ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (উনবিংশ পর্ব) সায়ন্তন ধর

ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (উনবিংশ পর্ব)

সায়ন্তন ধর

উনবিংশ শতাব্দীতে যেমন পৃথিবীতে আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। তেমনি উনবিংশ পর্ব লিখতে বসার আগেও অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। ব্রহ্মপুত্র দিয়ে অনেক কিউসেক জল গড়িয়ে গেছে। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে লিখতে শুরু করেছিলাম নেহাত শখে। ভাবিনি তা পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠবে। এর আগে ধারাবাহিক ভাবে এ লেখা প্রকাশ হয়েছে গীতশ্রী সিনহা (আমার মামণি) এর সম্পাদনায় দিনাজপুর ডেইলিতে। আর এই পর্ব যখন লিখতে বসেছি, তখন অলরেডি আমি ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের আপাত স্থায়ী বাসিন্দা। ভগবান মনে করেছেন, “লিখবিই যখন শুধু ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাস না, ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে থেকে জীবনযুদ্ধ কাটিয়ে লেখাকে সমৃদ্ধ কর।” তাই ২০২৫ এর ফেব্রুয়ারি থেকে আমি কর্মস্থলে শহুরে কংক্রিটের ক্যানভাস ছাড়িয়ে সবুজের আওতায় থিতু হলাম। মামণির কথামতো একটু স্মৃতিচারণ করে নিই। ফিরে যাই দুবছর আগে ২০২৩ এর মে মাসে। আমি গত পর্বে গুয়াহাটি অফিসে এসেছিলাম আমাদের নতুন ডাইরেক্টর স্যারের পূর্বোত্তর সেল ভিজিট উপলক্ষ্যে। সেই সময়েই আমাদের পুরনো অফিসঘর থেকে নতুন অফিসঘরে শিফ্টিংও হলো। আমার প্রথম ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাসাও সেই প্রথম। যাইহোক এবারে আবার গল্পে ফিরি। ডিরেক্টর স্যারকে বরণ করে নেওয়া হলো অসমের ট্র্যাডিশনাল গামোছা, শরাই/সঁফুরা নামক কাঁসার তাম্বুল পাত্র ও জাপি নামক ঐতিহ্যবাহী টুপির দ্বারা। এই ফাঁকে এদের সম্পর্কে একটু জেনে নিলাম অসমীয়া কলিগবন্ধুর থেকে। শরাই (ইংরেজি: xorai; অসমীয়া: শৰাই) অসমের লোক-সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ। দেবতাকে নৈবেদ্য দেওয়া ও মহৎ গ্রন্থ রাখার জন্য শরাই ব্যবহার করা হয়। অসমে শরাই সম্মানের প্রতীক। সাধারণতঃ শরাই নির্মাণে পিতল বা কাঁসা ধাতুর ব্যবহার করা হলেও কখনো কখনো রুপো বা তামা দ্বারা নির্মিত শরাইও দেখা যায়। মধ্যযুগে সিংহাসনের সম্মুখে নৈবেদ্য দেওয়ার জন্য শরাই ব্যবহার করা হত কিন্তু বর্তমানে বিবাহ, উৎসব ও নামঘরে শরাই ব্যবহার করা হয়। অসমীয়া নামঘরে তামোল পান দেওয়ার জন্য শরাইয়ের ব্যবহার করা হয়। বাঁশ, বেত ও কাঠ দ্বারা নির্মিত শরাই উপহার বা গৃহ সাজানের জন্য ব্যবহার করা হয়। বহাগ বিহুর সময়ে হুঁসরি গাওয়া দলকে ফুলাম গামোছা, তামোল পান ও শরাই প্রদান করা পূণ্যের কাজ বলে গণ্য করা হয়। জাপি অসমের সংস্কৃতির বাহক এবং অসমীয়া জাতি ও সংস্কৃতির বিশেষ প্রতীকচিহ্ন। জাপির জন্ম চীনে হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। প্রথম অবস্থায় জাপি দেখতে টুপির ন্যায় ছিল কালক্রমে জাপির আকার, রং ও গঠন ভিন্ন ধরনের হয়েছে। বাঁশ, বেত ও গাছের পাতা ব্যবহার করে জাপি প্রস্তুত করা হয়। স্থানভেদে গাছের পাতা ও জন্তুর চামড়া ব্যবহার করেও জাপি প্রস্তুত করা হয়। রূপসজ্জার উপর নির্ভর করে জাপিকে ফুলাম জাপি ও উকা জাপি এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আহোম রাজাদের রাজত্বকালে সম্মানীয় ব্যক্তিরা মর্যদা অনুযায়ী জাপি ব্যবহার করতেন। অসমে বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে জাপি ও গামোছা প্রদান করে সম্মান জানানো হয়। বিহুনৃত্যে জাপি অপরিহার্য অঙ্গ। অসমের কৃষকেরা বৃষ্টির দিনে কৃষিকাজের সময় ছাতার পরিবর্ত্তে জাপির ব্যবহার করেন। অসমীয়া সংস্কৃতিতে গামোছা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে৷ বিহু, বিবাহ অনুষ্ঠান বা অন্যান্য যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে গামোছাকে সম্মানের প্ৰতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷ অসমের সকল শ্ৰেণীর মানুষ গামোছা ব্যবহার করে৷ অসমের বিহু উৎসবের সাথে গামোছার বিশেষ সম্পৰ্ক আছে৷ বিহু নৃত্যের সময়ে যুবকরা গামোছাকে মাথায় বেঁধে বিহু নৃত্যে অংশ গ্ৰহণ করে৷ এজন্যে গামোছাকে বিহুয়ান বলা হয়৷ অন্যদিকে বিবাহ অনুষ্ঠানে সকল ক্ষেত্ৰে গামোছাকে উপহার দেয়ার সাথে সম্মান জানানোর জন্যেও ব্যবহার করা হয়৷ প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য অসমীয়া গামোছা প্রধানতঃ সাদা জমিন ও লাল সুতোর কাজকরা পাড়, এরকম হয়ে থাকলেও সবুজ, নীল সুতোর কাজও দেখেছি। উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনজাতির হলুদ জমিন ও সবুজ সুতোর কাজকরা পাড় যুক্ত গামছার সাথেও মিল রয়েছে অনেক। এমনকি কোচবিহারের অনেক বস্ত্রবয়নশিল্পী অসমীয়া গামোছা তৈরি করে থাকেন। এ আমার নিজের চোখেই দেখা। ফিরে আসি ঘটমান বর্তমানে। এরপর স্যার আমাদের সকলের সাথে পরিচিত হলেন। আমাদের কাজের ধারা সম্পর্কে জানলেন। একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ ততটাই বিনয়ী হন, এ কথাকে সত্য প্রমাণ করে তিনি বললেন, “আমি এখানে নতুন, এই সংস্থার কাজ সম্পর্কে সেভাবে অবগত নই, তোমরা আমাকে বলো কিভাবে তোমরা কাজ করো।” এরপর লাঞ্চ সারলাম আমরা স্যারের সাথেই। তারপর স্যার কিছু জরুরী মিটিং এ চলে গেলেন। আমরা অফিসিয়াল কাজে মনোনিবেশ করলাম। যথাসময়ে ফিরে এলাম স্টেশনের কাছে প্রতীক্ষালয়ে। ফেরার পথে কলিগ দাদা একটি প্রেজেন্টেশন শপে নিয়ে গেলো। সেখানে ছোট ছোট শো পিস, কাঠের জাপি, এক শৃঙ্গ গণ্ডার, বাঁশের-বেতের কাজ, কাঁসার বড়, মেজো, ছোট শরাই/সঁফুরা, বেতের অরিজিনাল জাপি, মাছ ধরার সরঞ্জামের মিনিয়েচার সাজানো রয়েছে। মেখলা, অন্যান্য ট্র্যাডিশনাল জামা, গামোছা, মণিপুরী হাতের কাজ করা মাফলারে রঙে রঙে রঙিন দোকানটি। দাদা কিছু শো-পিস কিনলো। আমার গামোছা কেনার শখ জাগলেও মূল্য শুনে নেওয়ার ইচ্ছে মুলতুবি রাখলাম। তবে দাদার প্রয়োজন থাকলেও একটিও ঝোলা ব্যাগ কিনলো না। সেদিন রাত কাটলো। পরদিন সকালে কামাক্ষা স্টেশন থেকে ট্রেন। এদিকে গুয়াহাটি রাজধানী হলেও কলকাতার মতো লোকাল ট্রেনের সুবিধা নেই। কামাক্ষা স্টেশনে যেতে আবারো উবের ভাড়া করতে হলো। দাদা এবারে আমার হার্বেরিয়ামের জন্য নতুন কেনা লাল ব্যাগটি বাগিয়ে নিলো তার কিছু বড়সড় ইনোভেশন নিয়ে যাওয়ার জন্য। এদিকে হার্বেরিয়াম জমা দিয়ে এলেও কিছু বড় ফাইল আমার কাছে রয়ে গিয়েছিল যা আমি ওই ব্যাগে নিয়েছিলাম। আমি বললাম, “একটা নতুন ব্যাগ কিনতে পারতে তো। এটা আমার মাপ মতো হার্বেরিয়াম ক্যারি করার ব্যাগ।” উত্তরে সে বললো অফিস থেকে টাকা ক্লেইম করে নিও। অদ্ভুত এ মানসিকতায় জোর ধাক্কা খেলাম। টাকাটা বড় কথা নয়। বাবা অনেক খুঁজে আমার কাজের উপযুক্ত এই ব্যাগটি কিনে দিয়েছিলেন। যাই হোক অন্যের কিছু ইমোশন অপর কিছু কাছের মানুষকেও স্পর্শ করে না। ট্রেন ছাড়লো। মনে দুঃখ নিয়ে সেই সফর শেষ করলাম। মন খারাপ হলো আবারো স্মৃতিচারণ করে এই ঘটনাগুলো লিখতে গিয়ে। নতুন আপাত আস্তানার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। চৈত্র মাসেই টপ ফ্লোরের ঘরে বেশ গরম। ওপরে ট্রাসও নেই। কিন্তু ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই কামাক্ষা পাহাড় থেকে নেমে আসা ক্যাটাবেটিক বাতাস ব্রহ্মপুত্রের জলে সিক্ত হয়ে শীতলতা বয়ে আনলো, শিক্ষা দিল অতীত ভুলে সামনে তাকাতে। মনটাও ভালো হয়ে গেল ধীরে ধীরে। এরপর থেকে আবার নিয়ম করে প্রতি সংখ্যায় ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে লিখবো… পরের পর্বের ঘটনাবলী ভীষণ আকর্ষণীয়… আজ পূর্বকথা ও আগামীর আবছা আলোচনায় পর্ব শেষ… অনেকটা সিরিয়ালের মতো… স্টে টিউন্‌ড্।

(ক্রমশঃ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *