উপন্যাসিকা। সূর্য শিশির। পর্ব-৫। ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

উপন্যাসিকা।
সূর্য শিশির।
পর্ব-৫।
ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

বাড়ি ঢুকতেই হামাগুড়ি দিয়ে এসে পায়ের গোছ জড়িয়ে ধরে তোতন। পাখির ছানার মতো মুখ তুলে তাকায় মায়ের মুখের দিকে। বুকের অতলে মুচড়ে ওঠে মধুরার। নিচু হয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নেয়। শিশুর ঠোঁট ফুলে ওঠে, কচি হাত বুলিয়ে উপলব্ধি করতে চায় এইটা কি ওর মা? কতদিন দেখেনি যেন! হঠাৎ মধুরার মনে হয়, দুদিন না দেখতে পেয়ে ছেলেটা কতো ব্যাকুল হয়েছে,কথা ফোটেনি, তবু যেন বলতে চাইছে -‘কোথায় গিয়েছিলে মা! তোমাকে না দেখতে পেলে আমার বুঝি কষ্ট হয় না!’- বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে মধুরার দু চোখের কোণে অশ্রু জমে। হায়রে অবোধ শিশু! মধুরা ভাবে, যে শিশু জন্মেই মাতৃহারা হয়,তার কষ্ট তাহলে কতখানি।শতমন্যু ঘরে ঢোকে। তোতনকে নিজের কোলে নিয়ে বলে-‘বাইরের জামা কাপড় চেঞ্জ করে নাও মধু। গিজার চালিয়ে দিয়েছি।স্নান করে নাও।আমি চা করছি। বিস্কুট দিয়ে খেয়ে নাও। তারপর একটু ঘুমিয়ে নাও।অনেকটা জার্নি করে এসেছো তো।’- মধুরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শতমের দিকে। কি অসীম সহ্য আর ধৈর্য্য শতমন্যুর! কি নর্মাল বিহেভিয়ার! শতমন্যু কি বোঝাতে চাইলো যে মধুরা উচ্ছন্নে যাক, জাহান্নামে যাক, কিচ্ছু যায় আসে না শতমন্যুর! পায়ের তলা থেকে একটা রাগ ক্রমশঃ যেন একটা কাঁকড়া বিছের মতো তার শরীর বেয়ে উঠে তার শিরদাঁড়াকে নাড়িয়ে,তার মাথার মধ্যে চাড়িয়ে যাচ্ছে। চোখ বুজে বিস্ফোরণটা সামলে নিলো মধুরা। বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে মাথার ওপর শাওয়ারটা চালু করে দাঁড়িয়ে র‌ইলো।
কৃত্রিম ঝর্ণার জল মাথা দিয়ে গড়িয়ে নামছে। গিজার বন্ধ করে দিয়েছে মধুরা। ঈষদুষ্ণ জল এখন স্নিগ্ধ শীতল। গড়িয়ে নামছে মসৃণ শরীরের মানচিত্র বেয়ে।চোখ বুজে জলের আলিঙ্গনে বুঁদ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মধুরা। তার দু চোখ বেয়ে ঝরে যাচ্ছে গঙ্গা যমুনা। ভালোবাসার নদীতে ভেসে যাচ্ছে নাকি বাৎসল্যের অমোঘ ক্ষরণে অসহায় এক মা জিতেই যাবে শেষ পর্যন্ত? নাঃ ,মধুরা প্রেম, বাৎসল্য কোনোটাই হারাতে রাজী নয়। চিরদিন তার‌ই ইচ্ছাশক্তির জয় হয়েছে। চোখের লোনা জল আজ কি সমুদ্রে জোয়ার আনলো?কেন আজ দেবর্ষি আর তোতনের মধ্যে তার চিন্তায় বারবার জায়গা দখল করে নিচ্ছে শতমন্যু? -‘কি হলো মধু?এক ঘন্টা ধরে স্নান করছো, ঠাণ্ডা লেগে যাবে তো! এবার বেরিয়ে এসো।’- শতমন্যু ডাকে মধুরাকে। মধুরা বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে। ভিজে চুপচুপে চুলগুলো মাথার উপর ব্যাকক্লিপ দিয়ে চুড়ো বেঁধে রাখা। টুপিয়ে জল ঝরছে। বৃষ্টিধোয়া যুঁই ফুলের মতো মুখটা কি নিষ্পাপ! শতমন্যুর মুগ্ধতা বিস্মিত হয়! কি আশ্চর্য আকর্ষণীয় নারী মধুরা! পাপ,পুণ্য, অপরাধ, ক্ষমা সব স-ব যেন মধুরার তানপুরার মতো শরীরে সরগমের সাত সুরে বাঁধা। শতমন্যু চা বিস্কুট দ্যায় মধুরাকে,আর সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো রাগটা আবার চাগিয়ে ওঠে মধুরার মাথায়। শতমন্যুর এই ভালোমানুষিকে ক্লীবত্ব বলে মনে হয় মধুরার। ছিঃ,এ কি একজন পুরুষমানুষ? কেন অধিকার ফলাতে পারে না শতমন্যু?কেন জিজ্ঞেস করবে না দুদিন তার বৌ কোথায় কাটিয়ে এলো?কেন শাসন করবে না! শতমন্যু তা’হলে নিশ্চয়ই আর তাকে ভালোবাসে না! খুব কি ঘৃণা করে! নাকি ভয় পায়! অশান্তির ভয়! সম্মানহানির ভয়! দ্বিধাহীন ভালোবাসা তো ছিলো শতমন্যুর মধ্যে! শতমন্যুকে পড়তে চায় মধুরা। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। শতমন্যু হঠাৎই প্রশ্ন করে -‘সত্যিই ভালোবাসো দেবর্ষি স্যারকে? আমি তবে বাধা হবো না তোমার। আর আমার তোতনের দায়িত্ব তো আমার‌ই। ‘- নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকে মধুরা। তার খরজিহ্বার ধার আজ শূন্য। কি উত্তর দেবে আজ মধুরা! ধীরে ধীরে নিজের ঘরে গিয়ে খাটে শুয়ে পড়ে মধুরা। স্যার তার দীর্ঘ জাগরিত দেহে ভরে দিয়েছে আকাঙ্খিত ঘুম। অনেক দিন পরে ঘুমোবে মধুরা। অমাবস্যার রাতের নক্ষত্রের মতো ঘুম লেপ্টে যাবে তার স্বপ্নালু দুই চোখে। যে স্বপ্ন নারীকে শুধুই প্রেমিকা হতে বলে। -‘নহ মাতা,নহ কন্যা,নহ বধু, সুন্দরী রূপসী!হে নন্দনবাসিনী উর্বশী!’-পুরুষের দুর্বলতার রন্ধ্রপথে প্রবেশের কৌশল তার মতো কুশলী নারীদের জানা আছে। পুরুষ নিজে মহৎ সাজতে গিয়ে ব্রহ্মাস্ত্র তুলে দিয়েছে নারীর হাতে। সে শতমন্যু‌ই হোক,বা দেবর্ষি! আলতো হাসি ঠোঁটে এঁকে ঘুমিয়ে পড়ে মধুরা। বড়ো দ্বিধাহীন সে ঘুম। বড়ো তৃপ্তির ঘুম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *