# সূর্যশিশির। # ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।

# উপন্যাসিকা।
# সূর্যশিশির।
# ছন্দা চট্টোপাধ্যায়।
# পর্ব-১।
মধুরা তার দেবর্ষিস্যারের চিন্তায় মগ্ন থাকে। তার অস্তিত্বের নাভিমূলে প্রতি রাতে কালনাগিনী হয়ে ছোবল মারে স্যারের চিন্তা। সংযমের লৌহবাসরঘরে সূচিপ্রমাণ রন্ধ্র দিয়ে প্রবেশ করে মা মনসার কন্ঠহার সুতুলিয়া সাপের মতো, মনসার ছলনায় যেমন সুতুলিতুল্য সরু হয়ে বেহুলার বাসরঘরে প্রবেশ করেছিলো সে। কামনার আগুনে দগ্ধ হয়ে ছটফট করে মধুরা।আত্মবিশ্লেষণের শক্তি হারিয়ে ফেলেছে মধুরা। কুণ্ডলিনী সেই কালনাগিনীর বিষাক্ত ছোবলে যেন নীলাপাথরে পরিণত হয় মধুরা।নীলা কি সবার সহ্য হয়!
শতমন্যু পাশের বইঘরে সোফা কাম বেডে শুয়ে পড়েছে। রাত দুটো পর্যন্ত তার বেডসাইড টেবিলল্যাম্পের আলোর আভাস টের পেয়েছে মধুরা।তার অস্তিত্বের সঙ্কট নিরসনে নিজেই নিজের ব্যবস্থা করে নিয়েছে শতমন্যু। সেই শতমন্যু! ভালোবাসায় ভরে থাকা এক গন্ধর্ব! যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে এম এ পাশ করেছিলো ওরা দুজন। শতমন্যু কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের পদে যোগ দেওয়ার পর বিয়েটাও সেরে ফেলে ওরা।
তবু দু’বছর পরে শতমন্যু কেন অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায় মধুরার কাছে?কেন আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে?কি কম আছে তার! মধুরার চাহিদা,তার উন্মত্ত আশ্লেষে ভরা কামনা, শতমন্যু মেটাতে পারেনি। আস্তে আস্তে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে উঠে যায় বরফের পাঁচীল।
শতমন্যু ভোরের কুয়াশামাখা আলোয় উদ্ভাসিত শহরকে জেগে উঠতে দেখে তার পাঁচতলা ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। সব্জির গাড়িগুলো ঢুকছে শহরে। খবরের কাগজ ওয়ালা সুতোয় বাঁধা খবর ছুঁড়ে দিচ্ছে দোতলা তিনতলা ফ্ল্যাটগুলোয়। শতমন্যুর মন বায়োস্কোপের মতো পেছোতে থাকে তার শৈশবে। ভোরবেলায় গ্রামের প্রথম সূর্যের কিরণে ঝলমলে উদার পরিবেশ…, বন্ধুদের ডাক… -‘শতমন্যু,চল্ সাঁতার কাটতে যাবি না?’- তাড়াতাড়ি তেল মেখে ছুটে বেড়োনো, সোনাই দীঘির জলে ঝাঁপাই জোড়া; আহ্ ! ফিরে পাওয়া যায় না সেই শৈশব! এখন একটা সম্মানজনক নিয়মে আবদ্ধ জীবন! মধুরা বোঝে না তাকে। সেও কি বোঝে মধুরাকে? তার বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে পার্টি, উদ্দাম জীবনযাপনের প্রতি উদ্দাম আকর্ষণ!শতমন্যু পছন্দ করে না। ধীরে ধীরে গুটিয়ে নেয় নিজেকে। তার নিজের জগৎ পড়াশোনা, লেখালেখিতে ডুবে যায়।
পাশের ঘরে মধুরা অসাড়ে ঘুমোচ্ছে। সারারাতের অতৃপ্ত জাগরণ তার। -‘তুমি ভালোবাসতে জানো না।’- অভিযোগ মধুরার। কেমন ভালোবাসার কথা বলে মধুরা! মধুরা তো শতমন্যুর একমাত্র ভালোবাসা!-‘তুমি শুধু তোমার বইপত্র নিয়েই থাকবে?চলো না কোথাও ঘুরে আসি।’- দুজনে যায় সিকিম, কাশ্মীর। মধুরার তবু মন ভরে না। যখন তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে বরের ওপর। ছিন্নভিন্ন করতে চায়, ছিন্নভিন্ন হতে চায়। শতমন্যুর সাধ্য হয় না ওকে সন্তুষ্ট করার।
এক ধরনের ফুল আছে না, খুব সুন্দর দেখতে, অদ্ভুত সুন্দর আকর্ষণীয় গন্ধ! আমাজনের অরণ্যের গভীরে ফোটে সেই ফুল। এখন তো পাওয়া গেছে জঙ্গলমহলের কোনো অঞ্চলে। সেই ফুল আকর্ষণ করে কীটপতঙ্গদের। তারপর চুষে খেয়ে হজম করে ফেলে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও শতমন্যু সেই ফুলের সাযুজ্য দেখে মধুরার মধ্যে। সূর্যশিশির!