ধারাবাহিক গল্প :- জীয়ন কাঠি কলমে :- ছন্দশ্রী দাস দ্বিতীয় পর্ব

ধারাবাহিক গল্প :- জীয়ন কাঠি
কলমে :- ছন্দশ্রী দাস
দ্বিতীয় পর্ব

নিমিষা বসে বসে সেলাই করতে থাকে আর ঠাকুমার সাথে গল্প করতে থাকে। আচ্ছা ঠাকুমা তোমার নিজের বিয়ের কথা মনে আছে? দাদু কেমন দেখতে ছিল গো? আছে রে ,আমার তো একটু বয়সে বিয়ে হয় । তখন আমার 17 বছর বয়স আর তোর দাদু 27 বছরের জোয়ান মরদ। লম্বা-চওড়া চেহারা । তার পাশে আমি ছোট খাটো মানুষ। প্রথম প্রথম অত বড় লোকটাকে  খুব ভয় করত। খুব গম্ভীর ছিল তোর দাদু। স্কুলের মাস্টার ।পরে দেখলাম ভেতরটা রসে টইটম্বুর। সেই রসের ধারা পেয়েছিল তোর বাবা।
আচ্ছা ঠাকুমা বাবা যখন হয় তুমি কত বড় ছিলে?
আমার তো বিয়ের অনেক বছর পর তোর বাবা আমার কোলে আসে। সবাই ভেবেছিল আমার বুঝি আর বাচ্ছাই হবে না। আমার তো নাম হয়ে গিয়েছিল বাঁজা বৌ। বাড়ির কোনো শুভ কাজে আমাকে কেউ ডাকত না। তারপর কত ঠাকুর দেবতার কাছে মানত করে অপুকে পেয়েছিলাম। তা ভগবানের আমার সেই সুখ সহ্য হল না। অপু যখন ষোলো বছরের তখন তোর ঠাকুরদাদা মারা যায়। সেই থেকে একাএকা ছেলে বুকে করে মানুষ করেছি।
যখন বিয়ে হয়ে এলাম এই বাড়ি কত জমজমাট ছিল। একে একে সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। আমরা মা ছেলে একা এই শূন্যপুরী আগলে পড়ে রইলাম। অপু বড় হলো। চাকরী পেল। তার বিয়ে দিলাম। বাড়ি আবার ভরে উঠল। পাঁচ বছরের মেয়েটি রেখে দুদিনের আড়াআড়িতে ছেলে বউ চলে গেল ।সেই থেকে নাতনি বুকে করে এই পোড়ো বাড়িতে পড়ে আছি। এখন ভালোয় ভালোয় তোর একটা বিয়ে দিয়ে গতি করতে পারলেই আমার ছুটি ।
কে তোমাকে ছুটি দিচ্ছে ! আমি এখন বিয়ে করছি না।তুমি আমার কাছে থাকবে। আমি আরো লেখাপড়া শিখে চাকরি করব। তোমাকে রানীর হালে রেখে দেবো ।
তাদের কথার মাঝেই পিয়ন এসে বলে , চিঠির আছে নিমিষা ‌‌‌ মিত্রর নামে ।
নিমিষা এগিয়ে যায় দেখে একটা রেজিস্ট্রি চিঠি ।সহি করে চিঠি নিয়ে আসে । সে চিঠি খুলে পড়ে খুব অবাক হয়ে যায়। ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করে ,ঠামু অমলেন্দু মিত্র কে?
অমলেন্দু !কি জানি , কি লিখেছে চিঠিতে ?
লিখেছে অমলেন্দু মিত্র তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তার খুড়তুতো ভাই অপূর্ব কুমার মিত্র একমাত্র কন্যা নিমিষা মিত্রকে দান করিল ।তবে তার একটা শর্ত আছে ।সেই শর্তপালনে নিমিষা যদি রাজি থাকে তবে নীচের ঠিকানায় যেন যোগাযোগ করে।  12 old বালিগঞ্জ প্লেসে গিয়ে যেন দেখা করি ।
হ্যাঁ রে নিমি কি শর্ত দিয়েছে?
তা লেখেনি।লিখেছে যদি রাজি থাকি তবে এখানে যে ফোন নাম্বার দেওয়া আছে সেখানে ফোন করে দিন আর সময় ঠিক করে যেতে বলেছে। অমলেন্দু কে ঠামু? বালিগঞ্জ চলে গিয়েছিল তো বড় ভাশুর ঠাকুর। এই পুকুর বাগান জমিজমা বাড়ি ঘরদোর ,এই পরিবারের মানুষদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখে নি ।
কেন ঠামু?
উনি ছিলেন ফিজিক্সের অধ্যাপক। বিদেশের নানা জায়গায় গিয়ে পড়াতেন। সেই সময় একজনকে ভালবাসেন ।তার সহকর্মী ছিলেন। কিন্তু জাতে আলাদা বলে শ্বশুরমশাই বিয়ের অনুমোদন দেননি। তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে ওই ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করেন। তারপর বালিগঞ্জে থাকতেন এইটুকু জানি। কারো সাথে যোগাযোগ রাখতেন না। হঠাৎ কি হলো সব সম্পত্তি দান করলেন , তাও আবার শর্তসাপেক্ষে !
দেখা যাক কি হয় আমাদের দুজনের নিস্তরঙ্গ জীবনে  বেশ একটা চমক এলো  বলো !
হ্যাঁ তা বলতে পারিস … সোমালি উঠে রান্নার কাজে চলে যায়। দুজনের রান্না ,একটু ভাত ডাল ফুটিয়ে নিলেই হয়ে যায়।
দুপুরে সোমালিবুড়ি কাঁথা সেলাই করতে করতে নিমিষাকে বলে, তাহলে ওখানে কবে যাবি বলে ঠিক করলি?
ভাবছি সামনের রবিবার যাব ।যাবার আগে ফোন করতে বলেছে ।তুমি সেদিন হাতে কোন কাজে রেখো না ঠাম্মি। আমার বয়স হয়ে গেছে কোথাও বের হই না তো ,তাই অত রাস্তার ধকল সহ্য করতে পারবো না। তুই বরং গৌর কে নিয়ে যাস।
না আমি একাই যাবো। এটা আমাদের সম্পূর্ণ পারিবারিক ব্যাপার। আর উনি হয়তো বাইরের কোনো লোক পছন্দ নাও করতে পারেন।
তুই পারবি একা যেতে। চিনতে পারবি তো রাস্তা। আজকাল সব কিছু অনেক সহজ হয়ে গেছে এই স্মার্টফোনের যুগে। তোমার এত কষ্টের টাকায় কেনা ফোনটা কি এমনি পড়ে থাকবে !এসব দিনে কাজে দেবে বলেই না কেনা ।এখনো তুমি এর টাকা শোধ করে উঠতে পারোনি ।
ঠিক শোধ করে দেব ভাবিস না।আর আমি কিছু ভাবি না ।সবকিছু আমি কালের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। সে যেমন ভাবে নাচাবে তেমনি নাচতে হবে। তুমি আমি কে জীবন চালানোর জন্য !
রবিবার সকাল সকাল বেরিয়ে যায় নিমিষা। তাদের বাড়ি থেকে বালিগঞ্জ বেশ অনেক দূর। যেতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক লাগবে। অমলেন্দু মিত্র দেখা করার সময় দিয়েছেন সকাল দশটা। তাই নিমিষা ঠিক করেছে গিয়ে না হয় একটু অপেক্ষা করবে। নিজেকে প্রস্তুত করার সময়ও তো চাই ।
সারাটা রাস্তা চিন্তা মুক্ত থাকার জন্য তাঁর প্রিয় গান শুনতে শুনতে যায়। দুচোখ মেলে ট্রেনের মানুষজনের আচরণ লক্ষ্য করতে থাকে। মাঝে মাঝে গান বন্ধ করে যাত্রীদের আলাপচারিতা,দুপাশের বদলে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে থাকে।
মোবাইল ফোনে রুট ম্যাপের দৌলতে সে সঠিক বাড়িতে পৌঁছে যায় । বাড়ির নাম বড় অদ্ভুত। ‘ ল্যাবক্যাব ’। তারপর ভাবে বড়লোকের কত রকমের খেয়াল। এই নাম তার অঙ্গ। নিমিষা সাড়ে নটার সময় পৌঁছয় ল্যাবক্যাবে।
বন্ধ গেটের কাছে গিয়ে নিজের নাম, পরিচয়, আইকার্ড ও তারসাথে অমলেন্দু মিত্রর রেজিস্ট্রি করা চিঠিটা দেখাতে তবে বাড়িতে ঢোকার ছাড়পত্র পায়। ঢোকার সময় তার   পুরো বডি চেক করা হয়। তারপর সে বাড়িতে প্রবেশ করার ছাড়পত্র পায়।
সবুজ ঘাসের লন পেরিয়ে মূল বাড়ির দিকে এগোতে থাকে ।বিশাল বাড়ি যেন এক সাদা রাজহংসের মত সবুজ ঘাসের পুকুরে ভেসে আছে। নিমিষা বাড়ির গঠন শৈলী দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। সে হাঁ করে চারিদিক দেখতে থাকে। কিন্তু তার তন্ময়তা বেশিক্ষণ থাকে না। কুকুরের বিকট চিৎকারে তার মন বাস্তবে ফিরে আসে।
দেখে লনের একপাশে দুটো বিশাল হাউন্ড চেন দিয়ে বাঁধা। তাকে নতুন দেখে তারস্বরে চিৎকার করছে ও চেন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।
রাজহাঁসের মতো বাড়িটা থেকে একজন বেরিয়ে এসে বলে , ববি টবি নো সাউট।উনি বসের ডাকে এসেছেন। উনাকে চিনে নাও। আর কখনো উনাকে দেখে চিৎকার করবে না।
ওই ভদ্রলোক, ভদ্রলোক না বলে ছেলে বলাই ভাল কতই বা বয়স হবে! নিমিষার থেকে কয়েক বছরের বড়। বড়ো জোর 24 -25 বছর বয়স।
নিমিষাকে বলে , নমস্কার আমি উজান। আপনি স্যারের চিঠি পেয়ে এসেছেন তো! আমি স্যারের সেক্রেটারি।
হ্যাঁ আমি নিমিষা। উনি আমাকে এই চিঠি দিয়েছিলেন। উজান নিমিষার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়ে দেখে। তারপর আবার তার হাতে ফেরত দিয়ে বলে, এখনও দশটা বাজতে দশ মিনিট বাকি ।আপনি ভেতরের ড্রইংরুমে বসুন।
নিমিষা এসে বসতে উজান জানতে চায়,কি দেব! ঠান্ডা না গরম ।
নিমিষার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। তাই বলে ঠান্ডা জল ।
উজান একটা বেল বাজায়। সাথে সাথে একজন মহিলা ঘরে ঢুকলে তাকে বলে , এনার জন্য ঠান্ডা জল আর ফ্রুটজুস পাঠিয়ে দাও ।
ঠান্ডা জল আর ফ্রুটজুস খেয়ে নিমিষার মনে একটু শান্তি আসে। সে দেখে দশটা বাজতে মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। সে নিজেকে মনে মনে তৈরি করে নিতে চায়। তখনই ডাক আসে ভেতর থেকে দেখা করার।
উজান তাকে নিয়ে ভিতরের একটা ঘরে যায়। ভারী পর্দা ঠেলে দুজনে প্রবেশ করে। বেশ বড় ঘরের মাঝখানে একটা অর্ধ গোলাকৃতি টেবিল। ঘরের সব জানালা পরদা দিয়ে ঢাকা। খুব সুন্দর করে সাজানো ঘরের এক কোণে পুরনো আমলের কাজ করা ঘড়ায় রজনীগন্ধা সাজানো। টেবিলে একগুচ্ছ লাল গোলাপ, কিছু ফাইল । পেছনের আলমারিতে বই আর ফাইলপত্র রাখা । টেবিলের ওপারে যিনি বসে আছেন তার সামনে একটা ল্যাপটপ খোলা তার চোখ সেদিকে।
নিমিষা বোঝে ইনিই অমলেন্দু মিত্র। বয়স আশি পেরিয়ে গেছে ।মাথায় চুল আছে তবে সব সাদা। দীর্ঘ নাসা, উজ্জ্বল তীক্ষ্ণ চোখ ,চাপা ঠোঁট, গৌরবর্ণ ,স্বাস্থ্য ভালো। লম্বা কত বসে থাকার জন্য বুঝতে পারেনা।
ঘরে ঢুকেই নমস্কার পর্ব শেষ করেই দুই মিনিটে নিমিষা সবকিছু জরিপ করা হয়ে যায়। অমলেন্দু একটা মেরুন রঙের পাঞ্জাবি পড়েছিলেন ।তলায় কি পড়েছেন তা দেখা যাচ্ছে না ।আর বাঁ হাতের ঘড়িটা যথেষ্ট দামি ।মনে হয় বিশেষ কায়দায় তৈরি। আঙুলে বেশ কয়েকটা দামি পাথরের আংটি।
নিমিষা নমস্কার জানিয়ে চুপ করে বসে থাকে পরবর্তী নির্দেশ পাওয়ার অপেক্ষায় ।
একটু পরেই অমলেন্দু বলেন, তুমি নিমিষা মিত্র। মুকুন্দপুর থেকে এসেছো?
হ্যাঁ স্যার ।
পথে কোন অসুবিধা হয়নি তো ?
না, পথে কোনো অসুবিধা হয়নি। নিমিষা মৃদু হেসে বলে, আমি আমার সব অসুবিধার সাথে চলতে অভ্যস্ত। তাই  অসুবিধা কিভাবে কাটাতে হয় জানি। আর বর্তমান যুগে স্মার্টফোনের বিভিন্ন অ্যাপের দৌলতে যে কোন অচেনা জায়গায় চলে যাওয়া যায় যদি মনে সাহস আর উদ্যম থাকে।
বেশ-বেশ। তুমি কী পড়ো ?
নিমিষা বলে, আমি ফিজিক্স অনার্স নিয়ে পড়ি।
তাহলে এবার আসল কথায় আসি। আমি অমলেন্দু মিত্র ফিজিক্সের প্রফেসর ছিলাম আর নানা বিষয় নিয়ে রিসার্চ করতাম। আমার পেপার সাবমিট করলে তা গ্রান্টেড হয়। আমার আবিষ্কৃত মোটর এখন বহুল প্রচলিত। আমি আমার পেটেন্ট বিক্রি করে দিই তাতে আমি কয়েক কোটি ডলারের মালিক ।
নিমিষা বলে, আপনার সন্তানরা সেই অর্থের মালিক হবে আপনার অবর্তমানে। এটাই নিয়ম। আপনি আপনার বহু কষ্টার্জিত অর্থ আমাকে শর্ত পালনের মধ্য দিয়ে দান করতে চান কেন সেটা বুঝলাম না?
একটা গাড়ি এক্সিডেন্টে আমার স্ত্রী পুত্র সবাই মারা যায়। শুধু বেঁচে থাকে আমার একমাত্র নাতি ।কিন্তু সারা শরীরে চোট পাওয়ার ফলে সে শয্যাশায়ী। তাকে সব কাজ করিয়ে দিতে হয়। এমনকি সে কথাও বলতে পারে না। খুবই দুঃখের ব্যাপার। সম্পত্তির ব্যাপার বাদ দিলে আপনি আমার সম্পর্কে বড় দাদু হন। আর আমি ও আপনার নাতি ভাই-বোন ।সেই সুবাদে আমি কি তার সাথে দেখা করতে পারি ?আসলে আমার এই এত বড় জীবনে আমার কোন আত্মীয় স্বজনের সাথে পরিচয় হয়নি। সবাই ওই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। কেউ আর কখনো ফিরে আসেনি। ওই ভাঙা পোড়ো বাড়ি জমি আমি আর ঠামু দুজনে আগলে আছি ।
অবশ্যই দেখা করতে পারো, তোমার সে অধিকার আছে। আমি এখনো আমার আসল কথায় যাইনি । এবার তা বলি …..
হ্যাঁ বলুন …..
আমি আমেরিকা থেকে এখানে ফেরত চলে এসে নিজের বাড়িতেই একটা ল্যাবরেটরি তৈরি করি রিসার্চের জন্য। আমার সেই স্বপ্ন সফল হবার পথে। হঠাৎ আমার মনে হলো এই যে আমি এত টাকা পয়সা উপার্জন করলাম কার জন্য? এর তো কোনো দাবিদার নেই ।আমার নাতি বড়জোর দু তিন বছর। তারপর এইসব টাকা পাঁচ ভূতে লুটে খাবে। আমি চাইনা আমার কষ্টার্জিত টাকা ঐসব অসাধু সরকারি নেতারা ভোগ করুক ।তাই আমি অনেক খোঁজ খবর করলাম আমার সব ভাই-বোনেদের।তাদের ছেলেমেয়ের  লিস্ট তৈরি করলাম। দেখলাম তাদের সবার ছেলেমেয়ে মিশিয়ে এখানে আছে 10 জন।
আমি তখন 10 জনের নাম ঠিকানা জোগাড় করে প্রত্যেককে ডেকে পাঠাই। তারা সবাই আসে দেখা করে আমার সাথে। সবাই রাজি হয়ে যায় । এখন বাকি আছো তুমি ……
কি আপনার শর্ত ?
আমার শর্ত হলো ছয়মাস সবাইকে একসাথে আমার বাড়িতে থাকতে হবে। তারা এই বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে না আমার পারমিশন ছাড়া। এই ছয় মাস আমি তোমাদের সবাইকে কিছু টাস্ক দেব। সেইসব টাস্ক সফলভাবে করতে পারবে তাদের মধ্যে থেকে যাকে আমি উপযুক্ত বলে মনে করব তাকেই আমি আমার সব সম্পত্তি দিয়ে যাবো। অবশ্য যতদিন আমার নাতি বেঁচে থাকবে ততদিন সম্পত্তির উত্তরাধিকারী আমার নাতি রাহুল।
কিন্তু স্যার আমি তো কলেজে পড়ি। আমি যদি এখানে এসে থাকি আমার পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। আর আমি চাইনা আমার পড়া বন্ধ হোক। অনেক কষ্ট করে ঠামু আমায় বড় করে তুলেছে। আমিও চাই লেখাপড়া শিখে ভালো চাকরি পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে ।ঠামুর মুখে হাসি ফোটাতে। তাকে দুঃখ কষ্টের হাত থেকে মুক্তি দিতে।
মাত্র ছয়মাস। তার মধ্যে তুমি যদি সফল হতে পারো এই বিশাল সম্পত্তি তোমার।তখন তোমার কোনো অভাব থাকবে না। তাছাড়া তুমি এখানে থেকেও পড়া চালিয়ে যেতে পারবে। আমি সব বন্দোবস্ত করে রেখেছি ।
নিমিষা হেসে ফেলে বলে, আপনি কি করে এতটা নিশ্চিত হলেন আমি আমার গ্রাম ছেড়ে চলে আসবো ঠামুকে একা ফেলে রেখে !!
নিশ্চিত হইনি ,শুধু আগে থেকে বন্দোবস্ত করে রেখেছি। নিমিষার কথাতে অমলেন্দু সামান্য ধাক্কা খান ।
পড়ার সমস্যা মিটলেও আমার আর একটা সমস্যা থেকে যায় …..
কি সমস্যা ?
আমি চলে এলে অত বড় বাড়িতে ঠামুকে একা থাকতে হবে। তার বয়স হয়েছে।যদি অসুখ-বিসুখ হয় কে দেখবে? আমি ছাড়া তো কেউ নেই ।
কেন তোমার গৌরদাদা দেখবে । সেই তো এতকাল তোমাদের দেখে আসছে। আর রাতে না হয় বিমলাকে বলবে তোমার ঠামুর সাথে শুতে। তাহলেই তো হবে ।
নিমিষা বোঝে অমলেন্দু মিত্র অনেক আগেই তার সম্বন্ধে সব খবর জোগাড় করে আটঘাট বেঁধেই কাজে নেমেছেন। তার কাদের সাথে ওঠাবসা সব তার মুখস্ত। নাহলে এত তাড়াতাড়ি সে কি করে বলল বিমলা ঠামুর সাথে শোবে! তবুও নিমিষা মুখে হাসি এনে বলে, মুখে বলা যত সহজ , কাজে করা তত সহজ নয়। ভালোবাসার টান যাবে কোথায়?
ভালোবাসার জন্য তুমি একটা অ্যাডভেঞ্চারাস লাইফ হাতছাড়া করবে !আমি তোমাকে তেমন মেয়ে ভাবি নি। নিমিষা স্থির চোখে অমলেন্দুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, এভাবে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে কোন লাভ নেই। আমার মন না চাইলে আমি সেই কাজ করিনা। তবে আমাকে ভাবতে সময় দিন।
অমলেন্দু বলে, বেশ তুমি ভাবো। তোমার হাতে মাত্র সাতদিন সময়।সামনের মাসেই সবাই চলে আসবে।
নিমিষা উঠে দাঁড়িয়ে বলে ,আমি আমার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে পারি !
অবশ্যই আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি, বলে অমলেন্দু নিমিষাকে নিয়ে বিশাল বাড়ির ভিতর প্রবেশ করেন। তিনি একটি ঘরে আসেন বাইরে থেকে ডাকেন রাহুল রাহুল বেটা তোমার সাথে দেখা একজন করতে এসেছে। বলে পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন ।
রাহুলকে এক ভদ্রমহিলা  কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করছিলো। কিন্তু রাহুল কিছুতেই খাবেনা ।অমলেন্দুর সাথে নিমিষাকে দেখে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে । তার ঠোঁটদুটো নড়ে ওঠে ।নিমিষা বোঝে, রাহুলের ব্রেন কাজ করে ।মিষ্টি হেসে সে তার হাতটা হাতে নিয়ে বলে হাই রাহুল আমি তোমার বোন হই । আমি নিমিষা। রাহুল নিমিষার হাতটা মুঠোয় নিয়ে আবার ঠোঁট নাড়ে।
নিমিষা ভালো করে পড়ার চেষ্টা করে । তারপর ঐ মহিলাকে বলে ,আমি যদি খাইয়ে দেই আপনার আপত্তি আছে?
মহিলা অমলেন্দুর দিকে তাকান ।অমলেন্দু ঘাড় নাড়াতে মহিলা বাটি রেখে বাইরে চলে যান ।নিমিষা অমলেন্দুর দিকে ঘুরে বলে আমি রাহুলের সাথে একটু একা থাকতে চাই।
অমলেন্দু তীব্র চোখের তাদের দিকে তাকিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যান। খাবারের বাটি হাতে করে রাহুলের সাথে গল্প করতে থাকে। রাহুল তোমার মত আমারও ঠামু ছাড়া আর কেউ নেই ।এতদিন আমি জানতাম না যে রাহুল বলে আমার এক দাদা আছে। আমি তোমাকে দাদাভাই বলে ডাকবো ।কি ডাকবো তো!
রাহুল ঠোঁট নাড়ায়। নিমিষা তার ঠোঁট নাড়ানোর ভঙ্গি খুব ভালো করে লক্ষ্য করে। ওর যেন মনে হলো রাহুল বলল বোন আমার।
নিমিষা বলে , দাদাভাই আজ আমি প্রথম এলাম এই বাড়িতে। তুমি আমার হাতে খাবেনা! রাহুলের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকে নিমিষা।
মনে হয়  রাহুল বলল ,না খাবো না …
নিমিষা আবারো তার মুখের কাছে বাটি শুদ্ধ খাবার নিয়ে যেতে গিয়ে হাত ফস্কে বাটি মাটিতে পড়ে যায়। নিমিষা ভীত হয়ে ওঠে । নিমিষা দেখে রাহুলের মুখে খুশির হাসি ছড়িয়ে পড়ে ।বাটি পড়ার শব্দে বাইরে থেকে রাহুলের দেখাশুনা করে যে মহিলা তিনি ঘরে ঢুকে খাবারটা পড়ে  থাকতে দেখে রেগে যান ।বলেন কী দরকার ছিল খাওয়াতে যাবার পারোনা যখন। এখন আমি কি করি?
নিমিষা বলে , আমি আবার খাবার বসিয়ে দেবো আন্টি। তুমি কেন করবে আমি করে আনছি। তুমি জান না কিভাবে করতে হয়।
আপনি দেখিয়ে দিলেই পারবো ।
আর ততক্ষণ রাহুলদাদা একা থাকবে নাকি? তুমি জানো না এসব পেশেন্টদের একা রাখতে নেই ।
বাইরে থেকে উজান ঢুকে বলে, ততক্ষণ আমি আছি রাহুলের কাছে ।
ভদ্রমহিলা দুজনের দিকে কটমট করে তাকিয়ে নিমিষাকে নিয়ে বেরিয়ে যান । নিমিষা খাবার করে নিয়ে এসে রাহুলকে খাওয়াতে রাহুল পুরো খাবার খেয়ে নেয়। নিমিষা রাহুলের সাথে কথা বলতে থাকে।রাহুল তার কথা শুনে হাসে ঠোঁট নাড়ায়। নিমিষা কখনো বোঝে,  কখনো বোঝে না ।তবু সে কথা চালিয়ে যায়। ঐ মহিলা যার নাম সবিতা শুধু নিমিষার  দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন। রাহুলের খাওয়া হয়ে যেতে সবিতার সাহায্যে তাঁকে শুইয়ে দেয় বিছানায় ।তার পর মাথায় হাত বুলিয়ে গল্প করে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
সবিতা বলে ,তুমি ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিলে !ওষুধ খাবার ছিল।
নিমিষা বলে আমি বুঝতে পারি নি দাদাভাই ঘুমিয়ে পড়বে। একদিন ওষুধ না খেলে কিছু হবে না ।
তোমার মত আমাকে চলতে হবে নাকি ? এসব পেশেন্টদের কোনো ওষুধ মিস করা যায় না।আমি এখনই স্যারকে রিপোর্ট করছি ,বলে চলে যায়।
নিমিষা রাহুলের ওষুধপত্র নেড়েচেড়ে দেখে। কিছু বোঝেনা ।
খানিক পরে সবিতা ফিরে এসে বলে , স্যার তোমাকে ডাকছেন নিচে যাও।
নিচে আসলে অমলেন্দু বলেন ,এসো আমরা একসাথে লাঞ্চ করি ।সবিতা বলছিল তুমি রাহুলকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছ। খুব ভালো কথা । কিন্তু ওর তো ওষুধ গুলোও খেতে হবে, নাহলে ওর শরীর ঠিক থাকবে কি করে!
আমি বুঝতে পারিনি ,আর কখনো ভুল হবেনা ।কবে থেকে এখানে এসে থাকতে হবে আমাকে?
অমলেন্দু বলেন, সামনের মাসের পয়লা তারিখ থেকেই থাকতে হবে। সেইমতো প্রস্তুতি নিয়ে এস ।
ক্রমশঃ
**************

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *