ধারাবাহিক গল্প :- জীয়ন কাঠি কলমে :- ছন্দশ্রী দাস প্রথম পর্ব

ধারাবাহিক গল্প :- জীয়ন কাঠি
কলমে :- ছন্দশ্রী দাস
প্রথম পর্ব

নিমিষার জীবনটা একেবারে রূপকথার মেয়েদের মত। দেখতেও তেমন যেন সত্যিকারের রূপকথার রাজকন্যা। দুধে আলতা গায়ের রং ,চাঁপার কলির মত সরু সরু আঙুল, চোখের পলক এত বড় চোখ তুলে তাকালে মনে হয় স্বপ্নের দেশ থেকে এল ।আর পাতলা লাল ঠোঁটে হাসি সবসময় লেগে আছে। নাকের নাকছাবির পাথরে আলো পড়ে ঝকমক করে হাজার সূর্য দেখা যায়। ঠাকুমার সাথে বিশাল ভাঙা বাড়িতে থাকে। নিমিষা একটু বড় হতে তার ঠাকুমা স্থানীয় নেতাদের ধরে ঘরের লাগোয়া বাথরুম পায়খানা করে নিয়েছে সরকারি খরচে। তার ঠাকুমা সোমালিবুড়ি গরুর দুধ, মুরগির ডিম ,হাঁসের ডিম ,গাছের নারকেল ,সুপারি ,কলা,আম , কাঁঠাল,পুকুরের মাছ বিক্রি করে দিন চালায়। আর শীতের দিনে সুন্দর সুন্দর কাঁথা সেলাই করে কোনোমতে সংসার চালায়। আর আছে কিছু জমানো টাকা তা থেকে নিমিষার পড়াশোনার খরচ চালায়। ঠাকুরমার নিমিষা ছাড়া আর কেউ নেই। নিমিষাও সেই রকম ভালো মেয়ে। তার নেই কোন বায়না। মধুর স্বভাবের জন্য তার সব বাড়িতেই সমান আদর। আমি যখনই যাই ওদের বাড়ি দেখি ঘরের সামনে উঠোনটা পরিস্কার করে ঝাঁট দেওয়া। কোথাও একটা গাছের পাতা পড়ে নেই। সুন্দর কেয়ারি করে নানা রকমের ফুলের গাছ লাগিয়ে রেখেছে । তার সাথে দু’চারটে কাঁঠাল , পেয়ারার গাছ আছে। বাড়ির পেছন দিকে নারকেল ও আমবাগান আর পুকুর। ঘরের সামনে সাদা খরগোশ খেলা করে বেড়ায়।বারান্দায় খাঁচার ময়না গলা বেঁকিয়ে ডেকেই চলে,কে এলি রে! রাধেকৃষ্ণ। আর একটা কাকাতুয়া আছে। সেটা বড় পাজি। আমাকে দেখলেই বলে, এই যে এলেন আইবুড়ো কার্তিক। বিয়ে করবি কবে !ঠাকুমার শুনে শুনে শিখে নিয়েছে ।আর কাকাতুয়ার কথা শুনে নিমিষা হেসে গড়িয়ে পড়ে।
আজও ঢুকেছি। আমি যখনই যাই ওদের বাড়ি দূরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে নিমিষাকে দেখি। ও নিবিষ্টমনে কাজ করে যায়। কখনো পড়ে, কখনো কখনো সেলাই করে, কখনো ঠোঙা বানায়। চুপচাপ বসে থাকে না। আজ ঢুকে দেখি একমনে সেলাই করে যাচ্ছে । তার হাতের কাজ খুব সূক্ষ্ম । ওদের ইঁট পাতা রাস্তা দিয়ে গিয়ে বারান্দায় বসতে না বসতেই নিমিষা শুরু করে, ‘ দূর থেকে এক দৃষ্টিতে কি দেখা হচ্ছিল শুনি ?
‘রূপ তো সবারই থাকে তোমারও আছে , আয়নায় দেখো গিয়ে বেষ্মকাঠ।’
কাকাতুয়ার কথা শুনে নিমিষা হেসে গড়িয়ে পড়ে বলে , চুপ কর পোড়ারমুখী । গৌরদাদা বেষ্মকাঠ হবে কেন? অমন গোরার মত রঙ।
আমার মুখে মুখে কথা! আমি রাগ করেছি। বলে কাকাতুয়া পেছনে ঘুরে বসে ।
আমরা দুজনে হেসে গড়িয়ে পড়ি। নিমিষা বলে বাঁচলাম। তারপর আমাকে বলে , গৌর দাদা কি মনে করে?
সোমালি বুড়ি তলব করেছে। তা সে বুড়ি গেল কোথায়?
ঠাকুমা গেছে সাহাদের বাড়ি । মুড়ি আর ছোলা ভাজা দিতে ।
আমাকে ডেকেছে কেন কিছু বলেনি !
না …
তুই কি করছিস রূপকথা?
এই বিন্নিদিদির কুর্তিতে এমব্রয়ডারী করছি। তার সব কুর্তিতে আমাকে দিয়ে ডিজাইন করিয়ে নেয়।
কত টাকা দেয়?
তিনশ টাকা ….
এত সুন্দর কাজের বিনিময় মাত্র 300 টাকা ?তোকে ডাহা ঠকিয়ে দেয়। এগুলোর জন্য কম সে কম হাজার টাকা পাবি ।
বেশি লাভ করে কি হবে গো ?বেশ তো চলে যাচ্ছে। হেসেখেলে সুখে দিন কেটে যাচ্ছে। যত চাহিদা বাড়াবো ততো বাড়বে। তুমিই তো বলো …..
তা অবশ্য ঠিক। অল্প টাকায় যখন সুখেশান্তিতে দিন চলে যাচ্ছে তখন বেশি লোভের দরকার নেই। তবে তোর কাজ যোগ্য লোকের হাতে পড়লে তার কদর হত ।
তোমার কদর হলো কই ?তুমি ও তো সুন্দর আঁকো। এই মফঃস্বলে বাচ্চাদের একটা ছোট স্কুল খুলেই জীবন কাটিয়ে দিলে ।না দিলে কোন আঁকা একজিবিশনে ,না করলে বিয়ে।
আরে বোকা মেয়ে আমার জীবন কেটে গেছে। এখন তোর জীবনটাকে সাজাতে হবে তো নাকি !পাগলী কোথাকার।
আমি এমনি থাকবো ,কোথাও যাবো না ঠাকুমাকে ছেড়ে।তাদের কথার মাঝেই নিমিষার ঠাকুমা বাড়ির ঢোকে। বোঝা নামিয়ে রেখে বলে, কখন এলে গৌর! একটু বসো হাত পা ধুয়ে আসি ।
নিমিষা তাকিয়ে দেখে এক বোঝা পুরনো শাড়ি। বুঝতে পারে কেউ কাঁথা করতে দিয়েছে।
একটু পরে সোমালিবুড়ি স্নান সেরে এসে বলে ,হ্যাঁ রে মেয়ে গৌরদাদাকে কিছু খেতে দিয়েছিস! নাকি সেই তখন থেকে শুধু মুখে বসিয়ে রেখেছিস !উঠে একটু জল মুড়ির মোয়া দিতে পারিস নি?
ওধার থেকে কাকাতুয়া বলে, গৌরদাদা পাজি।
তুই পাজি …
না গৌরদাদা ….
গৌর বলে, নাগো সোমালিবুড়ি নিমিষা দিতে চেয়েছিল আমি বারণ করেছি।
তা ভালো বাছা এখন তো খাও। একটা রেকাবি করে তিনটে মুড়ির মোয়া ও ঝকঝকে কাঁসার ঘটিতে এক ঘটি জল নিয়ে আসে।
আমরা তিনজনেই খেতে খেতে গল্প করি। আমি একটা মোয়া তুলে নিয়ে তাতে কামড় বসিয়ে বলি, ডেকেছিলে কেন সোমালি বুড়ি?
ভেবেছিলাম তোর হাত দিয়ে একটা কাঁসার ঘড়া বিক্রি করতে পাঠাবো। ওসব ভারী জিনিস তো এখন আর কেউ ব্যবহার করে না । শুধু শুধু সিন্দুক বোঝাই হয়ে পড়ে রয়েছে।
এতোকাল তো পড়েছিল আজ হঠাৎ তাদের তোমার ফালতু মনে হলো কেন গো বুড়ি ?
তাহলে সত্যি কথাই বলি, নিমিষার কলেজের রেজাল্ট বেরিয়েছে ।নতুন ক্লাসে ভর্তি হতে টাকা লাগবে। তার ওপর বই-খাতা ও আছে। তাই ভাবলাম ঘড়াটা বিক্রি করলে অনেকগুলো টাকা পাওয়া যাবে। তাতে ওর কলেজের ভর্তির দিকটা সামলানো যাবে। আর বইখাতা আস্তে আস্তে কিনলেও চলবে।
নিমিষা বলে, ঠাকুমা আমার লেখাপড়ার খরচ নিয়ে তুমি একদম ভেবো না ।আমি প্রিন্সিপালকে বলে কলেজে ফ্রিশিপ করিয়ে নিয়েছি। আর আমি তো এখন টিউশনি করি। কলেজের হাতখরচ আর বইখাতা সব আমি নিজেই কিনে নেব। খবরদার তুমি এইসব বাসন বিক্রির কথা ভাববে না ।
না ভেবে আর কি করি বল! গহনা নেই যে বেচে সংসার চালাবো। থাকার মধ্যে আছে তোর ছোটবেলার দুগাছি পায়ের রুপোর মল, একটা সোনার হার আর দুটো বালা। বিয়ে যে কি করে দেবো তা কে জানে!
আমি বিয়ে করবো না ঠাকুমা। তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।
তা বললে কি হয় মা। একদিন না একদিন ঠিক নিজের মতো ঘর বসাতে হয়। সবাইতো আর গৌরের মত আইবুড়ো কার্তিক হয়ে বসে থাকে না ।
কাকাতুয়া বলে, গৌর আইবুড়ো কার্তিক ….
তুই আইবুড়ো কার্তিক …..
গৌড় পাজি …
সবাই হেসে ওঠে। নিমিষা বলে,  কাকাতুয়া ভালো , গৌর পাজি।
কাকাতুয়া বলে নিমিষা ভালো  ও পরী।
গৌর বলে , তাহলে আমি এখন উঠবো তুমি কি ঘড়া দেবে?
নারে তার দরকার পড়বে না । ওই সাহাদের বাড়ি মুড়ি দিতে গেলাম, ওদের বড় গিন্নির মেয়ের বাচ্চা হবে। আমাকে কাঁথা করতে দিয়েছে ।তা আমি বললাম যদি কিছু টাকা অগ্রিম দেয়। গিন্নি ভালো পুরো টাকাটাই দিয়ে দিল। এখন থাক পরে যদি দরকার পরে বলব।
আমি বলি কি বুড়ি ,ঐ সব বাসনকোসন বিক্রি না করে রেখে দাও ।তোমার যদি টাকার দরকার লাগে আমার কাছ থেকে নাও , পরে শোধ করে দিও ।
আমার বয়স হচ্ছে গৌর আমি কি পারব শোধ করতে? তুমি কেন শোধ করবে ?শোধ করবে নিমিষার ছেলে। নিমিষা বলে বাহ রে বাহ। যার এখানে কোন এন্ট্রি নেই তাকে পেড়ে ফেললে । আজব তোমাদের চিন্তা ।
গৌর বলে , আমার সবকিছুই আজব তাই না রে ! নিমিষার মাথা নেড়ে আদর করে চলে যায়।
ক্রমশঃ
***************

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *