আত্মজা *****  ধারাবাহিক ***** উপন্যাস ***** অধ্যায় -১৬  ***** সুদেষ্ণা সিনহা

NA001787

আত্মজা
     ——————
        ধারাবাহিক উপন্যাস
               অধ্যায় -১৬
             সুদেষ্ণা সিনহা

কলিং বেলে হাত রাখল স্বাধীনতা।টিং টং টিং টং…. বেশ কিছুক্ষণ ধরে বেজে চলছে কলিংবেল।কেউ সাড়া দেয় না।
কি হল!ঘুমিয়ে পড়ল নাকি সুপ্রিয়া!
আবার কলিংবেল                   বাজাল।                                                একবার…দু’বার…তিনবার….
এখন চৈত্রের শেষ।দুপুরে দিকে বাতাসে বেশ উষ্ণতা। স্বাধীনতার ভাড়াবাড়ির বাইরের দরজায় কোন শেড নেই।গল গল করে ঘামছে সে। চৈত্রের দুপুরে একটা কুবো পাখি একটানা ডেকে চলেছে।
বাড়িওলা বৌদি এসে দাঁড়িয়েছে।
–‐-কি হল সাড়া দিচ্ছে না সুপ্রিয়া?কিছুক্ষণ আগে  দাদাকে খেতে দিচ্ছিল শুনছিলাম …..বাড়িওলা বৌদি কি কিছু বোঝাতে চায়ছে!
স্কুল থেকে অলোক এসে গেছে বাড়ি! ক’দিন ধরে এটাই দেখছে —  অলোক তার বাড়ি আসার আগেই বাড়ি পৌঁছে যাচ্ছে। স্বাধীনতার মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গেল। রগের পাশটা দপ্ দপ্ করছে।
এবার হাত বাড়িয়ে যথা সম্ভব জোরে দরজায় কড়া নাড়ল সে।চীৎকার করে ডাকল ,সুপ্রিয়া আ…সুপ্রিয়া…

খুট্ করে দরজাটা খুলে গেল এবার।সুপ্রিয়া পরণের অবিন্যস্ত শাড়িটাকে ঠিকঠাক করতে করতে বলল,অনেকক্ষণ ধরে ডাকছ দিদি?বাথরুমে ছিলাম…..মনে হল ডাকছ…..
ন্যাকামি দেখে স্বাধীনতার রাগ হয়ে যায়।তবুও খুব শান্তস্বরে কেটে কেটে বলে, রোদে তেতেপুড়ে এসে আর দাঁড়ানো যায় না। বাথরুম থেকেও সাড়া দেওয়া যেতো।তোমার সাড়া দেওয়া উচিৎ ছিল।
অতিরিক্ত তৎপরতা দেখায় সুপ্রিয়া। স্বাধীনতার ব্যাগ থেকে টিফিন কৌটো বের করে মেজে নেয়। স্টোভ জ্বেলে চায়ের জল বসায়। টিন থেকে মুড়ি বের করে বাটিতে দেয়।

ঘরে ঘুমোচ্ছে অলোক।জবাও ঘুমোচ্ছে। বিছানার এক ধারে শুতে গিয়ে কেমন গা ঘিন ঘিন করে উঠল স্বাধীনতার।
বিছানার গোলাপী চাদরে সাঁওতালি নৃত্যরত রমনী ও পুরুষের ছাপ।পুরুষ ও মহিলা দুজন দুজনের কোমর বেষ্টন করে পা ফেলছে নাচের তালে তালে। এক বসন্তে এই চাদরটা বাঁকুড়া থেকে কিনেছিল অলোক আর স্বাধীনতা। তখন ওদের মনে প্রেম ছিল।পলাশের ডালে ডালে লাল ফুলে ফুলে ভালবাসার ছোঁয়া জীবনেও ধরা দিত।
সেবার বিয়ের পর বাঁকুড়ায় ঘুরতে গিয়েছিল অলোক আর স্বাধীনতা। বাঁকুড়ার গ্রামে গ্রামে মাটির রংবেরঙের সাঁওতাল বাড়ি।উঠোনে শুঁয়োর বাঁধা।মহুয়ার ফুলের মধু দিয়ে তৈরি মদ,সাঁওতালদের উঠোন জুড়ে।গ্রামে রাস্তার ধারে ধারে লাল পলাশ।রাতে সাঁওতাল পরবে ছেলেমেয়ে মেতে উঠেছিল। গাছের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদের আলো।মাদলের তালে তালে সাঁওতাল রমনীর হাত ধরে ধরে নাচ।মহুয়ার মদের নেশায় পা কাঁপছিল অলোকের।পলাশ গাছের নীচ থেকে একটা পলাশ ফুল কুড়িয়ে স্বাধীনতার খোঁপায় গুঁজে দিয়ে সে প্রেমিকার মতো করে আবৃত্তি করেছিল—

“মোহনিয়া বন্ধু রে ! আমি বালিকা
তোরই লাগি গান গাই, গাঁথি মালিকা।”

“আজ সন্ধ্যার শেষে খালি বিছানা;
আমি শোব ,পাশে মোর কেউ শোবে না–
তুই ছাড়া এই দেহ কেউ ছোঁবে না।”……

লজ্জা পেয়ে স্বাধীনতার গাল লাল হয়ে গিয়েছিল।অলোকের গায়ে ঢাক্কা দিয়ে সে বলেছিল,এই যাহ্।

বিছানার চাদরটা কিছুটা কুঁচকানো।দুপুরের ঝালাস আসবে বলে দরজা-জানলা বন্ধ।জানলার ফাঁক গলে যেটুকু আলো আসছে তাতে সুস্পষ্ট এই জায়গায় কেউ বসেছিল বা শুয়েছিল।

ঘরের একপাশে একটা ইজি চেয়ার — কাঠের ফ্রেমে,শক্ত কাপড়ের আস্তরণ।ক্লান্ত দেহে, অবসন্ন মনে ,কখনো বা উচ্ছ্বল আনন্দে এই চেয়ারে বসে গা এলিয়ে দেয় স্বাধীনতা।কখনো কাঁদে,কখনো হাসে,কখনো বা গান গায় —

” প্রভু আমার,প্রিয় আমার পরম ধন হে।
চির পথের সঙ্গী আমার চিরজীবন হে।। ”

প্রভু, আমাকে শান্তি দাও। আমার জীবন কি কোনদিন সমস্যামুক্ত থাকবে না? বহরমপুর থেকে কৃষ্ণনগর– ডট্টাচার্য্য বাড়ির মেয়ে থেকে সান্যাল বাড়ির বউ– এই পরিক্রমায় কি তার খোলনলচে সব বদলে যাবে? আর কতটা বদলাতে হবে তাকে? আর কতটা পরিবর্তিত হলে জীবনে সুখের খোঁজ পাবে সে? আর আমাকে কতটা ধৈর্য ধরতে হবে,প্রভু?

সন্ধ্যে গড়িয়ে রাতের আঁধার নেমে এসেছে।বনের ওধার থেকে জোনাকিদের একটানা ডাক।রেল লাইনের ওপাড়ে শিয়াল ডেকে চলেছে,হুক্কি হুয়া,হুয়া হুয়া হুয়া।স্ট্রীট লাইটের ঘোলাটে আলোয় সবুজ পোকাদের এক রাত্রির জীবন। সব ছাপিয়ে কাঠের ফ্রেমে কাঁচের বাঁধানো ছবিতে রমনী
রক্তাক্ত হৃদয়ে বলছে,সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে।

স্টোভে দুধ গরম করে জবাকে খাইয়ে দিয়েছে স্বাধীনতা।তার খিদে নেই।অলোকের রুটি,তরকারির থালাটা টেবিলে নামিয়ে রেখে সে শুধু অস্ফুটে বলেছিল,খাবার দিয়েছি।

অলোক জানে ঝড় ওঠার আগে বড় বড় গাছ থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে।স্বাধীনতার নীরবতা এই ঝড়ের পূর্বলক্ষণ ছাড়া আর কিছু নয়। তবুও কিছুতেই ঝড় থামানো গেল না।

-‐- তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
—-বল কি কথা?
—- তোমরা কতদূর এগিয়েছো?
—হোআআট? হোয়াট ডু ইউ মিন?
—-কেন বুঝতে কি এতই কষ্ট হচ্ছে? তবে সোজা করে বলি সুপ্রিয়ার সাথে কতদূর ঢলাঢলি এগোলো?
—চোপ।চোপ বলছি।তোর মুখ সোজা করে দেব।
—-কি তুমি আমাকে ছোটলোকদের মতো তুই তোকারি করছ!এত দূর আস্পর্ধা তোমার!
—-চোপ শালি।জুতিয়ে তোর মুখ সোজা করে দেব!
-‐–ছিঃ!হোল্ড ইওর টাঙ্গ!আমার লজ্জা লাগছে যে…
—- শালী আর একবার বল তোকে মেরেই ফেলব আজ…একেবারে গলা টিপে দেব…
—-আঃ আঃ লাগছে লাগছে ছাড়।ছেড়ে দাও।

বাড়িওলা দাদাবৌদি নীরবে দরজার পাশে লুকিয়ে লুকিয়ে সব শুনল। কিন্তু কেউ সামনে এল না ।
ওরা মনে মনে ভাবলো,স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এমন কত কিছু হয়।এসব ধরতে নেই। আবার মিলমিশ হয়ে যাবে ঠিক।

অলোকের চোখের মণি তখন লাল টক্ টকে। হিংস্র নেকড়ের মতো পেছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে হাত ছেড়ে দেয় সে। স্বাধীনতা টাল সামলাতে না পেরে হঠাৎ  দেওয়ালে ধাক্কা খায়।সেও ফুঁসতে থাকে। ভদ্রবাড়ির মেয়ের গায়ে হাত? সে কি ভুল বলেছে?অসভ্য,ইতর লোক। সত্যি কথা বললেই দোষ হয়ে যায়? সেদিন তপতীদি বাড়ি এসে বলে গেলো অলোকের ক্লেচ্ছাকাহিনী।সবটা ভুল? প্রতিদিন স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে  আসে কেন সে? সুপ্রিয়া বলেছিল বাথরুমে ছিল তাই শুনতে পায়নি কলিংবেলের আওয়াজ।অলোক তো ঘরেই ছিল।সে কেন শুনতে পেল না!নাকি সে এমন অবস্থায় ছিল যে দরজা খুলতে গেলেই স্বাধীনতার কাছে আজ ধরা পড়ে যেত?

অনেক রাত।চারিদিক শুনশান।রাতের আকাশে তারাদের দরবার বসেছে। চাঁদের আলো গায়ে মেখে বারান্দার গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল স্বাধীনতা।মেয়েটা ঘুমোচ্ছে মশারির ভিতর। ওখানেই ওই লম্পটটা শুয়ে আছে।কিছুতেই ওই বিছানায় শুতে পারবে না স্বাধীনতা।নোংরা,দুশ্চরিত্র ব্যাটা ছেলে কোথাকার!নিজে দোষ করে আবার তার গায়ে হাত তুললো! এর একটা বিহিত সে করবেই।কিছুতেই এত বড় অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না।মানবে না সে।কক্ষনো মানবে না এই অন্যায় আচরণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *