ছোটবেলা ©চন্দ্রাণী চৌধুরী

ছোটবেলা
©চন্দ্রাণী চৌধুরী
—————
আজ এখানে ভীষণ মেঘলা। মেঘলা মানেই আলস্য মনে হয় বসে থাকি দেখতে থাকি সে তরকারি কাটাই হোক নারকেল কুড়োনোই হোক কিংবা মাঠে গরু বাছুর চড়ানোই হোক কিংবা ঢেঁকিতে ধান ভাঙাই হোক। আসলে এসব ছোটবেলায় ময়নাগুড়িতে ছুটিতে গিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি। খড় ছাওয়ানো মাটির আঁশ নিরামিষ রান্নাঘর সেখানে পাটকাঠি জ্বালিয়ে রান্না করছে জেঠিমা। অসম্ভব পরিশ্রমী ছিল আর খুব ভালবাসতো। আম্মা মাটির নিকোনো বারান্দার এক কোণে বসে অবিরাম তরকারি কেটে যাচ্ছে নিখুঁত ভাবে। একতলার একটা ঘরে একঝুরি মর্তমান কলা রাখা থাকত ছোট ছোট কিন্তু ভিতরটা লালচে। ভীষণ মিষ্টি। সেরকম পরে আর দেখিনি পাইও নি। সবই বাড়ির গাছের। প্রচুর কাঠাল হত। বেশিরভাগ গলা কাঁঠাল। জেঠামশাই ভীষণ কাঁঠাল খেতে ভালবাসত। বাংলাদেশ থেকে এসে ময়নাগুড়িতে জমিজমা কাঠের দোতলা বাড়ি করা হয়েছিল। গোয়ালঘর ছিল। বাংলাদেশ থেকে আম্মার জন্য গন্ধচালের ধান এনে এখানে চাষ করা হত। আম্মা সেই চালের ভাত খেত। সকালে মুড়ির মোয়া গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে ক্ষীর করে তা ছাঁচে ফেলে সন্দেশ কলা এসব খাওয়া হত। তারপর আমি আর আমার এক জ্যাঠতুতো বোন বাড়ি লাগোয়া আমাদের দোকানে গিয়ে বসতাম। এদিক ওদিকে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতাম। গ্রসারি বিস্কুট লজেন্স চানাচুর সবই পাওয়া যেত। আমরা দুজন বসে খুব লেবুলজেন্স খেতাম। পরে দোকান লাগোয়া একটা ঘরে দুজনে বসে খবরের কাগজ দিয়ে ঠোঙা বানাতাম। সাইজ অনুযায়ী কাটাই থাকত আমরা দুজন শুধু আঠা দিয়ে জুড়তাম। দারুণ ছিল সে সব দিন। তারপর বাড়ির পিছনে গিয়ে মাটি ঘাটা সেখানে আবার শশা তরমুজ ফলে থাকত। সেও খানিক তুলে আনলে আম্মা কি বকত। বলতো এরা এখনো পাকে নি আর তোরা তুলে নিলি। এরপর বারান্দায় এসে ঐ ঢেঁকি খেলা। একদিকে আমি বসতাম অন্যদিকে ও আমায় তুলত। ঢেঁকিছাঁটা আতপ চালের ভাত সেই সময় প্রথম খেয়ে ছিলাম। বাড়ির সামনে দিয়ে চওড়া পাকা মসৃণ রাস্তা ছিল । আমাদের বাড়িটা ময়নাগুড়ি স্টেশনের কাজেই একদম রাস্তার উপর। বাড়ির উল্টোদিকে এক জ্যাঠামশাইয়ের একতলা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি সুন্দর সাজানো। বাবাদের মাসতুতো ভাই। দারুণ সাজানো কারণ তিনি ইন্ডিয়ান ওয়েলের অফিসার ছিলেন এবং কোম্পানি থেকে সুন্দর পর্দা ল্যাম্পসেড বেতের সোফাসেট এসব পেতেন। তিনি যে কি ভালবাসতেন আমাদের । কলকাতায় এলে আমাদের বাড়ি আসতেন। কি সুন্দর যে দিন কাটিয়েছি। পরে আম্মার মৃত্যু হলে বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ করা হয়ে ছিল। গোটা ময়নাগুড়ি নিমন্ত্রণ ছিল। জমিদান গরুদান সোনাদান করা হয়ে ছিল সেই শ্রাদ্ধে। ঠাকুরদার ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে জ্যাঠামশাই কাশীতে নিয়ে গিয়ে রেখেছিল এবং পাঁঠার মাংস কুকারে গলিয়ে খাওয়াতো সেই কুকার আমাদের কলকাতার বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে ছিলেন। তখন সবাই পূর্বপাকিস্তানেই থাকত ওঁরা। বাংলাদেশ তখনও হয়নি। আর কাশীতেই দাদু মারা গিয়েছিল। আমি কখনও দাদুকে দেখিনি। খুব সুন্দর ফর্সা লম্বা ছিলেন। শুনেছি। আর দাদু খুব পড়াশোনা ভালবাসত। তাই প্রত্যেক ছেলেকে কলকাতায় হোস্টেলে রেখে পড়িয়ে ছিল। বহু ব্যয় করেছিল। বড় জ্যাঠামশাই ডাক্তার ও ছিলেন। এমন বহু কথা আজ মনে পড়ছে। খুব ভালবাসার মধ্যে বড় হয়েছি। তাই বোধহয় অনেক সাংসারিক ঝড়ঝাপটা অনায়াসে সামলে নিতে পারি। আর বাড়িতে খুব পুজো হতো। নিত্য নারায়ণ সেবা হত।জ্যাঠামশাই পুজো করত সেখানেও গিয়ে আমরা দুজন বসে থাকতাম ঐ চালকলাবাতাসা খাওয়ার জন্য।
ছোটবেলাটা খুব ইমপর্টেন্ট! মন তৈরি করে দেয়। আজকের আমি তৈরির পিছনে এঁদের প্রত্যেকের বিরাট অবদান। তাঁরা কেউ পৃথিবীতে নেই অনেকের সঙ্গে হয়তো যোগাযোগ নেই। আজ এখানে খানিকটা বলে গেলাম। হাতে সময় আছে তাই❤