে একালে বাঙালীর মননের সাথে যোগ করে ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর l তিনি লিখলেন ,
” নববর্ষে করিলাম পণ লব স্বদেশের দীক্ষা , তবে আশ্রমে তোমার চরণে হে ভারত লব শিক্ষা l” তাঁর কবিতা গান প্রবন্ধে বারবার এসেছে নতুন বছরের স্বাগত বাণী , পুরোনো জীর্ণ জীবনের অস্তিত্বকে বিদায় দিয়ে নতুনকে গ্রহণ করার উদাত্ত আহ্বান l চিরন্তন প্রথা অনুযায়ী প্রতিবছর উৎসাহী মানুষ নববর্ষের পয়লা বৈশাখে প্রভাতফেরী , গানে ও কবিতায় বর্ষবরণ করে, নতুন বস্ত্র পরে দেবদর্শন করে , কেউ আবার সাধ্যমত দরিদ্রকে অন্নবস্ত্র দান করে l লালশালুতে মোড়া হালখাতার জৌলুস আজ কিছুটা পাল্টেছে l নতুন বাংলা বছরে প্রতিটি বাঙালীর একটাই চাওয়া নববর্ষের উৎসব যেন কোনো জাতি ধর্ম বর্ণের বন্ধনে বাঁধা না থাকে l শুভেচ্ছা বিনিময় ,আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে বাঙালীর বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাঙালার সংস্কৃতির উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটুক – এ বুঝি সকলেরই চাওয়া l

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *