আত্মজা ——– ধারাবাহিক উপন্যাস অধ্যায় -১৭ ***** সুদেষ্ণা সিনহা

আত্মজা
———–
ধারাবাহিক উপন্যাস
অধ্যায় -১৭
সুদেষ্ণা সিনহা

সেই ঘটনার পর থেকে স্বাধীনতার সঙ্গে তেমন অন্তরঙ্গতা নেই অলোকের। আড়াইজনের সংসারে নিত্য দিনযাপনে শুধু প্রয়োজনেই দু’একটি কথা হয় মাঝে মধ্যে। একই ছাদের তলায় বসবাস করেও দুজনের মাঝে বিরাট ফারাক।
মেয়েটা দিন দিন বড় হচ্ছে।প্রতিটি দিনেই একটু একটু করে বিকাশ।এক খাটের মাঝখানে মেয়ে, দু’পাশে দু’জন। মেয়ের একটু একটু বেড়ে ওঠায় রীতিমত গবেষণা করে অলোক।
সে দেখে,মেয়ে কয়েকবার ধুপধাপ হাত-পা ছুঁড়ছে।আবার স্থির হয়ে কি সব দেখে আবার মেয়ে হাত-পা ছোঁড়া শুরু করছে। অলোক মৃদুস্বরে মেয়েকে বলে,বাবার মতো ফুটবল খেলবি নাকি?
আবার কোনদিন দাঁতবিহীন মাড়ি উপচানো হাসি হাসে তার মেয়ে।অলোক বলে,সুচিত্রা সেন হবে বুঝি? এমন ভুবন ভোলানো হাসি তোমার!
মেয়ে গাও গাও করে কথা বলে।অলোক বলে,ও বাবা,কথাও শিখে গেলে?
কিন্তু মন কেমন কু ডাকে।মেয়ের মা তার নিজের হল না,মেয়ে কি মাকে অমান্য করে বাবাকে ভালবাসবে। তার দুঃখ,কষ্টগুলোকে কি মেয়ে বুঝবে কোনদিন?

অলোকদের স্কুলে পর পর দুইদিন ছুটি।আজ চৈত্র সংক্রান্তি।কাল বাংলা নববর্ষ। স্কুল খোলা থাকলে কিভাবে দিন কেটে যায় বুঝতে পারে না সে। কিন্তু স্কুল ছুটি থাকলে দিন যেন কাটতেই চায় না। অলোকের বাড়িতে থাকতে একদম ভালো লাগে না। তার যেদিন ছুটি থাকে , দু’একদিন বাদ দিলে সাধারনত স্বাধীনতারও সেদিন ছুটি থাকে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে খবরের কাগজে মুখ গুঁজে কতক্ষণ আর বসে থাকা যায় ?
এখন শীতের রুক্ষ্মতার সাথে রোদের ঝাঁঝালো তেজ মিলেমিশে আছে।দুপুরে বেশীক্ষণ বাইরে থাকা যায় না। সজনে গাছগুলোতে সাদা ফুলের মুখ থেকে সরু লম্বা ডাঁটা বেরোচ্ছে।কৃষ্ণচূড়া,রাধাচূড়ার লাল-হলুদ পাঁপড়ি হাওয়ায় উড়ছে। গাছের ন্যাড়া মাথায় কচি পাতা গজাতে শুরু করেছে।
এখানে কাছেই একটা শিবমন্দির আছে। সেখান থেকে ঢাকের শব্দ শোনা যাচ্ছে। চৈত্র মাসের সংক্রান্তির দিন ওই মন্দিরের পাশে ফাঁকা জায়গায় চড়কের মেলা বসে।
একমাস ধরে সন্ন্যাসীদের সংযম,সারা দিন উপোষের পর মাটির উনুনে হাঁড়ি চাপিয়ে আতপ চালের ভাত আর আলু সিদ্ধ।সকাল ,বিকাল এই পথ দিয়ে লাল কাপড় পরে হেঁটে যায় সন্ন্যাসীদের দল। অলোক জবাকে কোলে নিয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
বল্লো শিবো! হর হর মহাদেব।একসাথে গর্জে ওঠে সন্ন্যাসীরা।
অলোকের ঠাকুমা বলতেন, গাজন উৎসব আর কিছু নয় শিবের সাধনা।এখানে শিবের সাধনা করা হয় নিজেকে উৎসর্গ করে।
আজ বিকেলে গাজন উৎসব দেখতে গিয়েছিল অলোক।  লোকের ভিড়ের মাঝে একটা জায়গা করে নিয়েছিল সে।উঁচু বাঁশের মাচা বাঁধা। এখান থেকেই ঝাঁপ দিতে হবে নীচে বঁটির উপর।এক সন্ন্যাসী মাচায় উঠে প্রস্তুত। একজন তার মাথায় গঙ্গার পবিত্র জল ছিটিয়ে দিল। উঁচু থেকে “বল্লো শিবো” বলে সন্ন্যাসী ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিল বঁটির উপর ।
অন্যদিকে কপালে,পেটে বাণ ফুঁটিয়ে সন্ন্যাসীদের নাচ।
অলোকের খারাপ লাগছিল।মেয়েকে নিয়ে স্বাধীনতা আসতেই পারত তার সঙ্গে। সেও অবশ্য একবার বলতে পারত,চলো গাজনের মেলা দেখে আসি।
ইচ্ছে করেই তাকে ডাকেনি অলোক। বৃথা কথা কাটাকাটি আর ভালো লাগে না। সেদিনের প্রসঙ্গ টেনে অপমানকর কথাবার্তা …….।
সেদিন কি যে হয়েছিল, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি অলোক।
জবা ঘুমোচ্ছিল।সুপ্রিয়া এক গাদা গোছানো জামাকাপড় নিয়ে ঘরে ঢুকেছিল।এলোমেলা চুল,ঘামে ভেজা ব্লাউজ,বুকের কাপড় সরে মাখনের মতো নরম বুক,বন্ধ ঘরের ফাঁক গলে দেখা মায়াবী চোখ…….কি যে হল অলোকের কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারল না।
জবাকে ডিঙিয়ে খপ করে ধরেছিল সুপ্রিয়ার ডান হাত। ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে দু’পা সরে গিয়েছিল সে। বিছানা থেকে উঠে অলোক তাকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেছিল।প্রথমে বেশ কয়েকবার আলিঙ্গনমুক্ত হতে চেয়েও নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি সুপ্রিয়া। বাড়িতে টাকা নেই,হাঁড়িতে চাল নেই,পিতৃহারা দুই নাবালক ছেলে….এই বাড়ির কাজটা খোয়ালে কি হবে —সুপ্রিয়া এসব ভাবনার মধ্যেই অলোকের খোঁচা দাঁড়িতে গালের জ্বালা আর তার ধারালো দাঁতের কামড়ে রক্তাক্ত শরীরে তীব্র ব্যথাটা অনুভব করেছিল সুপ্রিয়া।স্বাধীনতার ডাক শুনতে পেয়ে অলোকের কবলমুক্ত হবার চেষ্টা করতে করতে নিজেকে ছাড়িয়ে গুছিয়ে নিয়েছিল সে।তারপর ধীরে ধীরে দরজা খুলতে গিয়েছিল।
অলোকের তখন ভীষণ রাগ হচ্ছিল স্বাধীনতার উপর।সবে শিকার কাবু করেছে…..এখনই আসতে হবে? তবে টেনসানও হচ্ছিল।যদি সুপ্রিয়া সব বলে দেয় ভয় পেয়ে ! আবার ভয় হচ্ছিল — স্বাধীনতা মেয়েটাকে যদি কাজ ছাড়িয়ে দেয়,সে খাবে কি!সেই রাতে রাগে ধাক্কা মেরেছিল স্বাধীনতাকে।সারারাত সে বারান্দায় বসে বসে কেঁদেছিল। যা ইচ্ছে করুক,একটুকুও মায়া দেখায়নি সে।
স্বাধীনতা অনেক ভেবেছে। সুপ্রিয়া জবাকে সত্যিই ভালোবাসে। তাকে কাজ থেকে ছাড়ায়নি স্বাধীনতা।সুপ্রিয়ার মতো বিশ্বাসী লোক পাওয়াও মুশকিল। তবে ভাবেভঙ্গীতে সে বুঝিয়ে দিয়েছিল — একজন  নারী হয়ে আরেকজন নারীর সর্বনাশ করা উচিত নয়।

সুপ্রিয়ার খুব কষ্ট হয়েছিল স্বাধীনতার জন্য।সে ঠিক করেছিল — দিদিকে সে কোনদিন কষ্ট দেবে না।

বসন্ত পূর্ণিমা।বিছানার উপর সাদা জোছনার  ঢেউ। অলোকের মুখের উপর চাঁদের সাদা আলো। বড্ড কষ্ট হয় স্বাধীনতার ।বুকের ভিতরটা যেন চেপে ধরে আছে কেউ।ঘুম আসে না স্বাধীনতার। অনেক রকম চিন্তা মনে আসে। একবার ভাবে, অলোককে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো দরকার।এইভাবে বারে বারে শরীরী প্রেমের কবলে পড়ে কেন সে? এটা তো তার রোগ!  সে কি কিছুই বুঝতে পারে না? না সবটাই  তার অভিনয়?আদতেই সে একটা নোংরা,কামুক মানুষ।               মনের মধ্যে একটা ছটফটানি অশান্ত করে তোলে ওকে।অলোকের বউ হয়ে স্বাধীনতার কি আরো ধৈর্য দেখানো উচিৎ ছিল?
স্বাধীনতা কতবার ভেবেছে অলোককে সে খুব ভালবাসবে। ওর মনের সব কিছু বুঝে নেবে।কিন্তু মনে মনে চায়লেও অলোককে দেখলেই মনের মাঝে একটা তীব্র বিতৃষ্ণা গ্রাস করে। একটুও ভালো লাগে না তখন। আবার বিশ্বাসও হয় না ওকে।বাড়িতে কাজের লোক রেখেও শান্তি পায় না একটুও। এই অস্থিরতা আর কত সহ্য করা যায়!মেয়ে বড় হচ্ছে।ওরও তো বয়স বাড়ছে।

স্বাধীনতা ভাবে অলোককে ডাক্তার দেখানোর কথা বলবে আজ। মেয়ে বড় হচ্ছে।বাবার এই স্বভাব তাকে কষ্ট দেবে একদিন।অলোককে সুস্থ করতেই হবে।

খাওয়ার টেবিলে ভাত বাড়তে বাড়তে একবার আড়চোখে অলোকের অবস্থান দেখে স্বাধীনতা বলে,একটা কথা বলার ছিল।

অলোক অবাক,কি কথা?
—-ভাবছিলাম তোমাকে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাবো।
—–কেন আমি পাগল নাকি?
—–এটা তোমার ভুল ধারণা। সাইক্রিয়াট্রিস্ট কি পাগলরাই দেখায়?
—– আমি তো তাই জানি।আমার এক কাকুকে বহরমপুরে ড: হাসানের চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হতো।তিনি পাগল ছিলেন। আমি কিসের পাগল বল!
—- তুমি বোঝ না?
—- না বুঝি না?
ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে স্বাধীনতা। তুমি মেয়ে দেখলে যে আদেখলাপনা কর —-সেটা কি?
—- তুমি আমাকে স্ত্রী হিসাবে কি দিয়েছ?
—–কি দিই না তোমাকে?
—- তুমি আমাকে ভালোবাস না। ঘৃণা কর।
—– তুমি আমাকে বুঝতে পার না।
—-আমি যদি বলি তুমিই আমাকে বুঝতে পার না!
—–তবে সেটা ভুল হবে।

রাতে স্বপ্নে অলোককে দেখল স্বাধীনতা। একটা পাহাড়ে ওরা তিনজন উঠেছে। পাহাড়ের গায়ে সবুজ বনানী।একটা ঝর্ণার রূপালী জল গড়িয়ে পড়ছে পাথরের গা বেয়ে।পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ওরা তিনজন। নীল আকাশের নীচে ওদের সুখের  সংসার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *