এক টুকরো কাগজের আত্মকাহিনী ***** মিতা ঘোষ

এক টুকরো কাগজের আত্মকাহিনী
মিতা ঘোষ
………………..
আমি এক টুকরো কাগজ। আজ পড়ে আছি এক কোণে, আবর্জনার স্তূপে, চারপাশে নোংরা, দুর্গন্ধ আর অবহেলার ছায়া। কেউ আমার দিকে তাকায় না, আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে মানুষ মুখে রুমাল চাপা দেয়, কখনো থুথুও ফেলে। আমি নতমস্তকে চুপচাপ শুয়ে থাকি। অথচ এমন দিনও ছিল, যখন আমাকেই কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো জগতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ। আজ আমার গায়ে ময়লা, তবে ইতিহাসের পাতায় আমার স্পর্শ অমোচনীয়।
ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। ছোট ছোট শিশুদের হাতে আমি তখন আশীর্বাদের মতো। আমার বুকেই আঁকা হয় প্রথম অক্ষর—অ আ ক খ, A B C D। আমার উপর ভর করেই তারা শেখে, বেড়ে ওঠে, ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে তাদের জ্ঞানের ভিত। আমিই হয়ে উঠি শিক্ষার প্রথম সোপান। পেন্সিলের আঁচড়ে যখন প্রথমবার তারা অক্ষর গেঁথে যায়, আমার হৃদয় তখন আনন্দে নেচে ওঠে।
তারপর সময় গড়ায়। শিক্ষার্থীরা বড় হয়, আর আমিও পাই নতুন ভূমিকা। কখনো পরীক্ষার সময় গোপনে আমায় কেটে তৈরি করা হয় চোতা, সূক্ষ্ম অক্ষরে লেখা ছোট্ট টুকরো। সেই লেখায় গোপন থাকে উত্তর—উত্তীর্ণ হবার আকাঙ্ক্ষা। একটুখানি মুঠোয় করে নিয়ে যায় আমায়, আঙুলের ফাঁকে রাখে, ভয় আর আশার মাঝে আমার বুক কাঁপে। আমি সাক্ষী হই নিষিদ্ধ চেষ্টার, কিন্তু সেই চেষ্টার পেছনে যে থাকে সীমাহীন চাহিদা, সামাজিক চাপ—তা আমি বুঝি।
আমিই সেই কাগজ, যার বুকের উপর লেখা হয় “আই লাভ ইউ”। কখনো নিঃশব্দে পৌঁছে যাই কারো প্রেমিকার কাছে, কখনো লুকিয়ে থাকি ডায়েরির ভাঁজে। একটা চিরকুট, একটা কবিতা—যা লেখা হয় ভালোবাসা দিয়ে, বিশ্বাস দিয়ে—আমার হৃদয়ে সেই অনুভূতিগুলো চিরস্থায়ী হয়ে যায়। প্রেমের জন্ম হয় আমার অক্ষরে, সম্পর্ক গড়ে ওঠে, অনেক সময় আমি সেই সম্পর্কের প্রথম সেতু।
কিন্তু শুধু সুখের বাহক আমি নই। আমি বয়ে আনি দুঃসংবাদও। হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনা, মৃত্যু সংবাদ, বিচ্ছেদের ঘোষণা—আমার বুকেই প্রথম লেখা হয়। একটা কাগজেই লেখা থাকে চাকরি হারানোর খবর, রোগ নির্ণয়ের রিপোর্ট, বিচ্ছেদের আইনি দলিল। এক লহমায় ভেঙে যায় জীবনের সাজানো সংসার, গড়ে ওঠে শূন্যতা আর বেদনার স্তম্ভ।
আমার অবস্থান অফিস ও আদালতেও গুরুত্বপূর্ণ। আমাকে ফাইলের মধ্যে যত্নে সাজিয়ে রাখা হয়। আমি সাক্ষ্য দিই নানা মামলার, চুক্তির। আমার গায়ে লেখা হয় আইন, আদালতের আদেশ। কোনো এক বিচারের রায়ে যখন আমার বুকের উপর লেখা হয় “মৃত্যুদণ্ড”, তখন আমি শিউরে উঠি। কলম ভেঙে ফেলে বিচারক, কিন্তু আমার হৃদয় ফেটে যায়। আমি ভাবি, “এই সিদ্ধান্ত কি সত্যিই ন্যায়সঙ্গত?” অথচ আমার কিছুই করার নেই। আমার বুকে লেখা কয়েকটি শব্দই কারো জীবনের শেষ বিন্দু।
আমার গর্ব হয় যখন কবি-সাহিত্যিকেরা আমার বুককে করে তোলেন কল্পনার ক্যানভাস। সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ, প্রতিবাদ কিংবা নিঃশব্দ স্বপ্ন—সব কিছুই আমায় ব্যবহার করে গেঁথে রাখেন শব্দে শব্দে। আমি হয়ে উঠি সাহিত্যিকের প্রাণ, কবির আত্মা। কখনো আমি কবিতা হয়ে পাঠকের চোখে জল এনে দিই, কখনো গল্প হয়ে হাসি ফোটাই। ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতি—জগতের যাবতীয় চিন্তা আমার বুকেই লিপিবদ্ধ হয়।
পৃথিবীর নানা প্রান্তে যাঁরা জ্ঞানচর্চায় অনন্য, গবেষণায় যুগান্তকারী, সাহিত্যকর্মে অনবদ্য—তাঁদের অনেকেই আমার উপর লিখেই পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। আবার আমাকেই ব্যবহার করে তৈরি হয় বই, পুস্তক, মহাগ্রন্থ—যা যুগের পর যুগ ধরে সংরক্ষিত হয় গ্রন্থাগারে। আমার পৃষ্ঠায় লেখা থাকে সভ্যতার ইতিহাস, ভাষার বিবর্তন, মানুষের ভাবনা।
তবুও, এত কিছু সত্ত্বেও, যখন আমি ছিঁড়ে যাই, অপ্রয়োজনীয় মনে হই, তখন আমায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় ডাস্টবিনে। মুহূর্তেই আমার মূল্য শূন্যে নেমে আসে। আমায় কেউ আর মনে রাখে না।
তবে আমি অভিমানী নই। আমি জানি, মানুষের জীবনও ঠিক তেমন। শিশু অবস্থায় তাকে লালন করা হয়, যৌবনে সে পূর্ণতা পায়, প্রৌঢ়ত্বে তাকে ঘিরে থাকে দায়িত্ব আর সম্মান। কিন্তু বার্ধক্যে এসে অনেকেই ভুলে যায় তার অতীত অবদান। কেউ কেউ পড়ে থাকেন একাকীত্বে, অবহেলায়। আমার জীবনের সঙ্গেও এই মিলটাই সবচেয়ে বড় সত্য।
আমি জানি, আমার জীবনের শেষ নয় এখানেই। একদিন কেউ আমায় কুড়িয়ে নেবে। হয়তো সেই ব্যক্তি আবার আমার বুকে লিখবে নতুন কোনো স্বপ্ন, কোনো ইতিহাস, কোনো ভালোবাসা। আমি তখন আবার বাঁচব। আবার ফিরব আলোয়, ভাষায়, হৃদয়ে।
আমি এক টুকরো কাগজ। নীরবে, নিরবে আমি প্রতীক্ষা করি—নতুন কোনো স্পর্শের, নতুন কোনো আশার।