[] এই আমি [] — রঞ্জিত চৌবে।

[] এই আমি []
— রঞ্জিত চৌবে।

এক-একটা দুপুর এক-এক রকম…….,

চৈত্রের এই দাবদাহ কি নিদারুণ সহ্য ক্ষমতায় সহ্য করে যাচ্ছে ছাতিমের সবুজ পত্র-পল্লব। খাঁ খাঁ দুপুর..। একটি একানে গরীব কুঁড়েঘর নিজের দূর্ভাগ্যকে গতজন্মের অভিশাপ ভেবে কুণ্ঠিত হয়ে ঝিমোচ্ছে। দূরের ছাতে চিলে কোঠার ছায়ায় দাঁড়িয়ে বছর ষোলোর একটি মেয়ে কাকে যেন অতি সন্তর্পণে ফোন করে যাচ্ছে। গায়ে জলরঙের কুর্তি…হয়তো বা কোনও ছেলে বন্ধু হবে। বড় রাস্তার ওপারে সিমেন্টের গুদাম। চার পাঁচটি লোক মিলে একসাথে ট্রাক থেকে সিমেন্ট খালি করছে। দুপুর বড্ড ঝাঁঝালো… নিথর পুকুরে হঠাৎ হঠাৎ করে ফোলুই মাছ পেট উলটে জলের তলায় ডুব দিচ্ছে। একটা ডাহুক পাখি সরু সরু কাঠির মত সাবধানী পায় স্ফটিকের মত স্বচ্ছ চোখে খাবার খুঁজতে বেরিয়েছে।

আমি, রঞ্জিত চৌবে নির্জীব ভাবে পড়ে আছি বিছানায়। পাশে পড়ে আছে মুঠোফোন। তার পেট ভর্তি অজস্র কথা। ইউটিউব, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম আরও কত কিছু। সে সবের ভেতরে প্রেম প্রতিবাদ কান্না যন্ত্রণার কত ইতিহাস অপেক্ষা করছে আমি কখন খুলে দেখব। হাতে অখণ্ড সময়। অথচ আমার কিছুই দেখতে ইচ্ছে করছে না।

একটা সময় দুটো কবিতা লিখতাম, পড়তাম অজস্র লেখা। ভাই বোন বন্ধুতে ভরপুর সে জগৎ হঠাৎই কেমন ম্যাড়মেড়ে লাগছে। এখন আর ইচ্ছে করে না পড়তে লিখতে। যারা সব দারুণ দারুণ লেখা লিখে ফেসবুক মাতিয়ে রাখতো, সেই সব কলমও যেন নিরুদ্দেশে নাম লিখিয়েছে। অথচ হৈচৈ বেড়েছে। সমস্তই কেমন যেন কাঠ কাঠ নিষ্প্রাণ। প্রতিবাদের ভাষায় গালাগালি। প্রেমের ভাষায় আর শতদল ফোটে না।সব যেন নিয়মমাফিক।

যদিও এই লেখাটি আমাকে ফেসবুকেই পোস্ট দিতে হবে..

জীবনে, সমাজে এক একটা সঙ্কট আসে যখন জীবন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। হারিয়ে যায় জীবনের সমস্ত সান্দ্রতা। এই যে প্রায় ছাব্বিশ হাজার ছেলে মেয়ের চাকরি চলে গেল। শুনছি আবারও পঁয়ষট্টি হাজারের চাকরি যাবে.. সেখানে এমন একটি মাধ্যমে সহমর্মিতার ভাষা কই। এসময় যখন প্রচন্ড মন খারাপ, বুক ভর্তি কান্নার জমাট পাথর তখন দুঃখ কোথায় ! প্রতিবাদের আড়ালে অভিসন্ধি ওঁৎ পেতে আছে যেন। সকলেরই পাখির চোখ ক্ষমতার ওলিন্দে। মাঝখান থেকে আমাদের মত সাধারণ, যাদের দিন এনে দিন খাই অবস্থা আমাদের তো খুব বেশি কিছু চাইনা। আমরা তো কাউকে দোষারোপ করিনা। এই যে আমি রঞ্জিত চৌবে, আমার সরকারি কোনও চাকরি নেই। এমনকি এই মুহুর্তে বেসরকারি কোনো কাজও নেই।অথচ আমার স্ত্রীর অসুখ আছে, মেয়ের জন্য প্রতিমাসে একটি নির্দিষ্ট খরচ আছে, আছে সারামাসে দুমুঠো নুনভাতের খরচ। সেই আমিই ফেসবুকে আসি একটু খানি মুক্তির আশায়। সেখানে আপনাদের খিল্লি, অভিসন্ধি দেখতে দেখতে আর ইচ্ছে করে না ফেসবুকে আসতে। ছোট্ট একটি জায়গা, সেটাও দখল হয়ে যাচ্ছে। আমরা যে ক্রমশ বন্দী হয়ে যাচ্ছি, সে কথা কার কাছে জানাবো, কে শুনবে ?

চৌবে…. বাঙালি হিসেবে বড্ড বেমানান এই পদবী। অথচ মনে প্রাণে আমি নিজেকে বাঙালি বলেই গর্ব করি। কবে কোন এক চৌবে তার ভাইপো কে নিয়ে এদেশে বসত গেড়েছিল তার কোনও লেখাজোকা নেই। পদবী ধরে অনুমান করি মধ্যভারতের কোথাও থেকে এদেশে এসেছিল। কেন এসেছিল জানা নেই। তবে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে জেনেছি আমার জন্ম আদ্যন্ত একটি চাষি-বাসী পরিবারে। যদিও বাবা কাকা দুজনেই ইন্ডিয়ান আর্মি তে ছিলেন। এমনই এক পরিবারে জন্মে নিজেকে কখনো অবাঙালি বলে ভাবতে পারিনি। সেই ছোট্ট থেকে সুভাষ বোস আমার হিরো। বঙ্কিম, শরৎ, নজরুলের লেখা পড়ে নিজেকে বাঙালি মননে বড় করে তুলেছি। আর আজ যখন এই ফেসবুকে দেখি অজস্র মানুষ বাঙালি পরিচয়ে লজ্জিত হয়, তখন চুপ হয়ে যাই।নিজেকে প্রশ্ন করি…ভাবি… সত্যিই কি বাঙালি হওয়া অপরাধের, লজ্জার…

যে ছাব্বিশ হাজারের চাকরি গেল, তাদেরকে কি বলব ? অথবা যাদের যাবে আগামীতে তাদেরকেই বা কি বলব ? এমন নির্লজ্জ জয়-পরাজয়ের উল্লাসে যেমন অংশী হতে পারবো না, তেমনি তোমাদের কে সান্ত্বনা দেওয়ার নামে ভড়ং-বাজীও করতে পারবোনা। তার মানে তোমাদের পাশে নই, এমন ভাবা টা বোধহয় অতিরিক্ত হবে।

ক্রমশ নিজেকে মনে হয় মাঝমাঠে একলা দাঁড়ানো সেই তাল গাছটার মত। অসহ্য গরমেও যার সবুজ পাতায় হাসির ঝিলিক। কোনো ছায়া দিতে পারিনি, তাই কোনও পথিকের বিশ্রাম নেই আমার পাশে। বুকে অজস্র কথা, শুনবার কেউ নেই..বেঁচে আছি অতি নগন্য হয়ে.. অতি সাধারণ হয়ে..

পুনর্জন্মের দোহাই দিয়ে এ জন্মের ঘর সংসার
এ জন্মের চাওয়া পাওয়া গত জন্মের কর্মফল
এ জন্মকে তাই করেছি বোবা ও বধির
অভিমানকে করেছি নীরব সম্বল…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *