প্রেম আর ভালোবাসা / গল্প *****নিরঞ্জন ঘোষ

প্রেম আর ভালোবাসা / গল্প
নিরঞ্জন ঘোষ
ইউনিভার্সিটি হল থেকে বেরিয়ে একটু ইতস্তত করল শরৎ। মাথাটা কিরকম যেন লাগছে। এরকম বোধ কোনদিন হয়নি। মেডিকেল চেক আপ এ যেতে হবে মনে হয়।
অবশ্য আর সাত দিন বাদেই সরকারি নিয়মে কম্পালসরি মেডিকেল চেক আপ এ যেতেই হবে। তার রিসিভারে ২৪ ঘন্টা আগে মেসেজ আসবে। তিন মাস অন্তর একবার, বছরে চারবার।
কিন্তু আজ মাথাটা এরকম করছে কেন। কোনদিন ঠিক এইরকম বোধ হয়নি। কোন কিছু নিয়ে বেশি চিন্তা করেছে কি? হয়তো তাই হবে। নিজের অজান্তে মাথাটা ভারী করে তুলেছে। যদি পরেও এইরকম বোধ হয়, কালকেই চেক আপ সেন্টারে ভর্তি হয়ে যাবে।
যাক, ও ভাবনা পরে ভাবা যাবে। অবশ্য ও কোনদিন কোন কিছু ভাবে না। ভাবা কি জিনিষ, ও জানেই না। ও ঠিক সেইরকম ভাবেই তৈরি।
রাস্তার ধারে এসে পর পর দাঁড়িয়ে থাকা সিঙ্গল সিটার মিনি ক্যাব গুলোর মধ্যে থেকে একটা উজ্জ্বল হলুদ রঙের ক্যাব বেছে নিল শরৎ। কলেজ স্ট্রীট নামটা এখনও আছে। ইউনিভারসিটিতে এখন নানারকম সেমিনার ছাড়া আর কিছুই হয় না। পাশের মেডিকেল কলেজ এখন রুপান্তরিত হয়েছে পিরিয়ডিকাল মেডিকেল চেক আপ সেন্টারে। বেশ কিছু বছর আগে এখানে ইউনিভারসিটি মিউজিয়মে কলেজ স্ট্রীটের ছবি দেখেছিল শরৎ। প্রায় ১৭০ বছর আগেকার ছবি। কি বিশ্রী ঘিঞ্জি নানা রকম দোকান ঘেরা একটা অপরিসর রাস্তা। নানা রকম বইয়ের দোকান। বই এখন মিউজিয়াম ছাড়া অন্য কোথাও দেখা যায় না। দোকান শব্দ টা উঠে গেছে। কেউ বলে না। কাগজ, কলম, বই ইত্যাদি শব্দ গুলো অন্যান্য অনেক শব্দের মতো অপ্রচলিত হয়ে গেছে। আর আজকের সেমিনার ছিল মানুষের দৈনন্দিন ভাষা থেকে আরও কত অপ্রয়োজনীয় শব্দ বাদ দেওয়া যায় সেই ব্যাপারে।
ক্যাবের নির্দিষ্ট জায়গায় তর্জনী ছোঁয়াতেই গাড়ির দরজা খুলে গেল। গাড়ি ভারত সরকারের। ভারতের যে কোন জায়গায় এই সেবা পাওয়া যায়, সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। দেশে মূল্য বা দাম শব্দটি অপ্রচলিত। ভাড়া শব্দটিও। শুধু দেশে নয়, সারা পৃথিবীতে দাম, মূল্য, ভাড়া বলে কোন শব্দ নেই। গত শতাব্দীতেই উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সারা পৃথিবীতে অর্থ নেই। অর্থ নেই, কিন্তু তার হিসেব আছে। তার পরিমাপ সরকারী। দেশের লোক সরকার নির্দিষ্ট কাজ করে। কম বা বেশি কাজ করার কোন অধিকার সাধারণ মানুষের নেই। আর কাজ করার জন্য জনগন কোন মজুরী পায় না। মজুরী শব্দটাও অপ্রচলিত। জনগনের সব কিছুর দায়িত্ব সরকারের। জনগনের সমস্ত প্রয়োজনই সরকারি নিয়ন্ত্রণে, সরকারি দায়বদ্ধতায়। সমস্ত ধরণের সেবাও তাই।
এটা লোকাল ক্যাব। অটো ড্রাইভ। গাড়িতে বসে সিটের সামনে রাখা টাচ স্ক্রীনে গন্তব্যের ম্যাপে সঠিক জায়গায় আঙুল ছোঁয়াতেই গাড়ি চলতে শুরু করবে। গাড়ির কোন ড্রাইভার লাগে না। দরকার শুধু তার তর্জনীর ছোঁয়া। অর্থের পরিচয় বহনকারি নোট বা মুদ্রার ব্যবহার বহুকাল আগে বিলুপ্ত। টাকা পয়সা ইত্যাদি শব্দগুলোও বিলুপ্ত। তবে সরকার থেকেই স্থানের নাম গুলো অবলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছে। ২০০০ সালে যে যে স্থানের নাম যা যা ছিল সেটাই রাখা আছে। যদিও স্থানগুলিতে ২০০০ সালের ছবি একদমই নেই। আঙুলটা সামনের টাচ স্ক্রীন ছুঁল – বাবু ঘাট।
গঙ্গার ধারে একটা সুন্দর বাগানের পাশে ক্যাব থামতেই ধীরে সুস্থে নামল শরৎ। যতদূর দেখা যায়, বাঁধানো গঙ্গার ধারে সুন্দর সুন্দর পরিকল্পিত বাগান। বাবুঘাটের পুরোনো বাঁধানো ঘাটটি হেরিটেজ তকমা দিয়ে সংরক্ষিত। অবশ্য সেখানে স্নান করার কোন অধিকার নেই কারোরই। শুধু বাবুঘাটে কেন, ভারতবর্ষের কোন নদীতেই কারোর স্নান করার অধিকার নেই। একমাত্র সারা ভারতে কিছু সমুদ্র সৈকতে স্নান করার অধিকার দেওয়া হয়েছে।
কয়েকটা দিন বেশ খাটুনি গেছে। আজকে তার শেষ হলো।
শরৎ। শরৎ বিশাখা ভারত। যান্ত্রিক কর্মী।
এখন প্রতিটি ব্যক্তিকে পৃথিবীর নাগরিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তাই তার নামের পিছনে দেশের নাম আর মধ্যে দেশের কোন নদীর নাম দেওয়া হয়েছে। নামকরণ সরকারকৃত। তাদের আইডিন্টিফিকেশন নম্বর আলাদা আলাদা। ভারতে তো বটেই, পৃথিবীর যে কোন দেশে, যে কোন জায়গায় তার সম্পূর্ণ পরিচিতি দেওয়া আছে।
আর ব্যক্তির কর্ম। সেটাও সরকার অনুমোদিত। পেশা নামে কোন শব্দ অভিধানেই নেই।
প্রত্যেকটি ব্যক্তি সরকার নির্ধারিত কাজ করে। তার সরকার নির্ধারিত কাজ বছরে দশ মাসের। প্রতি বছর প্রতিটি কর্মীকে সরকার নির্ধারিত কোন একটি বিশেষ মাসে সরকার নির্ধারিত কোন বিশেষ কাজ করতে হয়। এই বিশেষ কাজের সঙ্গে তার সারা বছরের কাজের কোন সম্পর্ক নেই। সেটা যা কিছু হতে পারে। সেই বিশেষ কাজের রিপোর্ট তারা মাসের শেষ দিনে কোন মিটিংয়ে পেশ করে। আজকেই সেই বিশেষ কাজের রিপোর্ট পেশ করতে হয়েছে। এখন সাত দিন কোন কাজ করতে হবে না। সাতদিন সে নিজের মত থাকতে পারে। ছুটি বলা যায়, যদিও ছুটি বলে কোন শব্দ আজকাল ব্যবহার করা হয় না। সাতদিন পরে মেডিক্যাল চেক-আপ, তিন দিনের জন্য। আর তার পর কুড়ি দিনের বিশ্রাম, সারা ভারতে সে যে কোন জায়গায় বেড়াতে পারে।
এবারে কাজ ছিল গত ২০০০ সালের ৩১ শে ডিসেম্বরের পর বাংলা ভাষায় কত শব্দের অবলুপ্তি ঘটেছে। সেই শব্দের উৎপত্তির কারণ কি ছিল। সেই শব্দের অবলুপ্তির কারণটাই বা কি? সেই শব্দগুলোর আবার ব্যবহারের সম্ভাবনা আছে কি না। এই কাজটার সঙ্গে তার সরকার নির্দিষ্ট কাজের কোন সম্পর্ক নেই। কাজটা তেমন কিছু নয় বলে মনে হলেও, কাজটা বিরাট। প্রচুর খাটতে হয়েছে। হয়েছে শুধু কেন সেই শব্দটার উৎপত্তি হয়েছিল সেইটুকু জানার জন্য। যদিও কম্পিউটারে সব তথ্যই আছে, তবুও। যেমন ‘নৈবেদ্য’ শব্দটি। এটার উৎপত্তি, ব্যবহার, প্রয়োজনীয়তা, অবলুপ্তি ইত্যাদি জানতেই ঘন্টা তিনেক কেটে গেছে।
একমাত্র ফলমূল, শষ্য, প্রাণীজগৎ ছাড়া পৃথিবীর অনেক শব্দ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আত্মীয়, পুজো, যুদ্ধ, রোগ বাচক যত শব্দ আছে সবের অবলুপ্তি ঘটেছে। এমন কি শিক্ষাবাচক অনেক শব্দের অবলুপ্তি ঘটেছে। আত্মীয়বাচক শব্দের মধ্যে শুধু মা শব্দটি সরকার থেকে রাখা হয়েছে, ওটার অবলুপ্তি ঘটেনি। কিন্তু বাবা কাকা মাসি মেসো পিসি পিসেমশাই ভাই বোন সমস্ত শব্দের বিলুপ্তি ঘটেছে। তার কারণ মানব সম্পদের যোগান এবং নিয়ন্ত্রণ সবই সরকারের হাতে। সরকার নিয়ন্ত্রিত বিশেষ প্রজনন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রিত মানুয উৎপন্ন হয়। অবশ্য পুরো ব্যবস্থা যান্ত্রিক নয়। এখনও মানুষ উৎপাদনে নারী কে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু পুরুষের কোন ব্যবহার হচ্ছে না। বিশেষ ভাবে শোধন করা সংরক্ষিত নানা প্রকারের বীজ দিয়ে বিভিন্ন মানুষের উৎপাদন করা হচ্ছে।
এই উৎপাদিত যান্ত্রিক মানুষগুলো কিন্তু সাধারণ মানুষই। ২০০০ সালে যে ধরণের মানুষ ছিল, এরাও সেই ধরণের মানুষ। তফাৎ শুধু এদের থাকা খাওয়ার জন্য কোন চিন্তা করতে হয়না। সংসার বলে কিছু নেই। স্ত্রী, স্বামী, সন্তান বলে কিছু নেই। এদের রোগ বলেও কিছু নেই। এই মানুষের উৎপাদন প্রয়োজন ভিত্তিক। নির্ধারিত সময়ের ব্যবধানে এদের যন্ত্রণা বিহীনভাবে বিনষ্টও করে দেওয়া হয়। ২০৩০ সাল থেকে মানুষ রোগবিহীন মানুষের কথা চিন্তা করে। সেই চিন্তা ফলপ্রসু হয় ২০৭০ সাল নাগাদ। ততদিনে পৃথিবীর মানুষ যুদ্ধে, রোগে এবং বিভিন্ন রকম ভুল কাজে সমস্ত মানব সমাজ তথা প্রকৃতির যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করে ফেলেছে। তখন খেকেই সারা পৃথিবীর মানুষ এক যোগে ধ্বংসের হাত থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে। যার ফল বর্তমান পৃথিবী। সমস্ত উৎপাদিত মানুষই কর্মী, আলাদা আলাদা কাজের জন্য।
বাবুঘাটের একটা বাগানে ইতস্ততঃ ঘুরতে ঘুরতে একটা কথা শরৎ এর মাথায় ঘুরতে লাগল। এইরকম তো তার কোনদিন হয় না। শরীরে এইরকম অস্বস্তি হচ্ছে কেন? এইরকম তো তার হওয়ার কথা নয়। তাহলে কি তার শরীরে কোন গন্ডগোল হয়েছে? ওরা যদি চেক আপ এর সময় শরীরে গন্ডগোল দেখে তাহলে তো শরীর নষ্ট করে দেবে। নির্ধারিত সময়ের আগেই। ঠিক আছে। যা হওয়ার হবে। এ নিয়ে সে চিন্তা করবে না। অবশ্য তার শরীরের সিস্টেম বেশি চিন্তা করতে দেবে না। সেই রকম ভাবেই তার শরীর তৈরি।
বাগানে একটা কারুকাজ করা সুন্দর মার্বেল পাথরের বেঞ্চে বসে পড়ে গঙ্গার পশ্চিমপারের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবনাটাকে উড়িয়ে দিল শরৎ। পশ্চিম আকাশ লাল। সূর্য অস্ত যাচ্ছে।
“তুমি এখানে?”
মুখ তুলে তাকাল শরৎ। নীহারিকা। নীহারিকা কাবেরী ভারত। এই মেয়েটাকে খুব সুন্দর ভাবে তৈরি করেছে সাউথ হিউম্যান প্রোডাকশন ইউনিট। আজকের মিটিং এ ও উপস্থিত ছিল। রিপোর্ট জমা দিয়েছে। এই কাজের সঙ্গে ও যুক্ত ছিল। নিজেদের মধ্যে সামান্য আলোচনা গল্পগুজব হয়েছে। মোট পনের জন এই কাজে যুক্ত ছিল।
“এখানে বস।“ পাশের জায়গাটা দেখিয়ে বলল শরৎ।
নীহারিকা বসল। ওর দিকে তাকাল শরৎ। ওকে খুব সুন্দর লাগছে। একটা সুন্দর নীল রঙের ড্রেস মেটেরিয়াল দিয়ে সারা শরীরটা মোড়া। ও কম্পিউটারে ড্রেস মিউজিয়াম দেখেছে। এটা কে শাড়ী বলা হোত আগে। বর্তমানে অচল।
“এই ড্রেস তুমি কোথায় পেলে?”
“আমি “ভাষা ও শব্দ প্রজেক্টে” ঢোকার আগে সার্চ ইঞ্জিনে ছবিটা দেখেছিলাম। আমাদের ড্রেস অফিসার কে বলেছিলাম এটার জন্য। ও বলেছিল গভর্ণমেন্ট এর ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে ২১০০ সালের আগেই। আমি পরতে চাইলে বিশেষ অনুমতি নিতে হবে সরকার থেকে। আর অনুমতি পেলেও জিনিষটা পাওয়া মুস্কিল। কারণ বাজার বলে কিছু নেই, সবই সরকারের।“
“তাহলে তুমি কি করে পেলে?”
“আবার এ্যাপীল করলাম। গভর্ণমেন্টের তরফ থেকে স্পেশাল পারমিশন পেলাম আমি। একদিনের জন্য এই পোষাক পরতে অনুমতি পেলাম। আজকের তারিখে। যেহেতু এই দিন আমি নন-প্রোডাকটিভ একস্ট্রা প্রোজেক্টের সঙ্গে যুক্ত থাকব। ওরাই পোষাকটা তৈরি করে দেয়। তারপর এটা আমাকে জমা দিয়ে দিতে হবে। ভবিষ্যতে ব্যবহার করতে পারব না। এটা নাকি অবৈজ্ঞানিক আর কাজের পরিপন্থী। এর জন্য আমাকে সরকারকে ১০ দিনের “নো ওয়ার্ক ডে” ফেরৎ দিতে হবে। অর্থাৎ আগামী যে ২০ টা “নো ওয়ার্ক ডে” পাবার কথা ছিল, তার থেকে ১০ টা কেটে নেবে।“
“তাহলে তুমি কোথাও ঘুরতে যেতে পারছ না?”
“না, তাই আমি বেঙ্গলেই থাকব, মোস্টলি কোলকাতায়। আর তুমি কোথায় যাবে?”
“ইচ্ছা ছিল মানালি। কিন্তু এখন আর যেতে ইচ্ছে করছে না।“
“কেন?”
“তোমাকে দেখে।“
“কিন্তু কেন?”
“তোমার বিশ্রামের দশটা দিন কমে গেছে। এই দশটা দিন আমার তোমার সঙ্গে কাটাতে ইচ্ছা করছে। অবশ্য তোমার অনুমতি সাপেক্ষে।“
“খুব ভালো কথা। আজ তোমাকে দেখেই আমারও তোমাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছা করছিল। তুমি যথেষ্ট সুপুরুষ। কিন্তু সময়ের অভাবে বলা হয়ে ওঠেনি।“
“ঠিক আছে, কিন্তু সামান্য অসুবিধা আছে। আমার ক্লাব আর তোমার ক্লাবের মধ্যে তিনটে ধাপ ফারাক আছে। নিয়ম অনুযায়ী নিচু তলার লোক উপরতলার ক্লাবে যেতে পারবে না। তবে উঁচু তলার লোক নিচু তলার ক্লাবে যোগ দিতে পারবে। আর তো অন্য কোথাও আমরা একসাথে থাকতে পারব না।“
বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী সমস্ত জনসংখ্যাকে কিছু শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। আগের যুগের জাতপাতের মতো। বড়লোক গরীব লোকের মতো। এখন ঐ ভাবে শ্রেণী বিভাগ হয়না। তবুও মানুষের কিছু শ্রেণী বিন্যাস করা হয়েছে তাদের কাজের হিসেবে সমগ্র শাসম ব্যবস্থার জন্য। যেহেতু কোন মানুষের আলাদা কোন সংসার নেই, তাই সরকার কে বিভিন্ন শ্রেণীর জন্য ক্লাব তৈরি করে দিতে হয়েছে। বর্তমানে, মানুষের আনন্দের উপকরণ একদম কমে গেছে। সিনেমা তৈরি হয় না। গানের কথার অভাব বলে গান নেই। তবে সুর আছে। খেলাধুলো আছে। আর আছে নর নারীর অবাধ মিলন। এটাই বর্তমানে মানব মানবীর আনন্দের অন্যতম উপায়। এই আনন্দের ব্যবস্থাকে ভাষা কমিটির কোন পূর্বতন মিটিংএ কৌতুকের ছলে “আনন্দ ব্যায়াম” আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, যদিও সরকারি ভাবে শব্দটিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। সেই জন্য বিভিন্ন শ্রেণীর মানব মানবীর জন্য আলাদা ক্লাব তৈরী করে দেওয়া হয়েছে। ক্লাবের অনেক শ্রেণী আছে। ক্লাব সারা ভারতে, সারা বিশ্বে। ক্লাবে থাকা, খাওয়া, বিনোদন সব বর্তমান। সংসারের আধুনিক বিকল্প। নর নারী নিজেদের প্রয়োজন মতো সাথীদের ক্লাবের সদস্যদের থেকেই বাছাই করে। অবশ্য বিভিন্ন ক্লাব খেকে তারা সাথী বেছে নিতে পারে। নারী পুরুষের মধ্যে কোন জড়তা নেই। তারা যে কেউ অপরের কাছে মিলনের দাবী পেশ করতে পারে। অবশ্য সেই আহ্বানে সাড়া দেওয়া বা না দেওয়া ব্যক্তিগত ব্যাপার। কোন জোর খাটানো রীতি বিরুদ্ধ। কেউ আহ্বানে সাড়া না দিলে বিরক্তি প্রকাশ করাও নিয়মের বিরুদ্ধ। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাড়া না দেওয়ার প্রয়োজন হয়না। কারণ ক্লাবের বেশির ভাগ বাসিন্দারা পরস্পরের পরিচিত। তবে নিয়ম অনুযায়ী মিলনের প্রয়োজন ছাড়া কোন যুগল একসাথে একঘরে বসবাস করতে পারে না। বছরের নির্ধারিত কর্মহীন অবসরকালীন সময়ে অন্য প্রদেশে থাকলে ক্লাবে সঙ্গী বা সঙ্গীনির জন্য বিশেষ আবেদন পত্রের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ক্লাব পুরুষ বা নারীর প্রয়োজন ভিত্তিক বন্দোবস্ত করে। এবং সেই ব্যবস্থাও ক্লাবের মধ্যে, বাইরে নয়। যদিও সেই ব্যবস্থা শ্রেণী অনুযায়ী কোন নিম্ন শ্রেণীর পুরুষ বা নারী উচ্চ শ্রেণীর ক্লাবে যেতে পারবে না। তাদের মিলনের প্রয়োজনে সবসময়ই নিম্ন শ্রেণীর ক্লাবে যেতে হবে, উচ্চ শ্রেণীতে নয়। এই ব্যবস্থা সারা ভারত জুড়ে।
শরৎ নীহারিকার হাতটা ধরে নিজের মুঠার মধ্যে নিল। তারপর বলল, “তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তুমি আমার শ্রেণীর ক্লাবে আসতে পারবে না বা আমি তোমাকে নিয়ে আমার ক্লাবে ঢুকতে পারব না। তবে তুমি আমাকে নিয়ে তোমার ক্লাবে যেতে পারবে। এই ব্যাপারে আমার সামান্যতমও আপত্তি নেই, তোমার কি কোন আপত্তি আছে? তোমার সাথে আজকের রাতটা থাকতে ইচ্ছে করছে।“
নীহারিকা শরৎ এর গালে একটা হালকা চুমু খেয়ে বলল, “কোন অসুবিধে নেই। তোমাকে আমারও খুব মনে ধরেছে। চল, আমার ক্লাবে যাই. বেহালায়।“
রাত প্রায় শেষ হয়ে যাবার মুখে। শরৎ নীহারিকার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, “তোমার ঘুম ভেঙ্গেছে?”
নীহারিকা শরৎ কে আরও নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে ‘উঁ’ বলল।
“জানো, তোমাকে আমার খুব ভাল লেগেছে। আমার স্ট্যাটাসের দরকার নেই। আমি সারাজীবনের জন্য তোমার ক্লাবে থাকব। তুমি রাজি?”
নীহারিকার আবার ‘উঁ’ শোনা গেল।
“একটা কথা মনে আছে?” শরৎএর প্রশ্ন।
“কি?” শরৎ এর বুকের মধ্যে মুখ রেখে নীহারিকা বলল।
“গতকাল ফাইনাল মিটিংএ দুটো শব্দ থাকবে কি থাকবে না এই নিয়ে আমরা একমত হতে পারিনি। গত তিরিশ বছর ধরে এই দুটো শব্দের ব্যাপারে আমাদের পূর্বসুরীদের কেউ সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। শব্দ দুটোর ব্যবহার হবে কি হবে না, বিলুপ্তি ঘটবে কি ঘটবে না।“
“হ্যাঁ ‘প্রেম’ আর ‘ভালোবাসা’ এই শব্দ দুটো থাকবে কি থাকবে না।“
“জানো, গতকাল এই দুটো শব্দ আর তোমাকে দেখার পর তোমার রূপ, দুইয়ে মিলে আমার অজান্তে আমার মস্তিষ্কে কেমিক্যাল রি-এ্যাকশন করেছিল। সেই জন্য সাময়িক ভাবে আমি অসুস্থতা বোধ করছিলাম। এখন আর অসুস্থতা নেই। না, এই দুটো শব্দের বিলুপ্তি হবে না। হওয়া ঠিক হবে না। তুমি কি বল?”
“না গো, এই শব্দ দুটো চিরদিন থাকুক।“
===============