#রায় বাড়ির অন্দরমহল ছবি ব্যনার্জী

#ধারাবাহিক
#রায় বাড়ির অন্দরমহল
ছবি ব্যনার্জী
পর্ব–১
রায় বাড়ির অন্দরমহলের সর্বময়ী কর্ত্রী ব্রহ্মময়ী ওরফে বেম্ভ ঠাকরুন চুরানব্বই বছর বয়সেও শয্যাশায়ী অবস্থায় বাড়ির রান্নার কত রকমের পদ হবে,বাড়ির কুল দেবতা গোপীনাথ রাধারানীর অন্নভোগে কতপদ ব্যঞ্জন হবে,সাতটা গোরুর দুধের কতখানি বাড়ির জন্য রেখে বাকিটা বিক্রি হবে এইসব হীরে থেকে জিড়ে সব নির্দেশ শয্যাশায়ী অবস্থায় ও নিত্যদিনের মতো সেদিনও দিয়ে যাচ্ছিলেন। বিধবা হওয়ার পর তার শোবার ঘরে বরাবর ভাঁড়ারের জিনিস পত্র থাকত।সেখানে চাল তেল মশলা থেকে আচার ,বড়ি ,তেঁতুল ঘি নারকেল নাড়ু সব মজুদ থাকত।সে নিজে প্রতিদিনের চাল ডাল থেকে তেল মশলা আরও যা কিছু দরকার সব বের করে দিত। ইদানিং তার শয্যাশায়ী অবস্থার জন্য ভাঁড়ার ঘর অন্য ঘরে বদল হয়েছে।কিন্তু নিজে হাতে ভাঁড়ারের জিনিস না বের করলেও হুকুম এখনও অব্যাহত আছে।অন্দরের অখন্ড কর্তৃত্ব পুরোটা ছাড়লে সে মূল্যহীন হয়ে যাবে এমনটাই তার ধারণা।
এই রায় বাড়ির অন্দরমহলের সর্বময়ী গিন্নির পদ পেতে পুত্র বধূর মধ্যবয়স পেরিয়ে যায়। ছেলে মেয়েদের বিয়ে হওয়া থেকে নাতি নাতনিও হয়ে যায়।কিন্তু ওই বয়সেও পুত্র বধূ প্রায় নববধূর মতো শাশুড়িমার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে।কারন রায় বাড়ির পুরুষরা জমিদারের উত্তরসূরী হিসাবে জমিদারি মেজাজ আর চন্ডালে রাগ জন্মগত ভাবেই বহন করে আসছে।কিন্তু অদ্ভূত ভাবে এরা অতিমাত্রায় মাতৃভক্ত এবং স্ত্রৈন ও বটে।শুধু পান থেকে চুন খসলে এই রাগ নিজের ছেলে মেয়ে থেকে আশ্রিত আত্মীয় স্বজনদের ওপর ফলিয়ে থাকে।আর স্ত্রীর প্রতি যতই আনুগত্য থাকুক সেটা মায়ের থেকে বেশি নয়।
রাধাকান্ত ব্রহ্মময়ীর একমাত্র জীবিত সন্তান। তার আগে তার চার মেয়ে সন্তানের দুজন ভূমিষ্ঠ হয়ে মৃত্যু হয়েছিল আর দুজন ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে মৃত্যু হয়েছিল।সেই সময় তার শাশুড়িমা তাকে বাপের বাড়িতে রেখে আসার সিদ্ধান্ত প্রায় পাকা করে ফেলেছিল।বাড়িতে ঘটকের আনাগোনাও শুরু হয়েছিল। তখন নিশিকান্ত মায়ের হাতে পায়ে ধরে আর একটা বার সন্তান হওয়ার সুযোগ চেয়েছিল।ভাগ্যক্রমে পঞ্চম বার ব্রহ্মময়ী একটা সুস্থ পুত্র সন্তানের জন্ম দিল। তার পরে পরেই আরও দুটো সন্তান চার মাস আর সাতমাসে পেটেই নষ্ট হল।তার দু বছর
পরে সুস্থ্য ও জীবিত অষ্টম পুত্র সন্তানের জন্ম দিল।এই ছেলেটিও সাতবছর বয়সে মাত্র তিনদিনের জ্বরে মারা যায়।
শয্যাশায়ী ব্রহ্মময়ীর আদেশ বা নির্দেশ শুনে একমাত্র পুত্র বধূ পটেশ্বরী ওরফে পুটু সুন্দরী বলল–মা আজ কি শরীরটা একটু ভালো বোধ করছেন?তার শরীরের খোঁজ খবর একমাত্র ছেলে রাধাকান্ত নিলে ব্রহ্মময়ী খুব সন্তুষ্ট থাকে।রাধাকান্তর কোনো কারণে সেদিন ঘর থেকে বেরোতে একটু দেরি হয়েছিল।ছেলেকে না দেখে ব্রহ্মময়ীর মেজাজ খিঁচড়ে ছিল।
পটেশ্বরী কথাটা শুনে ব্রহ্মময়ী তেলে বেগুনে জ্বলে গিয়ে বলল– আ মর সব্বনাশী শরীর খারাপ হতে যাবে কোন দুঃখে শুনি? তোর বাপ মার শরীর খারাপ হোক,তোর চৌদ্দ গুষ্টির শরীর খারাপ হোক। আমার ছেলেটা ছাড়া বাড়ি শুদ্ধ লোক আমার মরণ তাকিয়ে বসে আছিস আমি বুঝিনা ভেবেছিস? কতক্ষণে শাশুড়ির আঁচলের চাবির গোছখানা নিজের আঁচল বাঁধবি বলে আমার মরণের দিন গুণছিস হতচ্ছাড়ি। যা আমার চোখের সামনে থেকে দুর হয়ে যা। ব্রহ্মময়ীর মেজাজ গরম হলে একমাত্র পুত্র বধূকে তুই তোকারি করে কথা বলে থাকে।
বিরল বাতের অসুখে ব্রহ্মময়ীর শরীরের সব অঙ্গ বিকল হলেও গলার স্বরটা এখনও বিকল হয় নি।মায়ের রাগারাগি শুনে ছেলে রাধাকান্ত হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল–আহা মা রাগ করছ কেন? এত রাগারাগি করলে যে তোমার শরীর খারাপ করবে।এতটা বয়স হল তবু তোমার বৌমার জ্ঞানবুদ্ধি হল না দেখছি।মায়ের শরীরের কথা জিজ্ঞেস করার জন্য তো আমি আছি।খামোখা তোমার জিজ্ঞেস করার দরকার টা কি? তোমার সেবা যত্ন করা কাজ তুমি সেটাই করো।ব্রহ্মময়ী খানিকটা নরম হয়ে বলল–হ্যাঁরে রাধু মুখপোড়া কবরেজ কি ছাই পাঁশ ওষুধ দেয় জানিনা। উঠে হেঁটে তো বেড়ানো তো দুরের কথা। নিজে নিজে একটু বসার ক্ষমতা টুকুও নেই। এই বিছানা খানা এখন আমার সব্বসার হয়েছে।কতদিন থেকে তোর খাওয়ার দাওয়ার সময় বসতেও পারি না। তা তোর বৌ তোর যত্ন আত্তি করে তো?রাধাকান্ত হেসে বলল–মা তোমার বৌমা খুব যত্ন করে।তোমার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে সবাই পালন করে।
ব্রহ্মময়ী বলল–হ্যাঁরে আমার নাতির বিয়েটা দেখে যেতে পারব তো?রাধাকান্ত বলল–খুব পারবে মা।তুমি তো ভালো আছো।একটু উঠে চলে হাঁটতে পারলেই তোমার নাতির বিয়ে দেব।ব্রহ্মময়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–তোর পেথ্থম সন্তানটা যদি ছেলে হত তাহলে আমি এতদিনে নাতির ঘরে পুতি পুতিন দেখতে পারতাম।
রাধাকান্ত বলল–মা তুমি তো তোমার নাতনির ঘরে পুতি পুতিন দেখেছো।–ওরে নাতনির ঘরে পুতি পুতিন দেখতে ভালো আর নাতির ঘরে পুতি পুতিন ঘর আলো।–মা তোমার নাতির ঘরেও দেখবে।শুধু একটু হেঁটে চলে বেড়াতে দেরি।
ভূত পূর্ব জমিদার হিসাবে এই নামকরা পরিবারের নামে বেনামে প্রায় তিনশো বিঘে জমি,সাত আটটা পুকুর বাগান বাঁশঝাড় থেকে গ্রামের গা লাগোয়া মফস্বল শহরের বেশ কিছু জায়গা ছাড়াও এই শহরে রাস্তার ওপরে তিনটে একতলা ভাড়া বাড়ির মালিক। এই বসত বাড়িটা দোতলা।মাঠের মতো পাকা উঠোনের তিনদিকে ছোট বড় দশটা ঘর।বিশাল চওড়া দালানটা এল আকারে গিয়ে সোজা রান্না শালায় মিশেছে। আমিষ হেঁসেল নিরামিষ হেঁসেলের মাঝখানেও চওড়া দালান।উঠোনের একপাশে কপিকল লাগানো ইঁদারা।সদ্য টিউবওয়েল প্রচলিত হওয়াতে একটা টিউবওয়েল ও বসানো আছে।এছাড়াও বাড়ি সংলগ্ন আছে বার বাড়ি,খামার বাড়ি,ঠাকুর বাড়ি আর প্রায় একশোজন বসে খাওয়ার মতো নাট মন্দির।
ব্রহ্মময়ীর স্বামী নিশিকান্ত রায় মাত্র ষাট বছর বয়সে মারা যান। তাঁর একমাত্র ছেলে রাধাকান্ত বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান ছেলে।তিনি বুঝেছিলেন শুধুমাত্র জমির আয়ে সংসার চলে উদ্বৃত্ত থাকলেও সেটা এই ঠাটবাট চালানো আর পরবর্তি প্রজন্মের জন্য যথেষ্ট নয়। সে মনে মনে একটা ব্যবসা শুরু করার স্বপ্ন দেখত।কিন্তু বদরাগী বাবার কাছে সে প্রস্তাব মুখ ফুটে বলতে পারে নি।বাবা বেঁচে থাকতে তার বিন্দুমাত্র মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না। তবু একদিন সন্ধ্যের পর সাহসে ভর করে বলল–বাবা মশাই একটা কথা বলার ছিল।নিশিকান্ত গুড়ুক গুড়ুক করে তামাক টানতে টানতে শুধু ছেলের দিকে তাকালেন।রাধাকান্ত বলল–বলছিলাম শহরে একটা ব্যবসা শুরু করলে হয় না?আমাদের তো রাস্তার ওপর তিন তিনটে বাড়ি আছে। জায়গাও আছে।ব্যবসা করলে সংসারে আয় পয় বাড়বে।
নিশিকান্ত বলল–তা কিসের ব্যবসা শুনি?–ধরুন সোনা রূপোর ব্যবসা। এই ব্যবসাতে দুহাতে রোজগার হবে।– তোর আস্পদ্দা তো কম নয়? আমরা হলাম খাঁটি নৈকষ্য কুলিন বামুন।তাছাড়াও জমিদার বংশ।সেই বংশের ছেলে হয়ে সোনার বেনের ব্যবসা করবি?সমাজে আমাদের একটা মান সম্মান আছে।রাধাকান্ত বলল–তাহলে হার্ডওয়ারের ব্যবসা করলে হয় না?নিশিকান্ত বলল– ব্যবসা করতে কত মূলধন লাগে জানিস?তাছাড়া এটা কি ব্যবসাদারের বংশ? আমার বাবার যা বিষয় আসয় ছিল সেই সম্পত্তি থেকেই আমি আরও বাড়িয়েছি। তুই ভবিষ্যতে না বাড়ালেও তাতে হেসে খেলে তোর তিন পুরুষ চলে যাবে।টাকা ওড়াবার খুব শখ হয়েছে?তোর দামড়া চেহারাখানা ছাড়া নিজের বলতে আছেটা কি?তিন তিনবারেও ম্যাট্রিকটাও উতরাতে পারিস নি। বাপের ধনে পোদ্দারি?আর একবারও যদি ব্যবসার কথা শুনি ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দেব। এখনও পর্যন্ত একটা বংশধর আনতে পারিস নি আর বড় বড় কথা?রাধাকান্ত তখন অলরেডি দুই মেয়ের বাবা।স্ত্রী পটেশ্বরী তৃতীয়বার সন্তানসম্ভবা পরপর দুই মেয়ে জন্মানোতে এমনিতেই বাবার প্রচন্ড ক্ষোভ ছিল। উঠতে বসতে গালিগালাজ করা শাশুড়িমার নিত্তনৈমিত্তিক কাজ ছিল।রাতে শোওয়ার সময় বৌকে সান্ত্বনা দিয়ে মিষ্টি কথা বলা ছাড়া রাধাকান্তর কোনো উপায় ও ছিল না।
এই বাড়িতে জনার্দন আর তার বৌ হরিমতি বলে নিঃসন্তান একজন ব্রাহ্মন স্বামী স্ত্রীকে তার বাবা বর্ধমান থেকে থেকে নিয়ে এসেছিল। হরিমতি রান্নার কাজ করত আর জনার্দন মাঝে মাঝে বর্ধমানে গিয়ে জমি জায়গার দেখাশোনা করত।এ ছাড়াও সংসারে যখন যেমন দরকার পড়ত সেসব কাজ করত।এরা উঠোনের পশ্চিম দিকের একটা ঘরে থাকত।দুজনকেই আলাদা মাইনে দেওয়া হত।কখনও কখনও নিশিকান্ত নিজেও জনার্দনকে সঙ্গে করে যেত।পঁচ সাত দিন কোনো একটা ভাগীদারের বাড়ি থাকত।জনার্দন তাকে রান্না করে দিত।আর মাখন বলে একটা ছেলে এখানকার জমি জায়গা দেখাশোনা করত, হিসেব নিকেশের কাজটাও তার দায়িত্বে ছিল। রঘু আর রতন সব সময়ের চাকর ছিল।তারা বাজার করা থেকে বাড়ির কাজ কর্ম করত।রতন আর রঘু বার বাড়ির একটা ঘরে থাকত।এছাড়াও সরলা আর ভবানী বলে সব সময়ের দুজন কাজের মাসী ছিল। অন্দরে চারজন ব্রহ্মময়ীর দুর সম্পর্কের দুজন ভাইঝি আর দুজন বোনঝি আশ্রিতা হিসাবে থাকত। এরা মাইনে করা কাজের লোকজনের পদে অনেকটা ঊর্ধে থাকলেও ও কেউ বসে খেত না।এদের নির্দিষ্ট মাইনে দেওয়া না হলেও পালে পার্বনে টাকা দেওয়া হত।
বাবার মৃত্যুর পর রাধাকান্ত প্রথম কর্তৃত্বের অধিকার লাভ করল।সে বছর খানেকের মধ্যে প্রথমেই বড় একতলা বাড়িটাতে সোনার দোকান শুরু করল। বাড়ির ভিতরে দুজন কর্মচারীদের বিনা ভাড়ায় থাকতে দিল। প্রথম প্রথম ব্যবসাটার হাল হকিকিত বুঝতে তার বছর খানেক সময় লেগেছিল।তখন কিছুদিন কলকাতা থেকে রেডিমেট গয়না এনে বিক্রি করত।তারপর আস্তে আস্তে দুটো কারিগর থেকে বাড়তে বাড়তে আটজন কারিগর এখন সেখানে গয়না তৈরি করে। ছোট শহরে তখন মাত্র দুটো ছোট সোনার দোকান ছিল।রাধাকান্ত দেরিতে দোকান শুরু করলেও তিন বছরের মধ্যেই দোকানটা বেশ জমে গেল। মাতৃভক্ত রাধাকান্ত দোকানের নাম দিল ব্রহ্মময়ী জুয়েলার্স।
এই পলাশপুর গ্রামে রায় বাড়ির দুর সম্পর্কের জ্ঞাতি গুষ্টি মিলে একটা পুরো পাড়া।তাই এই পাড়াটার নাম ও রায় পাড়া।এঁদের রায় চৌধুরী উপাধিটা জমিদারি সুত্রে পাওয়া। আসল উপাধি বন্দ্যোপাধ্যায়। অপভ্রংশে এখন শুধু রায়।
ব্রহ্মময়ী নব্বই বছর বয়স পর্যন্ত রীতিমত সচল ছিল।তার পর থেকে বাত তার গোটা শরীরে থাবা বসালো।রাধাকান্ত মাকে পাশকরা ডাক্তার দেখিয়েও তেমন লাভ হল না।ডাক্তার কিছুদিন ব্যথার ওষুধ ইঞ্জেকশন দিয়ে রোগটাকে মাস ছয়েক দাবিয়ে
রেখেছিলেন।একদিন ডাক্তার বললেন–এই রোগে তেমন চিকিৎসা নেই।গোটা শরীরে গরম রসুন তেল মালিশ করাবেন।আর ব্যথা বাড়লে ব্যথা কমার ওষুধ খাওয়াবেন।ওনার গোটা শরীর একটা সময় পঙ্গু হয়ে যাবে। এখনই ওনার নার্ভগুলো দুর্বল হতে শুরু করেছে।উনি যে কটা মাস বাঁচবেন এভাবেই বাঁচতে হবে।বলতে গেলে পাশকরা ডাক্তার একরকম জবাবই দিয়ে গেলেন।এর দু সপ্তাহের মধ্যেই ব্রহ্মময়ী প্রায় শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন।
এই পলাশপুর গ্রামে ধনঞ্জয় ঘোষালকে সবাই ধন্বন্তরী কবিরাজ বলে।বলার কারণও আছে।পাশ করা ডাক্তারের জবাব দেওয়া রোগী থেকে হাসপাতাল ফেরত রোগীদের সে তার কবিরাজি চিকিৎসার জোরে পাঁচ সাত বছর টিকিয়ে রাখার বহু নজির আছে।পাঁচখানা গ্রামে তার নামডাক ও দেখার মতো।গ্রামের লোকজনের কাছে সে ভগবান তুল্য।
অগত্যা রাধাকান্ত ধনঞ্জয় কবিরাজের শরণাপন্ন হল।
ক্রমশ—